গোপালভাঁড়ের নাম তোমরা শুনেছ সবাই। তাকে বাংলার রসিকরাজ বলা হয়। তার মজার মজার গল্প শুনে হেসে গড়াগড়ি খায়নি এমন লোক খুবই কম আছে। এসো, আগে গোপালভাঁড়ের একটা গল্প শুনে নিই।
গোপালভাঁড় মিষ্টির দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। থরে থরে মিষ্টি সাজানো দোকানে। তার খুব লোভ হলো, খাবে। কিন্তু পকেটে একটা টাকাও নেই। কী করা যায়! দোকানে ঢুকে দেখে, ময়রার ছোট্ট ছেলে বসে আছে। গোপাল শুধায়, ‘কী রে, তোর বাপ কই?’
‘পেছনে, বিশ্রাম নিচ্ছে’, ময়রার ছেলে বলে।
‘তোর বাপ আর আমি খুব ভালো বন্ধু, বুঝলি? আমার নাম মাছি, কয়টা মিষ্টি খাই? তোর বাপ কিচ্ছু মনে করবে না।’ বলেই গোপাল টপাটপ মিষ্টি খেতে শুরু করে। মিষ্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে ময়রার ছেলে চেঁচিয়ে বলে, ‘বাবা, মাছি সব মিষ্টি খেয়ে ফেলছে কিন্তু।’ শুনে পেছন থেকে ময়রা বলে, ‘আরে খেতে দে! মাছি আর কট্টুক খাবে?’
কী, খুব হাসি পাচ্ছে, না? আচ্ছা, বলো তো, এই যে আমরা হাসি, এর কারণ কী? জানি বলবে, হাসির কথা শুনলে হাসি পাবে না! এর পেছনে আর কী কারণ থাকবে!
না, হাসির গল্প শুনলেই যে হাসবে এমন না ব্যাপারটা। এর পেছনে অন্য কারণ আছে। গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বের করেছেন সেই কারণ। আর এই গবেষণা করেছেন রবার্ট প্রোভাইন। তিনি বাল্টিমোরের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। গবেষণা তিনি একা করেননি। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন আরও কিছু গবেষক। তাঁরা ১ হাজার ২০০ লোকের ওপর একটি জরিপ চালান। সেখানে দেখা যায়, মাত্র ১০-২০ শতাংশ মানুষ বলেছে, মজার কিছু দেখলে বা শুনলে তারা হাসে। আর বেশির ভাগ মানুষ হাসে দৈনন্দিন জীবনের মামুলি কথাবার্তা বলার সময়।
রবার্ট প্রোভাইন এই গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে পরে একটি বই লেখেন। বইটির নাম লাফটার: আ সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন। সেখানে তিনি লেখেন, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ শোনার চেয়ে কথা বলার সময় হাসে। অন্যদিকে একা একা টেলিভিশন দেখার সময়ের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি হেসে থাকে কোনো সামাজিক পরিবেশে থাকলে। তাই প্রোভাইন এই বলে উপসংহার টেনেছেন যে মজার গল্প হাসির জন্য অপরিহার্য উপাদান নয়। হাসি হলো গল্প শুনে হাসার চেয়েও আরও সাধারণ ব্যাপার। একে আমরা সামাজিক বন্ধন বলে উল্লেখ করতে পারি, যা আমরা সবাইকে একই সূত্রে বেঁধে রাখতে ব্যবহার করি।
হাসির অনেক রূপ আছে। তোমরা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের ছড়ায় পড়েছ—খোকন হাসে ফোকলা দাঁতে, চাঁদ হাসে তার সাথে সাথে... আচ্ছা, তবে বাচ্চাদের হাসির কথাই আগে বলে নিই। বাচ্চারা প্রথম হাসে দুই থেকে ছয় মাস বয়সের মধ্যে। এ সময়ে হাসার পেছনে কারণ হলো, নিজেদের নিরাপদ মনে করা। বলতেই পারো, এইটুকুন বাচ্চা, সে আবার নিরাপত্তার কী বোঝে? আমাদের হাসির সঙ্গে মস্তিষ্কের ডোপামিন রিওয়ার্ড সার্কিটের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এটি নিরাপত্তা ও ভালো লাগার অনুভব তৈরি করে বাচ্চাদের চারপাশের প্রতি কৌতূহলী করে তোলে। বাচ্চারা খেলাধুলার সময় উচ্চ স্বরে হাসার মাধ্যমে সামাজিক ও শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দেয়।
নার্ভাস হাসির মাধ্যমে আমরা যে চাপের মধ্যে আছি, সেটাই প্রকাশ পায়। আবার হাসির মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী বা দলের আচরণের বহিঃপ্রকাশ বোঝা যায়। মনের অন্ধকার দিকের প্রকাশও ঘটে হাসির মাধ্যমে। আটলান্টার জর্জিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী মাইকেল ওয়েন জানিয়েছেন, হাসির মাধ্যমে আপনি অন্যজনের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারবেন। এই মনোবিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন, হাসি হলো সূক্ষ্ম ইঙ্গিত মাস্টার। এটা ব্যবহার করে চারপাশকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারি। অনেকে অবশ্য হাসিকে ভীতি প্রদর্শনের অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করেন। সিনেমায় যার উদাহরণ আমরা হরহামেশা দেখি।
মানুষের হাসি নিয়ে কথা তো হলো। এবার অন্যদের হাসির দিকে একটু নজর দিই। সত্যজিৎ রায়ের ‘অসামঞ্জস্য বাবুর কুকুর’ গল্পটার কথা মনে আছে? অসামঞ্জস্য নামে এক লোক রাস্তা থেকে একটি কুকুর কেনেন। ভুটানি নেড়ি কুকুর। তবে এই কুকুর সাধারণ কুকুর নয়। এই কুকুর মানুষের মতো হাসতে পারে। তাই নিয়ে কাণ্ডকারখানা! আচ্ছা যাও, গল্পের কুকুর বাদ দাও। বাস্তবের কুকুর, বিড়াল, বানর, শিম্পাজি কী করে, তাই দেখি।
একসময় মনে করা হতো, প্রাণিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষই কেবল হাসতে পারে। ১৭১২ সালে ইংলিশ লেখক জোসেফ অ্যাডিশন বলেছিলেন, মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো, মানুষ হাসতে পারে, অন্যরা পারে না। তবে আধুনিক বিজ্ঞান বলে অন্য কথা। চারপেয়ে প্রাণীরাও হাসে। কিন্তু ওদের গলার স্বরতন্ত্রের কারণে সেগুলো আমাদের কাছে হাসি বলে মনে হয় না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আফ্রিকার গরিলা ও শিম্পাজিদের হাসির শব্দ মানুষের খুব কাছাকাছি।
হাসির রকমফেরের কথা তো আমরা জানিই। কিন্তু হাসিরও যে আসল-নকল আছে, তা কি আমরা জানি! আমরা যখন হাসি, তখন আমাদের চোখের কোণের পেশিগুলো কুঞ্চিত হয়। নকল হাসির সময় সেটি হয় না। বিজ্ঞানীরা আসল হাসির নাম দিয়েছেন ‘ডাচিনি স্মাইল’।
হাসি আবার ওষুধেরও কাজ করে! ক্যালিফোর্নিয়ার লোমা লিন্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি বার্ক ২০ জনের ওপর এক গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে প্রত্যেককে ২০ মিনিট করে একটি হাসির অনুষ্ঠান দেখানো হয়। অনুষ্ঠান দেখানোর আগে-পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, হাসির অনুষ্ঠান দেখে তাদের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, হাসি ইনফেকশনের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকের কাজ করে। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসি অ্যান্টি-বডি তৈরির পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা ইমিউন সিস্টেমের দক্ষতা বাড়ায়।
খেলার সঙ্গে হাসির বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। দেখা যায়, বাচ্চারা বেশি হাসে। বিশেষ করে, তাদের বয়স যখন পাঁচ-ছয় বছর। কারণ, এই বয়সের বাচ্চারা খেলাধুলা বেশি করে। আবার তরুণ বা একটু বয়স্করা কম হাসেন। খেলাধুলা কম করে বলেই তাঁরা কম হাসেন।
আমরা হাসি কেন, হাসির সুফল কী, এসব তো জানলেই। তাই আসো, আমরা আমাদের জীবন হাসিখুশিময় করে রাখি।