সাপলুডুর মক্সা বোর্ড
'তোমার গুটি সাপে খেয়েছে।'
'ইশ, আরেকটু হলে মইটা পেতাম।'
গরমের ছুটি হোক কিংবা পরীক্ষার বিরতি, লুডো বোর্ডের উল্টো পাশের সাপলুডু খেলায় এভাবেই মেতে উঠেছে অনেক বাড়ি। কোয়ারেন্টিনের এই সময়টায় তুমিও হয়তো খেলেছ এই সাপলুডু। কৌটা ঝাঁকিয়ে নানা কায়দায় ডাইস ফেলা, সে অনুসারে একে একে ঘুঁটি আগাতে হয় এই খেলায়। এরই মাঝে ঘুঁটি কখনো যায় বোর্ডে ওত পেতে থাকা সাপের পেটে, আবার কখনো মই বেয়ে সুরসুরিয়ে উঠে যায় আরও ওপরে। যার ঘুঁটি সবার আগে পৌঁছে যায় শেষ ঘরে, সে-ই বিজয়ী। স্থান, কাল আর বোর্ডভেদে নানা নিয়ম থাকলেও সাপলুডুর মূল নিয়ম কিন্তু এটাই। তবে এই সাপলুডুর পেছনের গল্প কয়েক শ বছরের পুরোনো।
এখন ঘরে বসে এই সাপলুডু খেলতে পারলেও একসময় এটা ছিল পড়াশোনার বিষয়। প্রাচীন ভারতে জীবনদর্শন আর মূল্যবোধের পাঠ দিতে শেখানো হতো সাপলুডু খেলা। জীবনে ধীরে ধীরে ছোট থেকে বড় হতে হয়। আর এই পথ ধরে সফলভাবে এগোলে দেখা মেলে ‘মক্সা’–এর। মক্সা বলতে বোঝানো হতো আত্মশুদ্ধি, আত্মার মুক্তি কিংবা চিরশান্তি। তবে এরই মধ্যে ভালো কাজের জন্য পাওয়া যাবে সম্মান-পুরস্কার আর ভুল কাজের জন্য থাকবে শাস্তি। শাস্তির তুলনা করা হতো সাপলুডুর সাপের সঙ্গে। যেখানে সাপের পেটে গুটি গেলে তা পিছিয়ে পড়ে, সেভাবে বাস্তব জীবনে পাপ করলে মানুষও মক্সা থেকে পিছিয়ে যাবে। এমন ধর্মীয় ও তাত্ত্বিক ভাবনার অবতারণা হতো এই সাপলুডুর বোর্ডে।
শুরুতে এই খেলার নাম ছিল ‘জ্ঞান চওপার’, মানে বুদ্ধির খেলা। তবে ভারতের অনেক অঞ্চলেই এটির ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। মক্সাপাথ, মক্সাপাতামুসহ নানা পুরোনো নাম ছিল এই খেলার। তবে এটা জানা যায়নি, ঠিক কে কবে এই খেলার প্রচলন করে। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দ থেকেই ভারতে এই খেলার প্রচলন ছিল। অনেকেই ভারতের মারাঠি এক পুরোহিত ধনেশ্বর (যাকে কেউ কেউ ধনদেব নামে চেনে) এই খেলার প্রচলন করেন বলে মনে করেন। ভারতের মোহেঞ্জোদারো, হারাপ্পা, লোতানহাল, কালিবাগান, আলামগীরপুরে হাতির দাঁত ও হাড় দিয়ে বানানো এমন ছক বোর্ডের খেলার উপকরণ পাওয়া যায়। তাই কিছু ইতিহাসবিদ বলেন যে এমন ছকবোর্ডের সাপলুডু খেলার জন্ম তাহলে খ্রিষ্টের জন্মেরও তিন হাজার বছর আগে। ওই সময়ে এমন ছকবোর্ডের খেলার এত উপকরণ পাওয়া থেকে বোঝা যায় যে তখনো শিশুদের মনে খেলার ছলে হলেও জায়গা করে নিয়েছিল এই সাপলুডু।
সময়ের মই পাড়ি দিতে গিয়ে সাপলুডুর বোর্ডটাও কিন্তু বদলে গিয়েছে নানা সময়ে। ৭২ বর্গের বোর্ড দিয়ে খেলার শুরু হলেও ১০০ বর্গের বোর্ডও পাওয়া গেছে সাপলুডুতে। পুরোনো সাপলুডুর বোর্ড থেকে আধুনিক সাপলুডুর বোর্ডের মূল পার্থক্য তৈরি হয় এটির বর্গভেদে ফলাফলে।
৭২ বর্গের জ্ঞান চওপারের ২৪, ৪৪ আর ৫৫ নম্বর বর্গে ছিল খারাপ ফলাফলের ইশারা। খারাপ বন্ধু, মিথ্যা জ্ঞান আর অহংকার ছিল এই বর্গগুলোর প্রতিরূপ। ধর্ম ও দর্শনে যেমনটা বোঝানো হয় যে মানুষ তার খারাপ কাজের জন্য শাস্তি পাবে, সেভাবে এই ঘরগুলোয় ঘুঁটি পড়লে সাপের লেজের শেষের ঘরেও লেখা আছে কিছু শাস্তির কথা। ক্রমানুসারে সেগুলো হলো অসার অহমিকা, চরিত্রের পতন আর ধারণার বিভ্রম।
অন্যদিকে, ভালো কাজ মানে সাপলুডুর ছকের মই নিয়েই আছে সুন্দর ব্যাখ্যা। চরিত্রের পবিত্রতা, সত্য বিশ্বাস আর বিবেক—এই তিনটি বিষয় তুলনা করে ক্রমান্বয়ে ১০, ২৮ আর ৪৬ নম্বর ঘরে আছে তিনটি মই। স্বর্গের বাহন, সত্যের পুরস্কার আর শান্তি—এই তিন পুরস্কার থাকছে এই তিন মইয়ের শীর্ষে। ৭২ বর্গের এই বোর্ডের ৬৮ নম্বর বর্গটি হলো ঈশ্বরের সবচেয়ে প্রিয় স্থান, যেখানে মানুষের আত্মা সর্বোচ্চ পবিত্রতা পায়।
এভাবে সাপলুডুর ছকের প্রতিবর্গে জীবনের দর্শন আর ধর্মীয় অনুভূতির নানা দিক নিয়ে শেখানো হতো পাঠশালাগুলোয়। অনেকেই আবার পুরো এই বোর্ডকে মানুষের জীবনকালের সঙ্গে তুলনা করত। বোর্ডের একেবারে ওপরের অংশ হচ্ছে মানুষের শেষ সময়। যখন মানুষ ‘মক্সা দোর’, মানে আত্মিক জগতের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। নিচের দুই পাশ মানুষের জীবনের যৌবন আর বাল্যকালকে তুলে ধরে। আর এরই মধ্যে চলে ভালো কাজ আর খারাপ কাজের হিসাব-নিকাশ।
সাপলুডু বোর্ডের এই খেলা গোটা ভারতে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে নানাভাবে বদলে বিভিন্ন ধর্মেই এটি শেখানো হয়। ধর্মীয় গুরুরা তাঁদের শিষ্যদের জীবনের নানা কাজের ফলাফল বোঝাতে এই খেলার চর্চা করাতেন। পাতার পর পাতা বই পড়ার চেয়ে বিনোদনে খেলতে গিয়ে জীবনের পাঠ নিতে কে না চাইবে, বলো?
ভারতের ইংরেজ শাসকদের হাত ধরে এবার জ্ঞান চওপারের যাত্রা হলো ব্রিটেনে। ওখানে আর এত জীবনদর্শন আর ধর্মীয় বিশ্বাসের নিয়ম মানেনি বোর্ডের সাপ বা মই। সেখানে ডাইসের নম্বর গুনে খেলায় মেতে ওঠে সবাই। খেলার নিয়মকানুনে সমতা আনতে পুরো বোর্ডে সমানসংখ্যক মই আর সাপ বসান ব্রিটেনের রাজারা। কিন্তু আসল সাপলুডুতে মই থেকে সাপের পরিমাণ বেশি ছিল এটা বোঝাতে যে জীবনে উন্নতি করা কঠিন। তবে একটু অসতর্ক হলেই পাপের ভারে জীবনের মূল্য হারাতে হতে পারে। ব্রিটেনে এই খেলা ক্রমেই সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালে মিল্টন ব্র্যাডলি যুক্তরাষ্ট্রে এই খেলার পরিচিতি ঘটান।
পেছনের এত ইতিহাস জেনে কী ভাবছ, এবার তোমার গুটি সাপে খেলে কী শাস্তি পাবে? উঁহু, লুডোর বোর্ডে শাস্তি পাওয়ার কিছু নেই। নির্মল আনন্দের জন্য এমন সাপের পেটে তুমিও ঘুরে আসতে পারো তোমার গুটির সঙ্গে। তবে খেলার সঙ্গে জীবনের এই পাঠটাও নিতে পারলে, সেটাও কিন্তু খারাপ হবে না!
তথ্য সূত্র: অরিজিন অব এভরিথিং