রাজা মিডাসের নির্বুদ্ধিতা

সাইলেনাস

বহুকাল আগের কথা। মিডাস নামের এক রাজা রাজত্ব করতেন এক দেশে। সেই দেশের নাম ফ্রিজিয়া। দেশটায় অনেক গোলাপবাগান ছিল। সেসব বাগানে ফুটত চমত্কার সব গোলাপ। সেসব ফুল যেমন ছিল দেখতে, তেমনি ছিল তাদের মনমাতানো ঘ্রাণ। তাই লোকে বলত, ফ্রিজিয়া হলো গোলাপের দেশ। সে দেশের রাজপ্রাসাদটাও ছিল গোলাপবাগান দিয়েই ঘেরা।
একদিন হলো কী, প্রাসাদের পাশের গোলাপবাগানে এসেছিলেন সাইলেনাস। এই সাইলেনাস কিন্তু অনেকটা মানুষের মতো দেখতে হলেও পুরোপুরি মানুষ ছিলেন না। তাঁর পা ও কানজোড়া ছিল ছাগলের মতো। আর সঙ্গে ছিল ঘোড়ার মতো একটা লেজ। তিনি ছিলেন দেবতা ডায়োনিসাসের খুব প্রিয় প্রাত্র ও স্যাটারদের প্রধান। কথাটা যখন এসেই গেল, তখন ডায়োনিসাসের পরিচয়ও একটু জানিয়ে রাখা দরকার। তিনি ছিলেন অলিম্পাস পর্বতের একমাত্র সম্পূর্ণ দেবতা, যাঁর মা কোনো দেবী ছিলেন না। ছিলেন একজন মরণশীল মানবী। তিনি ছিলেন থিবিয়ার রাজকুমারী সেমেলি। আর বাবা? তাঁর বাবা ছিলেন দেবতাদের রাজা জিউস।
তো, সেই সাইলেনাসের বয়স হয়েছিল অনেক। একদিন দেবতাপুরী থেকে বেরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে পড়েছিলেন রাজা মিডাসের গোলাপবাগানে। সেখানে তিনি ঘুমজড়ানো চোখে পড়ে ছিলেন। তাঁকে ওই অবস্থায় আবিষ্কার করল রাজার চাকরেরা। তারা তাঁকে গোলাপের মালা দিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর তাঁকে নিয়ে উপহাস-কৌতুকও করল বেশ। এবার তাঁকে হাজির করল রাজার সামনে। চাকরেরা চিনতে না পারলেও রাজা কিন্তু ঠিকই চিনে ফেললেন সাইলেনাসকে। আর চাকরবাকরদের বেশ করে বকুনি লাগালেন। অবশেষে সাইলেনাসকে খুব আদর-আপ্যায়ন করে তাঁর অমর্যাদার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন রাজা। দিন দশেক পর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে রাজা গেলেন ডায়োনিসাসের দরবারে। দেবতা তো সাইলেনাসকে ফিরে পেয়ে খুব খুশি হলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি রাজাকে বললেন, তিনি যা চাইবেন, সেই বরই দেওয়া হবে তাঁকে।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, রাজার ছিল দুটি বড় দোষ। এক, তিনি ছিলেন একটু লোভী ধরনের মানুষ। দুই, তাঁর বুদ্ধি-জ্ঞান অন্য রাজাদের চেয়ে কম ছিল। বলা যায়, একটু হাবা ধরনের রাজা ছিলেন। লোভের কবলে পড়ে যেকোনো বোকামি করতেও দেরি করতেন না তিনি। তাই তাঁকে বোকা ও লোভী রাজাও বলা যায়। তো, দেবতা বর চাইতে বলতেই তিনি বেশি সুবিধা-অসুবিধা না ভেবেই লোভের বশবর্তী হয়ে একটা বর চাইলেন। কী ছিল সেই বর, তা কি জানো? সেই প্রার্থনা করা বর ছিল, তিনি যা ছোঁবেন, তা সঙ্গে সঙ্গেই সোনা হয়ে যাবে।

মিডাসের স্পর্শে সোনার মূর্তিতে পরিণত হলো তাঁর মেয়ে

রাজা যখন এই বর চাইলেন, তখন তিনি মোটেও ভাবলেন না যে বরটি পেয়ে গেলে কী ফল হতে পারে। কিন্তু দেবতা বুঝেছিলেন, তাই তিনি আবার রাজাকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি আসলেই এই বরই চাইছেন কি না। রাজা তখন আবারও ওই বরই চাইলেন। দেবতা বর দিলেন। রাজা খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে ফিরে এলেন নিজ দেশ ফ্রিজিয়ায়। রাজাকে খাবার দেওয়া হলো। কিন্তু তিনি খাবেন কী, যা কিছু ধরছেন, তা–ই সোনা হয়ে যাচ্ছে। খাবার জিনিস স্পর্শ করতেই সবকিছু হয়ে গেল সোনা! তিনি বাগানে গিয়ে গোলাপে হাত দিলেন, অমনি তা সোনা হয়ে গেল। এমন সময় তাঁর মেয়ে এগিয়ে এল। ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন যে মেয়েকে স্পর্শ করলে তাঁর পরিণতি কী হতে পারে। তাই মেয়েকে কাছে আসতে বারণ করতে চাইলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তিনি পেলেন কোথায়? না, না করতে করতেই মেয়ের গায়ে লেগে গেল তার হাতের ছোঁয়া। আর কী, সঙ্গে সঙ্গেই নিজের আদরের মেয়েটা জলজ্যান্ত সোনার মূর্তি হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল তাঁর সামনে। হায় হায় করে উঠলেন রাজা। তিনি তখন ভাবলেন, চুলোয় যাক সব বর। রাজত্ব, রাজ্য সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছুটলেন তিনি ডায়োনিসাসের কাছে। দেবতাকে তিনি হাতজোড় করে মিনতি জানালেন, চাই না এই বর। আমায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিন।
দেবতা তখন মুচকি হেসে বললেন, বেশ। বর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। তবে তোমাকে সে জন্য একটা কাজ করতে হবে। তুমি প্যাক্টোনাস নদীর পােড় চলে যাও। সেখানে গিয়ে যদি স্নান করতে পারো, তাহলেই তোমার এ বর চলে যাবে।
রাজা তো তখন উন্মাদপ্রায়। তিনি ছুটলেন প্যাক্টোনাসের উত্সমুখে। সেখানে দিলেন ডুব। অমনি তাঁর বর ফিরিয়ে নিলেন দেবতা। আর রাজাও ফিরে পেলেন তাঁর মেয়েকে। সেই থেকে প্যাক্টোনাস নদীতীরের বালুতে সোনা পাওয়া যায়।
বড় বড় ধাক্কা খেয়েও রাজা মিডাসের বুদ্ধির খুব একটা উন্নতি হলো না। একবার হলো কী, অ্যাপোলো ও প্যানের মধ্যে বাঁশি বাজানোর প্রতিযোগিতা হলো। অ্যাপোলো ছিলেন আলোর দেবতা। একই সঙ্গে তিনি সোনালি বীণা, রুপালি ধনুক ও আরও অনেক কিছুর দেবতা ছিলেন। তিনি সোনালি বীণার সুর তুললে শুধু মিউজরা ছাড়া আর কেউই তাঁর মতো সুর তুলতে পারত না। এই মিউজরা ছিলেন সংগীত, সাহিত্য ও কলার নয়জন দেবী, তাঁদের বাবা দেবরাজ জিউস, আর মা ছিলেন দেবী নেমোসাইন। অন্যদিকে প্যানের সুর সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না। তাঁর পা আর কানজোড়া ছিল ছাগলের মতো। প্রতিযোগিতা শুরু হলে অ্যাপোলো অপূর্ব সুর তুললেন। প্যান তাঁর ধারেকাছেও গেল না। এ প্রতিযোগিতায় অ্যাপোলোকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন পর্বতদেবতা মলাস। আর শক্তিধর একজন দেবতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে নিতান্ত নির্বোধের মতো মিডাস বিজয়ী ঘোষণা করলেন প্যানকে। এতে দেবতা অ্যাপোলো মহা রুষ্ট হলেন।

রাজা মিডাসের গাধার কান

একে তো প্যানের সুর সম্বন্ধে কোনো জ্ঞানই ছিল না, আর তাকেই কিনা বিজয়ী ঘোষণা করলেন মিডাস! তা ছাড়া অন্য একটি কারণেও দেবতা খেপলেন। সেটা হলো, হোক না রাজা, তবু সে তো মানুষ। আর মানুষ হয়ে শক্তিমান দেবতার বিরুদ্ধাচরণ? এটা দেবতা সইলেন না কিছুতেই। তিনি বললেন, ওর শোনার ক্ষমতা এতই নিচুমানের! ওর আর মানুষের কান রেখে লাভ কী? ওর কান বদলে সেখানে গাধার কান দাও। দেবতার আদেশ! সঙ্গে সঙ্গে রাজা মিডাস পেলেন গাধার কান। কী আর করবেন! গাধার কান নিয়েই তিনি ফিরলেন দেশে। তবে আসার সময় লম্বা এক টুপি নিয়ে এলেন। সেই টুপি দিয়ে কান ঢেকে রাখতে লাগলেন। সারা দিন তো বটেই, রাতে ঘুমানোর সময়ও তাঁর দুই কানই রাখতেন টুপিতে ঢেকে। তখন শীতকাল ছিল বলে লোকে জিজ্ঞেস করলে বলতে লাগলেন, শীতের জন্য টুপি পরেছি। কিন্তু চিরটাকাল তো আর এভাবে পারলেন না। একসময় তাঁর চুল অনেক বড় হয়ে গেল। নাপিতকে তলব করা হলো। চুল কাটার আগে নাপিতকে কানে কানে বলে দিলেন রাজা, তাঁর কান দুটি যে গাধার, তা যেন কেউ না জানে।
নাপিত মাথা দোলাল। চুল কাটল। বাড়ি গেল। কিন্তু রাজার হুকুম অমান্য করে কাউকে কিছু বলল না। তবে তার ভেতরটা হাঁসফাঁস করতে লাগল। তখন সে এই অস্থিরতা থেকে মুক্তির জন্য এক প্রান্তরে গিয়ে মাটি সরিয়ে গর্তমতো করে সেখানে মুখ লুকিয়ে বলল, ‘আমাদের রাজার গাধার কান।’
তারপর গর্তটা মাটি ভরাট করে বাড়ি চলে এল। ওদিকে কিছুকাল পরে বসন্তকাল এলে সব মাঠ-প্রান্তরে গাছপালায় ছেয়ে গেল। কিন্তু সেখানে মজার ব্যাপার একটা ঘটল। সেই প্রান্তরের নতুন গজানো গাছগুলোর ডাল-পাতাদের ঘষাঘষি হতেই আওয়াজ উঠতে লাগল, ‘আমাদের রাজার গাধার কান।’
দেখতে দেখতে সবাই জেনে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু জানলে কী হবে, তারা নিজেরা মুখ টিপে হাসত, তবে রাজাকে কেউই কিছু বলত না।

এই কাহিনির শিক্ষা
এই পুরাণ কাহিনির শিক্ষা হলো, সব দিক বিবেচনা করে ভবিষ্যৎ ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।