আমাদের খুদে পুত্রধন গিয়েছিল ছাদে। ওখান থেকে ফিরল যখন, তাকে চেনা দায়। হাত-পা কাদায় ভর্তি, মাথার চুল ভর্তি মাকড়সার জালে। তবে এসবে থোড়াই কেয়ার তার—খুশিতে বেরিয়ে আছে সব কটি দাঁত। প্রথমত, ইচ্ছে ছিল দু ঘা দিই। তারপর—সেই যে অমোঘ বাণী—আপনার শিশুকে ‘হ্যাঁ’ বলুন—সেটি মাথায় রেখে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘এই অবস্থা কেন তোর?’
‘কী অবস্থা?’, যেন কিছুই হয়নি এমন মুখভঙ্গি করে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ও। ওর এই কথায় আমার উচিত ছিল চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো। তবে ওই কদিন আগেই ওর চুলে কটি ছাঁট দিয়ে আনিয়েছি আমি নিজেই। তাই মুঠ করে ধরার মতো চুল নেই আপাতত মহাশয়ের মাথায়। তা ছাড়া আমার টাকমাথায় যে দু-চারখানা চুল এখনো অবশিষ্ট আছে, সে কটাও প্রতিশোধস্পৃহায় কখন গায়েব করে দেয়—এই আশঙ্কায় হাত সামলাই আমি।
‘সারা গায়ে কাদা কেন?’ জিজ্ঞেস করি।
‘ও, টবের গাছে যত্ন করতে গিয়ে এমন হয়েছে।’
‘যত্ন তো করেছিস হাত দিয়ে, গা-ভর্তি কাদা এল কোত্থেকে?’
‘ওহ বাবা, তুমি কি বোঝো না, কাজের সময় অত খেয়াল রাখা যায় না!’
কোনোমতে রাগ চেপে বলি, ‘কিন্তু মাকড়সার জাল মাথায় লাগল কী করে? যতদূর মনে পড়ে, কোনো টবে মাকড়সার চাষ করা হয়নি!’
‘আরে না, ওই যে সিঁড়ি-বারান্দায় মাকড়সারা বিস্তর জাল বেঁধে রেখেছে, দেখে ভাবলাম পরিষ্কার করে দিই। তাই মই দিয়ে উঠে সব জাল ভেঙে দিয়েছি।’
‘ঠিক করিসনি।’
‘কেন?’
‘জানিস, কোনো কোনো মাকড়সা রীতিমতো বিষধর। এক প্রজাতির মাকড়সা শিকারের গায়ে ইনজেকশনের মতো করে একধরনের রস ঢুকিয়ে দেয়, যেন হজমে সুবিধে হয়! কমবেশি বিষ বেশির ভাগ মাকড়সারই থাকে। তবে এর মধ্যে আছে ভয়াবহ বিপজ্জনক বিষও। ওই বিষকে আবার দুভাগে ভাগ করা যায়—নিউরোটক্সিক আর নেকরোটিক। নিউরোটক্সিকের কারণে শরীর অসাড় হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাক উইডো মাকড়সার বিষ এই শ্রেণির। আর নেকরোটিকের কারণে আক্রান্ত স্থানের চামড়া কালো হয়ে যায়। কখনো কখনো ফুসকুড়িও ওঠে। তবে কেনো কোনো জীব এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান।’
‘মানে’
‘আসলে, সব প্রাণীর ওপর মাকড়সার বিষের প্রভাব এক রকম নয়। যেমন মাকড়সার বিষে খুব দ্রুত কাবু হয় বিড়াল আর ঘোড়া। কুকুরের ওপর বিষের প্রভাব তুলনায় কম। ভেড়া আর খরগোশের ওপর বিষের প্রভাব নেই বললেই চলে। তবে এই বিষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে নামডাকওয়ালা হচ্ছে টারানটুলা মাকড়সা।’
‘কেন? ওদের অত নামডাক কেন?’
‘বলতে পারি, তবে আর আগে হাত-পা ধুয়ে আয় ঠিকমতো। পরিষ্কার করে আয় মাথা?
অন্য সময় জুনিয়র ওসমানকে এমন কাজে রাজি করানো মুশকিল হতো। কিন্তু গল্পের লোভে রাজি হয় সে। ছুটে গিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে। বলে, ‘এবার বলো বাকিটুকু।’
‘বলব তো বটেই, তবে কপাল ভালো তোর যে টারানটুলার হাতে পড়িসনি।’
‘ও বাবা! কেন? কেন বলছ এমন?’
‘কারণ, আমেরিকা নিবাসী ওই টারানটুলারা হলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাকড়সা। গড়ে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয় এরা; তবে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা টারনটুলারও খবর মিলেছে। দক্ষিণ আমেরিকার টারানটুলারা ভয়ানক বিষধর। সে তুলনায় উত্তর আমেরিকা নিবাসীদের বিষের তেজ কম। টারানটুলাদের একটি ভারি অদ্ভুত অভ্যাস হচ্ছে যে রেগে গেলে এরা নিজের পেটের রোম নিজেই ছুড়ে দেয় শত্রুর দিকে!’
‘ছি!’
‘আরও আছে!’
‘কী আছে আরও?’
‘আরে, মাকড়সার কি কোনো ইয়ত্তা আছে! জীববিদরা এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার প্রজাতির মাকড়সা শনাক্ত করেছেন। ধারণা করা হয়, এর চেয়েও বেশি মাকড়সা প্রজাতির খোঁজ এখনো মেলেনি।’
‘বলো কী! এত?’
‘এতই তো! আর কত রকম এদের জীবন! কেউ থাকে বনে, কেউ ঘরের কোণে। কেউ দৌড়ে বেড়ায় পানির ওপরে, আর হালকা খুদে মাকড়সাগুলো তো বাতাসে গা ভাসিয়েই চলে যায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। কেউ জাল বোনে, কেউ বোনে না। কেউ শিকার করে জালে জড়িয়ে জড়িয়ে, কেউ আক্রমণ করে সরাসরি, আবার কেউ শিকারকে কাবু করে লালায় জড়িয়ে। আচ্ছা, এক লাফে কতদূর পেরোতে পারিস তুই?’
‘অনেক’ হাসিমুখে বলে ওসমান জুনিয়র, ‘এক লাফে তিন-চার সিঁড়ি পেরোতে পারি আমি।’
‘কিন্তু জাম্পিং স্পাইডার কিংবা লাফানি-মাকড়সার রেকর্ড ভাঙতে পারবি না! মাত্র ১০ মিলিমিটার লম্বা খুদে এই মাকড়সাগুলো এক লাফে পেরোতে পারে তার শরীরের দূরত্বের ৪০ গুণ!’
‘৪০ গুণ!’
‘হ্যাঁ, তবে অন্য মাকড়সারাও কম যায় না। যেমন স্পিটিং স্পাইডার বা থুতু ছোড়া মাকড়সারা একধরনের আঠালো তরল ছুড়ে কাবু করে শিকারকে।’
‘থুতু ছুড়ে শিকার! দারুণ তো! ঠিক যেন বন্দুক! খালি গুলির বদলে থুতু!’
‘ভালো বলেছিস তো।’
‘আমি তো সব সময় ভালো কথাই বলি,’ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে খুদে, ‘খালি জানতে চাও না তুমি।’
‘তাই?’
‘তা-ই তো। যাহোক, বাদ দাও। মাকড়সার গল্প করছিলে, তা-ই করো।’
‘আর কী বলব, অনেক তো বললাম।’
‘আরে আসল কথাই যে বাদ দিয়ে গিয়েছ তুমি, মাকড়সার জালের কথা তো বললে না।’
‘মাকড়সা পেটের ভেতরকার ছয়টি গ্রন্থি থেকে একধরনের তরল বেরোয়। ঝাপসা লাগামাত্রই ওই তরল শুকিয়ে সুতোর মতো হয়ে যায়। এই গ্রন্থি থেকে সব মাকড়সার পেটেই, তবে জাল বোনে না সবাই। তবে হ্যাঁ, শুধু মেয়ে মাকড়সাই বোনে জাল। সামান্য ঝাঁকুনি কিংবা হঠাৎ বাতাসে যেন জাল ছিঁড়ে না যায়, সে জন্য খুব মজবুত করে জাল বোনে এরা। প্রথমে সঠিক জায়গা বেছে নিয়ে প্রথমে কয়েকটি সুতা টানটান করে আটকে নেয়। তারপর ভালো করে বেঁধে দেয়, যেন টানাগুলো ঠিকমতো আটকে থাকে। তারপর জালের কেন্দ্রটি ঠিক করে পেছনের পায়ের সাহায্যে কেন্দ্রের সঙ্গে আরও কতগুলো টানা দিয়ে নেয়। সবশেষে গোল করে সুতা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করে ফেলে চমৎকার জাল। ওই জালের সুতায় থাকে আঠালো এক উপাদান, যার ফলে কোনো পোমাকামড় আটকা পড়লে সহজে আর ছুটতে পারে না, পরিণত হয় মাকড়সার শিকারে।’
‘আচ্ছা, মাকড়সা নিজেদের জালে নিজেরাই আটকে যায় না কেন?’
‘মাকড়সার জালে থাকে দুই ধরনের সুতা—একটিতে থাকে ওই আঠালো উপাদান, অন্যটিতে থাকে না। মাকড়সা বেছে বেছে আঠা ছাড়া সুতোর ওপর দিয়েই হাঁটে। তারপরও ভুল করে আঠালো সুতায় জড়িয়ে গেলেও চিন্তা নেই—ওদের শরীরের ভেতরেই থাকে বিশেষ এক তেলের গ্রন্থি। ওই তেল দিয়ে সে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে।’
‘ওহ্! এ তো দারুণ ব্যাপার। ঠিক আছে, এখন আমি যাই,’ বলেই ছুট লাগায় জুনিয়র।
‘এই, কোথায় চললি এমন তড়িঘড়ি করে?’
ছুটতে ছুটতেই উত্তর দেয় খুদে, ‘টম অ্যান্ড জেরির কার্টুন শুরু হবে টিভিতে। ওটা না দেখলে পেটের জাত হজম হবে না আমার।’
ওর পিছু নিই আমিও। কী করব, আমিও যে টম অ্যান্ড জেরির বিশাল ভক্ত!
যখন আমার গায়ে গা ঘেঁষে সোফায় বসে টম-জেরির বিজ্ঞাপন বিরতিতে আছে জুনিয়র ওসমান, তখন তাকে বলি, ‘তবে বাবা, মাকড়সার ভয়ংকর কাজকর্ম শুনেই ভাবিস না যে ওদের সবটাই খারাপ। বরং ভালোর দিকটাই বেশি।’
‘ভালো দিক? কেমন?’
‘বিষাক্ত মাকড়সার সংখ্যা নগণ্য। বাকিরা অতি নিরীহ। বরং আমাদের চারপাশের ক্ষতিকারক পোকামাকড়, বিশেষ করে মশা খেয়ে ওরা আমাদের অনেক উপকার করে। বাড়িতে একটা মাকড়সা থাকা মানে ওই বাড়ির কমপক্ষে দুই হাজার পোকামাকড় তো সাবাড় করে এক বছরে! বাগানে মাকড়সা থাকলে ক্ষতিকারক পোকা খেয়ে গাছের জীবন বাঁচায় তারা। এমনকি প্রাকৃতিক বস্তুর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে মাকড়সার জাল; এই জাল দিয়ে অত্যাধুনিক প্যারাস্যুট আর বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বানানোর গবেষণা চলছে। এমন আরও কত-কী!
‘বলো কী! এত গুণ আছে এই মাকড়সার!’
‘আছে তো। তাহলে বল, নির্বিচারে একে মারা কি ঠিক?’
‘না, ঠিক না’, জবাব দেয় জুনিয়র। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝি, সত্যি কথাই বলছে সে।