ভাস্কো-দা-গামার নাম তো তোমরা জানোই। ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। সেই সময়ে সমুদ্রযাত্রা সহজ ছিল না। অথই সাগরে বারবার পথ হারিয়ে যেতে হতো। রাতের তারা, উপকূল রেখা আর মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ দেখে পথ চিনে নিতে হতো। একটু উনিশ-বিশ হলে তাতেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এ জন্য তিনি অভিযানের মাঝপথে মালিন্দি বন্দর থেকে একজন ভারতীয় নাবিককে সঙ্গে করে নেন, যাতে পথ চিনতে আর ভুল না হয়। আজ আমরাও জানি, ভাস্কো-দা-গামা ঠিক ঠিক ভারতে এসে পৌঁছেছিলেন। আরেক অভিযাত্রী কলম্বাসের মতো ভারত মনে করে, আমেরিকা মহাদেশে গিয়ে পৌঁছাননি তিনি।
এখন অবশ্য দিক কিংবা পথ চিনে নিতে আমাদের আকাশের চাঁদ, তারার ওপর নির্ভর করতে হয় না। সবার মোবাইল ফোনেই আছে গুগল ম্যাপ, সেটা দিয়ে দিব্যি চিনে নেওয়া যায়।
আমরা না হয় মোবাইলে গুগল ম্যাপ দেখে পথ চিনতে পারি। কিন্তু পোষা বিড়াল বা কুকুর হারিয়ে গেলে কিংবা দূরে কোথাও রেখে এলে কী করে ঠিক ঠিক বাড়িতে ফিরে আসে? তারা তো আর আমাদের মতো মোবাইলে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে না! শুধু পাড়ার মাঠ নয়, কয়েক হাজার মাইল দূর থেকেও পথ চিনে ফিরে আসে!
কী, কয়েক হাজার মাইলের কথা শুনে বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে আশ্চর্য কুকুর নামে পরিচিত ববি দ্য ওয়ান্ডার ডগের ঘটনা শোনো। একবার তার মালিক যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা রাজ্যে ঘুরতে গেছে। সঙ্গে তাকেও নিয়ে গেছে। একপর্যায়ে দেখা গেল, ববিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কই গেল? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না ববিকে। একপর্যায়ে তার মালিক বাধ্য হয়ে তাকে রেখেই চলে এল ওরিগনের নিজ বাড়িতে। এর মাঝে কেটে গেল ছয় মাস। একদিন হঠাৎ দেখা গেল ববি ফিরে এসেছে বাড়িতে। তাদের বিস্ময় আর ফুরায় না!
বিস্মিত হওয়ারই কথা। কারণ, ইন্ডিয়ানা থেকে ওরিগনের দূরত্ব দুই হাজার মাইলেরও বেশি। ঠিক ঠিক করে বললে ২ হাজার ৫৫১ মাইল। ববিকে পাড়ি দিতে হয়েছিল মরুভূমি, পর্বতের মতো পাহাড়ি এলাকাও। এহেন কীর্তির কারণে তাকে নিয়ে পরে সিনেমাও বানানো হয়েছে। সেই সিনেমার নাম দ্য কল অব দ্য ওয়েস্ট। অনেক আগের সিনেমা। নির্বাক ছবির আমলের। চাইলে দেখে নিতে পারো।
ববির ঘটনা তো গেল, এবার প্রিন্সের ঘটনা বলি। প্রিন্স নাম শুনে ভাবছ কোথাকার রাজা-বাদশাহর ছেলে বুঝি! মোটেও তা নয়! সে এক আইরিশ কুকুর। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। প্রিন্সের মালিক একজন সৈনিক। ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন। যুদ্ধে তাঁর পোস্টিং হলো ফ্রান্সে। প্রিন্সকে বাড়িতে রেখে গেলেন ওই সেনা। প্রিন্স ছিল খুবই প্রভুভক্ত। তাই একদিন দেখা গেল, প্রিন্স খুঁজে খুঁজে ঠিকই হাজির হয়েছে ফ্রান্সে। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্রিন্স কী করে ফ্রান্সে গিয়েছিল, সেটা আজও বিস্ময় সবার কাছে।
কুকুরের কথা তো শুনলে। এবার তাহলে হাউই নামের এক বিড়ালের কাহিনি শোনো। অস্ট্রেলিয়ার হিক দম্পতি একবার ঠিক করলেন ঘুরতে যাবেন। আশপাশে কোথাও নয়। দূরের কোনো দ্বীপে। সে জন্য পোষা বিড়ালটিকে এক আত্মীয়ের বাসায় রেখে এলেন। সেই আত্মীয়ের বাসা এক হাজার মাইল দূরে। তো, তারা এক মাস বাইরে থেকে ঘুরে এসে সেই আত্মীয়ের কাছ থেকে শুনতে পেলেন দুঃসংবাদটি। তাদের প্রিয় বিড়াল সেই বাড়ি থেকে পালিয়েছে। এর মধ্যে বছর কেটে গেল। হিক দম্পতির মেয়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়ির সামনে একটি বিড়াল দেখতে পেল। ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। একটু ভালো করে দেখতেই বুঝতে পেল সে আর কেউ নয়, হাউই।
কুকুর, বিড়াল যে বাড়ি চিনে ফিরে আসতে পারে, সেটা আমরাও জানি। তাই বলে এত লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসবে? বিজ্ঞানীদের কাছেও এটা একটা বিস্ময়! তারা এখনো এর কূলকিনারা সঠিকভাবে বের করতে পারেননি। টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বনি বেভারের মতো কিছু কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য বলছেন, কুকুরের আছে অসাধারণ ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা। তারা একবার যে পথ দিয়ে গেছে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেই পথ দিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে।
কুকুরের মতো বিড়ালেরও আছে গন্ধ শোঁকার ক্ষমতা। এবং সেটা তোমার-আমার চেয়ে অনেক বেশি। একজন সাধারণ মানুষ যেখানে পাঁচ মিলিয়ন গন্ধ চিনে নিতে পারে। সেখানে একটি বিড়াল পারে ১৯ মিলিয়ন পর্যন্ত। তা ছাড়া পথ চিনে নেওয়ার কাজে বিড়াল পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে। বিড়ালের কানে আছে একধরনের আয়রন, যা তাকে চৌম্বক নির্দেশনা পেতে সহায়তা করে। আশপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ, শব্দ মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত করেও দিক চিনে নিতে পারে তারা।
আমরা যেমন কাউকে কোনো জায়গা চেনাতে গিয়ে বলি, ওই যে মোড়ের চায়ের দোকান আছে না, তার পেছনের গলিতেই বাসা। তেমনি কুকুর, বিড়ালও এ রকম ল্যান্ডমার্ক মনে রাখতে পারে। এই ভিজ্যুয়ালাইজিং লোকেশন স্ট্র্যাটেজির মাধ্যমেও তারা পথ চিনে নেয়।
শুধু কুকুর, বিড়াল নয়, পরিযায়ী পাখি, যাদের আমরা অতিথি পাখি বলি, প্রতিবছর শীতের সময়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে, তারাও পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের উত্তর-দক্ষিণ লাইন ব্যবহার করে পথ চিনে নিতে পারে। পায়রা বা কবুতর দিয়ে চিঠি পাঠানোর কথা তো জানোই। তারাও নির্দিষ্ট ঠিকানায় চিঠি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতে পারে। তাদের ঠোঁটে লুকিয়ে আছে আয়রন, যা দিয়ে তারা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বুঝে পথ চিনে নেয়।