জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীত, ধূসর কুয়াশার চাদর ভেদ করে সদ্য আলো ফুটেছে। ভারি মিষ্টি সে আলোর পরশ। ছেলেমেয়েরা সাতসকালেই স্কুলে বই-খাতা নিয়ে হাজির। নব্বইয়ের দশকের সেই মোবাইল-কম্পিউটারহীন গ্রামবাংলার স্কুলগুলোই বিনোদনের প্রধান কেন্দ্র ছেলেমেয়েদের কাছে। সদ্য হাইস্কুলে উঠলে সেই স্কুল যেন আরও মধুর হয়ে ওঠে। নিজেকে কেমন যেন বড় বড় লাগে। সেই ভাবনার সঙ্গে নতুন বইগুলো নতুন পৃথিবীর অবারিত দ্বার খুলে দেয়। প্রাইমারিতে বাংলা বইটাই সবচেয়ে মধুর ছিল। কত্ত কত্ত ছড়ার সমাহার। হাইস্কুলে উঠে যোগ হয় চারুপাঠ নামে নিছক গল্প-কবিতার নতুন আরেকটি বই। তবু বাংলা বইতেই যেন রাজ্যের আকর্ষণ ছেলেমেয়েদের। সম্পূর্ণ নতুন স্বাদের লেখা রয়েছে যে! ‘সাগর জলের নানা প্রাণী’—এমন অদ্ভুত লেখা তো ওরা আগে পড়েনি! কী বলছেন লেখক—সাগরের তলদেশে নাকি একধরনের মাছ আছে, যারা আলো জ্বালতে পারে, বিদ্যুতের শক দিতে পারে শত্রুদের গায়ে। আবার কিছু কিছু রাক্ষুসে প্রাণী নাকি খেয়ে ফেলতে পারে তার দ্বিগুণ ওজনের প্রাণীকে! একটা তিমি মাছের কলিজার ওজন দুই টন! এক লহমায় ছেলেমেয়েদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে ধরা দিল সাগরের রহস্যপুরী।
এখানেই শেষ নয়। পরের বছর পরের ক্লাসে সেই একই লেখক শোনাচ্ছেন ‘মহাবন আমাজন’-এর গল্প। সঙ্গে মন কেড়ে নেওয়া এক রেখাচিত্র। রহস্যময় একটি বন, তার বুক চিরে বেরিয়ে গেছে বিশাল এক নদী। সেই বনের গাছের ডালে কত পাখি, কত রকম জন্তু–জানোয়ার। একটা মহা ইগল তার নখরে বিঁধিয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে আস্ত একটা বানরকে। সে যুগের ছেলেমেয়েদের মন হরণ করার জন্য ওই একটা স্কেচই যথেষ্ট। কিন্তু ছবি দেখে পড়ার আগ্রহটা বাড়ে, এক লাইন, দুই লাইন করে যখন ভেতরে ঢোকে লেখাটার, তখন যেন মনে হয় আমাজানের এই জাদুবাস্তবতা তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের সেই রূপকথার জগৎকেও হার মানায়। যেমন লেখার ভঙ্গি, তেমনি দুর্দান্ত সব সত্যি গল্পে ঠাসা গদ্য—আবদুল্লাহ আল–মুতী নামের সেই লেখক এক ঘোরলাগা শৈশব উপহার দিয়েছেন সেকালের ছেলেমেয়েদের।
আজকের এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হাতের মুঠোফোনটা ছুঁয়েই সারা বিশ্বের হালের খবর এমনকি ছবিও পেয়ে যাচ্ছ তোমরা। একেবারে নিভৃত পল্লি বলে কিছু নেই এই যুগে। কিন্তু সেকালের ছেলেমেয়েদের কথা ভাবো। তখন গ্রামে প্রযুক্তিপণ্য বলতে শুধুই রেডিও। টেলিভিশন হয়তো কারও কারও বাড়িতে আছে, কিন্তু তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেই যুগে সেই নিভৃত পল্লিতে বিজ্ঞানের আলো জ্বেলেছেন আবদুল্লাহ আল–মুতী। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি তাঁর আগেও বাংলা ভাষায় অনেকেই করেছেন, কিন্তু একমাত্র সুকুমার রায় ছাড়া আর কারও লেখা কিশোরদের বোধগম্যের গণ্ডিতে পৌঁছায়নি। আর এপার বাংলায় সম্ভবত তিনিই বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ। অথচ তাঁর প্রথম জীবনের গল্পটা ছিল অন্য রকম।
আবদুল্লাহ আল–মুতীর জন্ম ১৯৩০ সালের ১ জানুয়ারি, সিরাজগঞ্জের ফুলবাড়ি গ্রামে। বাবার নাম শেখ মইন শরফুদ্দিন। মা হালিমা শরফুদ্দিন। পঁাচ ভাই আর ছয় বোনের এক বিশাল পরিবার ছিল আবদুল্লাহ আল–মুতীর। তবে বেশ সচ্ছল পরিবার। পড়াশোনা করেন ঢাকার মুসলিম হাইস্কুলে। ১৯৪৫ সালে এখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এখন যেটাকে বলে এসএসসি। তখন ঢাকায় শিক্ষা বোর্ড ছিল না। কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনেই পরীক্ষা দিতে হতো। তাহলে কতটা অঞ্চলজুড়ে কলকাতা বোর্ডের বিস্তার ছিল ভেবে দেখো। সেই বোর্ড থেকেই কিনা আবদুল্লাহ আল–মুতী দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন ম্যাট্রিকে। এরপর ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়)। সে বছরেই জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে চালানো হয় নারকীয় মার্কিন পারমাণবিক বোমা হামলা। সেই হামলার পর পারমাণবিক বোমা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখলেন মুতী। সেটা ছাপা হলো কলেজের বার্ষিকীতে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন বোস। তাঁর নজরে পড়ল সেই প্রবন্ধটা। সেই লেখার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ড. বোস। সেই শুরু মুতীর বিজ্ঞান লেখালেখির।
সাতচল্লিশে আবদুল্লাহ আল–মুতী আইএ পাস করলেন ১১তম স্থান নিয়ে। এরপর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিজ্ঞানে। জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী আন্দোলনে। পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হয়ে জেল খাটেন দুই দফায়। ১৯৪৮ ও ১৯৫৪ সালে। ১৯৫২ সালে স্নাতক।সাতচল্লিশে আবদুল্লাহ আল–মুতী আইএ পাস করলেন ১১তম স্থান নিয়ে। এরপর ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পদার্থবিজ্ঞানে। জড়িয়ে পড়লেন বামপন্থী আন্দোলনে। পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হয়ে জেল খাটেন দুই দফায়। ১৯৪৮ ও ১৯৫৪ সালে। ১৯৫২ সালে স্নাতক।
তখন ভাষা আন্দোলনের গর্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যোগ দিলেন সেই আন্দোলনে। প্রচারপত্র ছাপার কাজও করলেন। সেই উত্তাল দিনে স্নাতক পাস করলেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ফল খারাপ! পরের বছর আবার দিলেন পরীক্ষা। এবার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ১৯৫৪–তেই রাজশাহী কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর বৃত্তি নিয়ে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করলেন ১৯৬০ সালে, শিক্ষা বিষয়ে। একই বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করলেন ১৯৬২–তে। তারপর ফিরে এলেন এলেন দেশে।
দেশ স্বাধীনের পর ড. কুদরাত–এ–খোদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু সরকার। নতুন সেই শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন মুতী। ১৯৭৫ সালে যুগ্ম সচিব হয়ে যোগ দিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এরপর দায়িত্ব পান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের। সেখানেই একসময় পূর্ণ সচিবে উন্নীত হন। ১৯৮৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
শুধু সরকারি আমলা হয়েই বসে থাকেননি আবদুল্লাহ আল–মুতী। এ দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে তিনিই ছিলেন অগ্রদূত। লিখেছেন এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে, অবাক পৃথিবী, আবিষ্কারের নেশায়, রহস্যের শেষ নেই, জানা-অজানার দেশে, সাগরের রহস্যপুরী, আয় বৃষ্টি ঝেপে, মেঘ বৃষ্টি রোদ, তারার দেশের হাতছানি, বিজ্ঞানের বিস্ময়, কীটপতঙ্গের বিচিত্র জগৎ, মহাকাশে কী ঘটছে–এর মতো বিখ্যাত সব বই। বিজ্ঞানসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু একাডেমী পুরস্কারসহ ইউনেসকোর কলিঙ্গ পুরস্কার।
১৯৯৮ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের জনপ্রিয় বিজ্ঞানসাহিত্যের এই পুরোধা মৃত্যুবরণ করেন।