সারাহর দেওয়া উপহারের চেয়ে সুন্দর উপহার আর কী হতে পারে
মৃত্যুর আগে সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে, নাম লিখিয়ে গেছে ইতিহাসে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বুধবার রাতে। এই কিডনি দান করে গেছে সারাহ। লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়ার পর রাত সাড়ে ১০টা থেকে বৃহস্পতিবার ভোররাত ৪টা পর্যন্ত দুটি কিডনির একটি প্রতিস্থাপন করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ); অন্যটি প্রতিস্থাপন করা হয় কিডনি ফাউন্ডেশনে। সারাহ দান করে গেছে কর্নিয়াও।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত রাতে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচারের নেতৃত্ব দেন বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, সারাহর মা জানিয়েছিলেন, সারাহ মৃত্যুর আগে তার দেহের সবকিছুই দান করে দিতে বলেছিল। তবে তাঁর শুধু কিডনি ও কর্নিয়া নেওয়া হয়েছে। হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘সারাহকে বীরের মর্যাদা দেওয়া উচিত। মরণোত্তর কিডনি দানে উদ্বুদ্ধ করতে এই দান মানুষের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
করোনার কারণে কিশোর আলোর অফলাইন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সারাহ ঐশ্বর্য কিশোর আলোর নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবক ছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে কিশোর আলোর সঙ্গে তার পথচলা শুরু। কিআর মাসিক সভা কিআড্ডায় এসেছিল সে। তারপর ধীরে ধীরে কিশোর আলো পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। কাজ করে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। সারাহ আঁকতে ভালোবাসত। অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি আর হলি ক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি দেওয়ার পর সারাহ তাই ভর্তি হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা বিভাগে।
টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামক খুব জটিল একটি রোগে আক্রান্ত ছিল সে। এই রোগ ভালো করার কোনো উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে যন্ত্রণাদায়ক এই রোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হতো তাকে। তারপরও নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করতে করতে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু ১০ জানুয়ারি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার মস্তিুষ্কের টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় বিএসএমএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেখানে তাকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে।
পরিবারসূত্রে জানা যায়, বুধবার, ১৮ জানুয়ারি রাত ১০টায় তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। রোগশয্যায় থেকেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করার ইচ্ছা মাকে জানিয়েছিল সারাহ। সেই সূত্রেই, তার দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া চার ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করেছেন দেশের চিকিৎসকেরা।
গেল সোমবার হাসপাতালে কথা হচ্ছিল সারাহর মায়ের সঙ্গে। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘সারাহ বাসা থেকে যে টাকা নিত, তা নিজের জন্য খরচ করত না। খরচ করত অন্যকে উপহার দিতে। সারাহ ‘স্যান্টা ক্লজ’ হতে চাইত।’
উপহার দিতে সত্যিই খুব পছন্দ করত সারাহ। আর সেজন্যই বোধহয় মৃত্যুর সময়ও উপহার দিয়ে যেতে ভুলে যায়নি সে। সারাহ চলে গেলেও তার দেওয়া কিডনি নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ পাচ্ছেন দুজন মানুষ। আর সারাহর দান করা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর আরও দুজন পৃথিবীটাকে দেখতে পারছেন নতুন করে।
পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য এর চেয়ে সুন্দর উপহার আর কী হতে পারে!
সারাহর জন্য ভালোবাসা।