বৈদ্যুতিক বাতি আসলে কার আবিষ্কার
বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারক কে? এই প্রশ্নের উত্তরে সাধারণভাবে সবার মনে একটা নামই আসবে—টমাস আলভা এডিসন। বৈদ্যুতিক বাতির জনক হিসেবে মার্কিন বিজ্ঞানী এডিসন স্বীকৃতি পেয়েছেন ১৮৭৯ সালে। কিন্তু তার আগপর্যন্ত কেউ কি বাতি আবিষ্কারের চেষ্টা করেননি? কিংবা চেষ্টা করে সফল হননি?
উত্তরটা হলো, হ্যাঁ। টমাস আলভা এডিসনের আগেও বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন অনেকে। এমনকি সফলও হয়েছেন কেউ কেউ। তাহলে কেন তাঁদের স্বীকৃতি না দিয়ে দেওয়া হলো এডিসনকে?
যে কয়েকটা আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে সামনে এগিয়ে যেতে সরাসরি সাহায্য করেছে, বৈদ্যুতিক বাতি তার অন্যতম। বৈদ্যুতিক বাতি আসার পর মানুষ বুঝতে পারে, শুধু দিনে নয়, নিরাপদে কাজ করা সম্ভব রাতেও (বাতি আবিষ্কারের আগে আগুন জ্বালিয়ে কাজ করতে হতো রাতের বেলা, যা তুলনামূলক বিপজ্জনক)। বর্তমান সময়ে এসে কথাটা হাস্যকর মনে হলেও তখনকার দিনে বিষয়টি ছিল যুগান্তকারী। বৈদ্যুতিক বাতি মানুষের জীবন কতটা সহজ করেছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে বিতর্ক আছে এর আবিষ্কারক নিয়ে। কারণ, বাতি আবিষ্কারের পেছনে অবদানটা শুধু এডিসনের, বিষয়টা এমন নয় মোটেও।
একটু পেছনে যাওয়া যাক। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কৃত হয় বিদ্যুৎ। উনিশ শতকের শুরুতে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা বের করেন বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করে তিনি আবিষ্কার করেন ‘ভোলাটিক পাইল’, যা কার্যত একটি ব্যাটারি। ভোলাটিক পাইল ব্যবহার করে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রি ডেভি একটি ‘আর্ক ল্যাম্প’ বা ‘ব্যাটারিচালিত বাতি’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। ডেভি এই বাতি আবিষ্কার করেন ১৮০৬ সালে, এডিসনের প্রায় ৭০ বছর আগে! তবে সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। ডেভি যে বাতিটি আবিষ্কার করেছিলেন, তা ছিল খুব বেশি উজ্জ্বল। পাশাপাশি এটি কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। আবার বাতিটি অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুতের বিনিময়ে জ্বলছিল খুব কম সময় ধরে। ফলে গৃহস্থালি কাজে বাতিটি ছিল ব্যবহারের অনুপযোগী।
একই সঙ্গে দিনরাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন অন্যরাও। স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস বাউম্যান ১৮৩৫ সালে কপার-ফিলামেন্টের একটি বাল্ব আবিষ্কার করেন। আবার প্লাটিনাম-ফিলামেন্টের বাল্ব আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ওয়ারেন ডে লা রু। কিন্তু বাউম্যানের বাল্বটি পুড়ে যেত খুব দ্রুত, আর ওয়ারেনেরটি তৈরি করা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। সমস্যা ছিল আরও। তখনো ঠিকমতো আবিষ্কৃত হয়নি ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তি। ভ্যাকুয়াম টিউব এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে কোনো স্থান থেকে বাতাস পুরোটা বের করে ফেলা যায়। এই প্রযুক্তি না থাকায় বাল্বগুলোর ভেতরটা বায়ুশূন্য করা যাচ্ছিল না। আর এ জন্য বাল্বও বেশি সময় ধরে জ্বলছিল না।
তবে পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও পূর্ণাঙ্গ বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করা ছিল তখন সময়ের ব্যাপার, এ বিষয়ে দ্বিমত ছিল না কারোরই।
এমনই এক সময় আবির্ভাব হয় টমাস আলভা এডিসনের। অন্যদের আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হয়ে রাতদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, পরিপূর্ণ একটি বাল্ব আবিষ্কার করতেই হবে। একের পর এক পরীক্ষার পর এডিসন ১৮৭৮ সালের দিকে উচ্চরোধসম্পন্ন কটন ফিলামেন্টের একটি বাল্ব আবিষ্কার করেন, যা টানা ১৪ ঘণ্টা জ্বলতে সক্ষম ছিল। এর ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৭৭ সালে চলে আসে আধুনিক ভ্যাকুয়াম টিউব প্রযুক্তি, যা ব্যাপকভাবে এডিসনকে সাহায্য করে। বাল্বটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের উপযোগী, এমন প্রমাণ পেয়ে আর দেরি করেননি এডিসন, স্বত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করে বসেন ১৮৭৯ সালে। এক বছর পর ১৮৮০ সালের জানুয়ারি মাসে বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিষ্কারক হিসেবে স্বত্ব পেয়ে যান টমাস আলভা এডিসন।
এডিসন ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের জন্য। এডিসন যে সময়টায় স্বত্ব পেয়েছেন, ঠিক একই সময়ে মার্কিন-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হিরাম ম্যাক্সিমও ছুটছিলেন স্বত্বের পেছনে। তবে তাঁর আগেই পেয়ে যান এডিসন। হিরাম ম্যাক্সিমকে তোমরা অনেকেই চেনো। যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যতম কার্যকরী অস্ত্র ‘অটোমেটেড মেশিনগান’-এর আবিষ্কারক তিনি। এখনো মজা করে অনেকে বলেন, বাল্ব আবিষ্কারের স্বত্ব না পেয়ে হিরাম এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে আবিষ্কার করে বসেছেন মেশিনগান।
টমাস আলভা এডিসনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ধরা হয় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ সোয়ানকে। তিনিও বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করে কার্বনের তৈরি ফিলামেন্টের মাধ্যমে। ১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যে পেয়ে যান এর স্বত্বও, এডিসনের স্বত্ব পাওয়ার ঠিক ১১ মাস পর। এডিসনের কটন ফিলামেন্টের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় সোয়ানের কার্বন ফিলামেন্টের বাল্ব। এমনকি লন্ডনের স্যাভয় থিয়েটার আলোকসজ্জা করা হয় জোসেফ সোয়ানের বাল্ব দিয়ে। স্বত্ব চুরির অভিযোগে ব্রিটিশ আদালতে মামলা করে বসেন এডিসন। কিন্তু মামলায় জিতে যান সোয়ান। পরে বিবাদ মেটাতে দুজন মিলে যুক্তরাজ্যে ‘এডিসোয়ান’ নামের একটি বাল্ব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দেন, যা দারুণ ব্যবসা করে।
তাহলে বৈদ্যুতিক বাল্বের আবিষ্কারক হিসেবে শুধু টমাস আলভা এডিসনের নামটাই কেন আসে? এ নিয়ে কথা বলেন মেরিল্যান্ড কলেজ পার্কের ইমেরিটাস অধ্যাপক রবার্ট ফিডেল, ‘সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব, এমন বৈদ্যুতিক বাল্ব সবার আগে টমাস আলভা এডিসনই আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। বাল্বটি যেন খুব কম খরচে অনেকক্ষণ ধরে জ্বলতে পারে, এডিসন জোর দেন এ বিষয়টির ওপর। তাঁর আগে যাঁরা বাতি আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁদের কারও বাল্বেই এসব গুণ একসঙ্গে ছিল না। এডিসনের আবিষ্কার তাই সবার চেয়ে আলাদা।’
এ জন্যই টমাস আলভা এডিসন স্বীকৃতি পেয়েছেন বৈদ্যুতিক বাতির জনক হিসেবে। তবে বাল্ব আবিষ্কারের পেছনে এডিসন ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম। তাঁদের দেখানো পথে হেঁটেই সফল হয়েছেন এডিসন।