ঈদের সকালে বোমার আঘাতে মারা যেতে পারতাম
ঈদ এলেই মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। রোজার বিকেলে আমাদের কাজ ছিল, গাছের ডালের দাঁতন বা মিসওয়াক নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বেরিয়ে পড়া। আমাদের রংপুরের কটকিপাড়ার বাসা থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে যেতাম এয়ারপোর্টে, ১৯৭১ সালে রামপুরা থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত একটা বিমানপোত বানানো হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সেটা অব্যবহৃত পড়ে থাকত সারা বছর, মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টার নামত। তারপর সেখানে স্তূপ করা হলো পাথরখণ্ড, রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়ক বানানো হবে বলে। আমরা সেই পাথরের পালার ওপর গিয়ে বসতাম। ২৯ রমজানে বিকেল হয়েছে কি হয়নি, আমরা চলে যেতাম সেই ফাঁকা জায়গায়। পাথরের টিলার ওপর চড়ে বসে পশ্চিম আকাশে চাঁদ খুঁজতাম। ২৯ রোজার সন্ধ্যায় যে আগে চাঁদ দেখতে পেত, তাঁর আনন্দ আর গৌরব ছিল আলাদা। সে আবার আঙুল উঁচিয়ে দেখাত, ওই যে, ওই যে...! আমি দেখতে পেতাম সবার শেষে, খুব হালকা সাদা মেঘের রঙে আঁকাবাঁকা একটা চাঁদ। দেখার সঙ্গে সঙ্গে মন গেয়ে উঠত: ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।
কাছের মসজিদ থেকে ঘোষণা আসত, পবিত্র শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেছে। আগামীকাল ঈদুল ফিতর। ঈদ মোবারক। ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল...পাড়ার ছেলেরা মিছিল বের করত, ‘আজকে মোদের কিসের খুশি, ঈদের খুশি ঈদের খুশি।’ ১৯৭২/৭৩ সালে কুড়িয়ে পাওয়া বোমার টুকরা আগুনের পালায় ধরে পটকা ফোটানোর কাজটাও আমরা সেরে নিয়েছি। এই পটকা ফোটানোর জন্য ১৯৭২ সালে বোমার টুকরা ব্যবহার করেছিলাম, সেই কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে শরীর শুকিয়ে আসে।
তখন আমার বয়স ৬ কি ৭ বছর। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন। ঈদ এসে গেছে। আমরা ঈদের দিন খুব ভোরবেলা হাজির হলাম পিটিআই নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটার মাঠে। এটা আমারও স্কুল। সেই স্কুলের দেয়ালে অনেক বোমার টুকরা গাঁথা আছে। ১৯৭১ সালে রংপুরের বিমানঘাঁটিতে ভারতীয়রা বিমান থেকে বোম্ ফেলেছিল। এয়ারপোর্টের পাশে দুটো পুকুর হয়ে গিয়েছিল বোমার আঘাতে।
তো ১৯৭২ সালের ঈদের ভোরে আমরা, ছোটদের দল, দুষ্টু ছেলের দল, করলাম কী, দেয়ালে গাঁথা বোমার স্প্লিন্টারগুলো দেয়াল হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করলাম। তারপর মাঠের মাঝখানে শুকনা পাতা, কাগজ, গাছের ডাল, খড় জোগাড় করে বানালাম স্তূপ। সেই পালায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে বোমার টুকরাগুলো একটা একটা করে আগুনের মধ্যে রাখতে শুরু করে দিলাম। দ্রুম দ্রুম করে সেসব শেল ফাটতে লাগল। আমরা সেই আগুন ঘিরে হইহই করছি, হাততালি দিচ্ছি। কী ভীষণ মজা!
অথচ সেই বোমার টুকরার আঘাতে আমরা মারা যেতে পারতাম। আমাদের একজন সহপাঠী বন্ধু কিন্তু বোমার আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছিল। সে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল একটা গোল চাকা। বাড়িতে এনে সেটার মাঝখানে পেরেক পুঁতে সে গাড়ি বানানোর চেষ্টা করছিল। যেই না পেরেক ঠুকেছে, অমনি বোমা বিস্ফোরিত হয়ে গিয়েছিল। তার একটা চোখ, একটা আঙুল উড়ে গিয়েছিল। সেই বন্ধু এখন বড় হয়ে গেছে, বেঁচে আছে এবং ভালোই আছে। বড় কর্মকর্তা হয়েছে।
আমাদের দুটো ইস্ত্রি ছিল, একটা তাওয়ার মতো, চুলার আগুনে ধরতে হতো; আরেকটার পেটে ছিল খোড়ল, তাতে জ্বলন্ত কাঠকয়লা ভরতে হতো। আমাদের মাড় দেওয়া সুতির পাঞ্জাবি আর পায়জামাগুলোয় পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে ইস্ত্রি করার কাজটাও সারা হয়ে গেছে। বাসায় ঈদসংখ্যা এসে গেছে, বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার। রশীদ করিম, সৈয়দ শামসুল হক, তারপর এলেন হুমায়ূন আহমেদ। উফ, ঈদসংখ্যা নিয়ে সেকি কাড়াকাড়ি!
আব্বার সঙ্গে বাজারে গিয়ে দুই-তিন ব্যাগ ভর্তি করে ঈদের বাজারও আনা হতো রিকশা করে। চাঁদরাতে রান্নাঘরের আশপাশে মসলা পেষার শব্দ, ঘিয়ে ঢালা সেমাইয়ের গন্ধ। চানরাতে ঘুমুতে যেতাম তাড়াতাড়ি, যাতে ঈদটা তাড়াতাড়ি আসে। ঈদের রাতে ঘুমুতে যেতে চাইতাম না, ঈদটা ফুরিয়ে যাচ্ছে যে! ঈদের রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় মনখারাপের মধ্যে পেতাম মেজ ভাইয়ের সান্ত্বনা, রোজার ঈদের দুই মাস দশ দিন পরই তো কোরবানির ঈদ আসবে, কিন্তু কোরবানির ঈদের পর আরও দশ মাস!
ঈদের ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে জেগে উঠতাম। সকাল সকাল গোসল সেরে নাও। রংপুরের বিখ্যাত শীতের সকালে গোসল করাটা ছিল বেশ সাহসিকতার ব্যাপার। টিউবওয়েলের পানি উষ্ণতর আর লাকড়ির চুলায় পাতিলে খানিকটা পানি গরমও করে নেওয়া হচ্ছে। নতুন সাবানের ফেনা মেখে চোখ বন্ধ, মাথায় পানি ঢালছি আর বইতে শুরু করেছে উত্তরের বাতাস। দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। তারপর চলো সবাই মিলে নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে কোলাকুলি। বুকে বুক মেলানোর সেকি আনন্দ!
সত্তরের দশক পেরিয়ে আশির দশকে এল টেলিভিশনের কাল। আগে রেডিওতে ঈদের নাটক শুনেছিলাম, আমজাদ হোসেনের জব্বর আলী, মেয়ে বলছে, ‘বাবা, আমাকে ম্যাক্সি কিনে দাও।’ জব্বর আলী জবাব দিচ্ছেন, ‘ট্যাক্সি! আমি তোমাকে ট্যাক্সি কিনে দিতে পারব না।’ সেই নাটক এবার দেখতে শুরু করলাম সাদাকালো টেলিভিশনে। কিছুদিনের মধ্যেই ঈদের রাতের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠল আনন্দমেলা আর নাটক। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আনিসুল হক, জুয়েল আইচ, হানিফ সংকেত, আনন্দমেলা—একটার চেয়ে আরেকটা ভালো হতো। আর ঈদের নাটক মানেই ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।
আমরা স্কুল-কলেজ ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ব বলে ঢাকায় চলে এলাম। আব্বা মারা গেলেন। একটা সময় আমরা চার ভাইবোনই পড়তাম ঢাকায়। আম্মা বলে দিলেন, ‘এক বাসে এসো না, আলাদা আলাদা বাসে এসো।’ ঈদের নামাজ সেরে আমরা চলে যেতাম কবরস্থানে, আব্বার কবর জিয়ারত করতে।
ঈদে বাড়ি যাওয়া ছিল এক ভোগান্তির নাম। এমন হয়েছে, সকাল ৭টার বাস ছেড়েছে দুপুর ১২টায়, পৌঁছেছে রাত ২টায়। মুঠোফোন ছিল না। আম্মা ধরেই নিয়েছেন, এবার আর ছেলেরা এল না। রাত দুটোয় ডোরবেল টিপতাম। আম্মা জেগেই থাকতেন। দরজা খুললেই সেই মসলামাখা শাড়ির গন্ধ, সেই হাসিমুখ, ‘এত রাত হলো!’ আমাদের পাঁচ ভাইবোনের বিয়ের পরও সবাই মিলে আমরা ঈদ করতে রংপুরে যেতাম।
এখন আব্বা নেই। এখন আম্মা নেই। আমাদের আর রংপুরে ঈদ করতে যাওয়ার দরকার হয় না। কিন্তু মনে হয়, বাংলাদেশের ঈদের সবচেয়ে সুন্দর বিশেষত্ব হলো, ঈদে বাড়ি যাওয়া, উৎসে ফিরে যাওয়া, ছেলেবেলাকে ফিরে পাওয়া। এবার তো প্রথম আলোর প্রথম পাতায় দেখছি সুখবর, ‘ঈদযাত্রায় এখন পর্যন্ত ভোগান্তি কম!’ খুলনা-বরিশালের যাত্রীরা তো তিন-চার ঘণ্টায় বাড়িতে যেতে পারবেন পদ্মা সেতু দিয়ে।
তবু ঈদে বাড়ি যাওয়াটা মিস করছি। ঢাকার ঈদের মধ্যে কেন যেন কোনো চার্ম পাই না, জোশ আসে না।
ঈদে বাড়িতে গেলে আব্বার কবরটা জিয়ারত করা যেত। আম্মা বেঁচে থাকলে তাঁর সঙ্গে সব ভাইবোন মিলে সময় কাটানোরও আনন্দ ছিল।
এখন ঢাকায় আমরা সব ভাইবোন নিশ্চয়ই বিভিন্ন বাসায় দাওয়াতে একসঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ পাব। আমার স্ত্রীও তাঁর ভাইবোনদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
আব্বাকে হারিয়েছি সেই ৩৮ বছর আগে। আম্মাকে ৩ বছর আগে। তাঁদের কথাই আজকের দিনে মনে পড়বে বেশি করে।
তাঁদের জন্য আজ তো দোয়া করার দিন।