সুপারহিরোদের সুপারহিরো

শৈশবে আমি স্ট্যান লি নামের কাউকে চিনতাম না। তবে সে বয়সে একটা কাণ্ড করতাম আমি, যখন–তখন গাছে উঠে বসে থাকতাম। মা বলত, ‘ছেলে তো হয়নি, হয়েছে বাঁদর, দিনমান শুধু গাছে গাছে ঝোলা, তোর আর নামা লাগবে না গাছ থেকে, দুই হালি কলা পাঠিয়ে দিই গাছে, ওই খেয়েই থাক!’

আমি কিন্তু মোটেই বাঁদরকে আইকন মেনে গাছে গাছে ঘুরতাম না। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাকড়সা খুঁজে বের করে সেটা নিজের হাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া, যাতে সেই মাকড়সা আমাকে কামড়ে দেয় আর সেই কামড়ে আমি হয়ে উঠি স্পাইডারম্যান।

‘স্পাইডারম্যান’–এর কমিকস পড়ে আমার স্পষ্ট ধারণা জন্মেছিল যে মাকড়সার মোক্ষম কামড় খেলে নির্ঘাত আমিও স্পাইডারম্যান হয়ে যাব! সে সময় বড় কেউ যখন নিজে ব্যাটিং করে আর আমার ব্যাটিংয়ের সময় এলে বোলিং করা বাদ দিয়ে ‘আর খেলব না’ বলে নাক উঁচিয়ে হাঁটা দিত, তখন রাগে সবুজ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতাম। কমিকস পড়ে তখন বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে চামড়া সবুজ হয়ে উঠলেই আমিও হাল্ক হয়ে যাব, আর তারপর ওদের বুঝিয়ে দেব ব্যাটিং করে সটকে পড়ার মজাটা।

কিন্তু আমার ভেতর কোনো একটা সমস্যা হয়তো ছিল, যে কারণে স্পাইডারম্যান কিংবা হাল্ক হয়ে উঠতে পারছিলাম না। তবু চেষ্টা করে যেতাম বারবার। শুধু আমি না, সারা দুনিয়ার গলি–ঘুপচি খুঁজলে হয়তো এ রকম লাখো শিশু-কিশোর পাওয়া যাবে, যারা স্পাইডারম্যান বা হাল্ক হয়ে শিক্ষা দিতে চেয়েছে শৈশবে ত্যক্ত করা মানুষকে। আয়রনম্যান, থর কিংবা ব্ল্যাক প্যান্থার হওয়ার খায়েশ জাগা ছেলেপুলের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

স্ট্যান লি
স্ট্যান লি

প্রথম লাইনে স্ট্যান লি বলে একজনের নাম বলেছি। কিন্তু কে এই স্ট্যান লি? আর স্পাইডারম্যান, হাল্ক, আয়রনম্যান কিংবা থরের মতো সুপারহিরোদের সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বা কী?

ওই সব সুপারহিরোর সঙ্গে স্ট্যান লির সম্পর্কের পরিচয় যদি এক শব্দে দিতে বলা হয় তাহলে বলা যায়, ‘বাবা’! কারণ, স্ট্যান লির হাত ধরেই জন্ম নিয়েছে কালজয়ী এসব সুপারহিরোর। যারা পরবর্তী সময়ে কমিকসের পাতা ছেড়ে শাসন করছে পুরো সিনেমাবিশ্বকেও।

কমিকস বানিয়ে সারা বিশ্বে খ্যাতি পাওয়া সব থেকে জনপ্রিয় মানুষ স্ট্যান লি। স্পাইডারম্যান, আয়রনম্যান, হাল্ক, থর, অ্যান্টম্যান, ফ্যান্টাস্টিক ফোর, এক্সম্যান, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো বিশ্ব কাঁপানো সুপারহিরোদের পাশাপাশি ছোটখাটো চরিত্র মিলিয়ে যাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সংখ্যা ৩৫০–এর বেশি।

স্পাইডারম্যান
স্পাইডারম্যান

পুরো নাম স্ট্যান লি মার্টিন লিবার। সারা দুনিয়ায় স্ট্যান লি নামেই জনপ্রিয় লোকটি জন্মেছিলেন নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে, ১৯২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই। রোমানিয়ার অধিবাসী বাবা পেশায় ছিলেন দরজি। স্বভাবতই স্ট্যান লির ছোটবেলাটা কেটেছে চরম দারিদ্র্যে। ছেলেবেলার কথা স্মরণ করতে গিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘বাবাকে বেশির ভাগ সময়েই বেকার থাকতে দেখতাম, বাসা ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে না পেরে অধিকাংশ সময়েই পাংশু মুখে বসে থাকতে দেখতাম বাবা-মাকে, যে কারণে স্কুলে পড়ার সময়েই আমাকে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল।’

এক আত্মীয়ের বদৌলতে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘টাইমলি কমিকস’–এ কাজ পান লি। কাজ বলতে তিনি সে সময়ে যা করতেন তা হলো, আঁকিয়েদের দোয়াতের কালি ভরা, দুপুরের খাবার এনে দেওয়া, প্রুফ দেখা, আঁকা হয়ে গেলে পেনসিলের দাগ মুছে ফেলা—এ রকম ছোটখাটো কাজ আরকি।

এর দুই বছর পর ১৯৪১ সালের মে মাসে প্রথমবারের মতো কমিকস লেখেন স্ট্যান লি, ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’ সিরিজের ৩ নম্বর কমিকস ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা ফয়েলস দ্য ট্রেইটরস রিভেঞ্জ’। এই কমিকসের জন্যই তিনি প্রথম স্ট্যান লি নামটি ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এই নামেই।

ওই বছরেই টাইমলি কমিকসের সম্পাদক চাকরি ছেড়ে দিলে কিছুটা বাধ্য হয়েই টাইমলি কমিকসের প্রকাশক সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করেন স্ট্যান লিকে, স্ট্যান লির বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। সেই থেকেই শুরু স্ট্যান লির। এরপর টানা বছর বিশেক কমিকস লিখে একসময় হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি।

বছর চল্লিশেক বয়সে তিনি হুট করে সিদ্ধান্ত নেন, ছুটি নেবেন। প্রকাশকদের পছন্দ অনুযায়ী গৎবাঁধা গল্প লিখতে লিখতে তিনি ক্লান্ত। স্ত্রীর পরামর্শে নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেন লি।

এরপর স্ট্যান লি যেসব চরিত্র তৈরি করেন, তার সব কটি চরিত্রই বর্তমান কমিকস এবং সিনেমাজগৎ রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

১৯৬১ সাল। কমিকস জগৎজুড়ে ‘ডিসি কমিকস’–এর একচ্ছত্র আধিপত্য। সুপারহিরো বলতেই ‘ডিসি’র ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, গ্রিন ল্যান্টার্ন, ফ্ল্যাশ। স্ট্যান লি তখন জীবনের প্রথম কাজ শুরু করা টাইমলি কমিকসের নাম বদলে রাখলেন ‘মার্ভেল কমিকস’। প্রকাশ করলেন ফ্যান্টাস্টিক ফোর। তাতেই সাড়া পড়ে যায় কমিকস–বিশ্বে, ‘ডিসি কমিকস’–এর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মার্ভেল কমিকসের নাম।

ফ্যান্টাস্টিক ফোরের পেছন পেছনে একে একে বাজারে আসতে শুরু করে স্ট্যান লির হাল্ক, থর, আয়রনম্যান, এক্সম্যান, ডেয়ারডেভিল, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ এবং সব থেকে জনপ্রিয় স্পাইডারম্যান। এরপর আর ‘মার্ভেল’ এবং স্ট্যান লিকে ফিরে তাকাতে হয়নি, ‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’ প্রকাশের মাধ্যমে তো তিনি গোটা কমিকস–বিশ্বকেই তাক লাগিয়ে দেন।

বহুদিন ধরে বাজার ধরে রাখা ‘ডিসি কমিকস’–এর ব্যাটম্যান, সুপারম্যানদের হটিয়ে কমিকস–বিশ্বে দাপট দেখাতে শুরু করা স্পাইডারম্যান, হাল্করা এত জলদি কীভাবে দর্শকদের মনকে জয় করে নিল, সে প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে আছে স্ট্যান লির কমিকসের প্রতিটি গল্পেই। স্ট্যান লি চাইলেন তাঁর সুপারহিরোদের গল্পগুলো হোক একটু আলাদা, হাতে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি শক্তি থাকার পরও তাঁর প্রতিটি সুপারহিরোই হোক আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই, বাস্তবতার কশাঘাতে পিষ্ট। আর দশটা মানুষের মতোই তাদেরও দুর্বলতা থাকুক, থাকুক যন্ত্রণা, থাকুক প্রেম, সঙ্গে অভিমানও।

তাই স্ট্যান লির সুপারহিরোরা সুপার পাওয়ার নিয়েও বেকারত্বে জর্জরিত, কেউ কলেজের সিলেবাসের চাপে নাজেহাল তো কেউ প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করে তটস্থ—এমনকি তাঁর বানানো সুপারহিরোরা সর্দি-কাশির মতো ছোটখাটো অসুখ থেকেও ছাড় পায় না। এসবের বাইরে স্ট্যান লির কমিকসে যেমন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার গল্প আছে, তেমনি আছে দেশাত্মবোধের প্রাধান্য। আবেগধর্মী গল্পের মারপ্যাঁচের ভেতর রসে টইটম্বুর হিউমারেরও একরত্তি কমতি নেই স্ট্যান লির কমিকসগুলোয়।

বাস্তবতার আর সব সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হাসি-মজার মাধ্যমে নিজেকে টিকিয়ে রাখা স্ট্যান লির এসব সুপারহিরোর গল্পের সঙ্গে পাঠকেরা নিজেদের আত্মিক সম্পর্ক খুঁজে নিতে দেরি করেন না। ফলে এই সুপারহিরোরা সবার মনে আলাদা জায়গা করে নিতে সময় নেয় না মোটেই। এতে পাল্টে যায় গোটা কমিকস–বিশ্বই, বদলে যায় কমিকসের গতানুগতিক ধারাও।

স্ট্যান লির সুপারহিরোরা কমিকস ছেড়ে রুপালি পর্দায় উঠে আসার পর তো এদের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে আরও শতগুণ। কমিকসের পাশাপাশি স্পাইডারম্যান, হাল্ক, আয়রনম্যানরা সিনেমাতেও জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে উঠে গেছে মুক্তি পাওয়ার পরপরই। তাদের তোড়ে তো আর আজকাল ‘ডিসি’র সুপারম্যান, ব্যাটম্যানদের ঠিকঠাক খুঁজেই পাওয়া যায় না। শুধু সিনেমা বানিয়েই ‘মার্ভেল’ সারা বিশ্বে ১৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করেছে। আজকাল ‘মার্ভেল’–এর কোনো সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, সেটা নিঃসন্দেহে ব্লকবাস্টার। বছরের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমার তালিকায় সবার ওপরের দিকে স্ট্যান লির ‘মার্ভেল’–এর সিনেমাগুলোর নাম থাকা তো আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মাঝে স্ট্যান লি – এমন ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মাঝে স্ট্যান লি – এমন ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে

‘মার্ভেল’–এর প্রতিটি সিনেমাতেই ক্যামিও চরিত্র হিসেবে স্ট্যান লিকে অভিনয় করতে দেখা যায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য মুখ দেখানো স্ট্যান লির এই ক্যামিও চরিত্র হলিউডপাড়ায় তো রীতিমতো আইকনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ‘মার্ভেল’–এর সিনেমায় স্ট্যান লিকে কখন দেখা যাবে, সেটার জন্যই অনেকেই রীতিমতো হাঁ করে বসে থাকে। তাঁকে শেষবারের মতো ক্যামিও চরিত্রে দেখা যাবে সামনের বছর মে মাসে অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ার–এর সিক্যুয়ালে।

৭০ বছর ধরে কমিকস বইয়ের পাতায় প্রাণ ঢেলে দেওয়া, কোটি কোটি মানুষের শৈশবকে ঝলমলে আনন্দে ভাসানো মানুষটি ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে।
স্ট্যান লি একসময় বলেছিলেন, ‘প্রথম যখন কমিকস লিখতে শুরু করি, তখন লজ্জা পেতাম। মনে হতো, লোকে চিকিৎসক হয়, ইঞ্জিনিয়ার হয়, কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে আর আমি? পরে বুঝেছিলাম, বিনোদনেরও দরকার আছে। সেই বিনোদনটুকু দিতে পারাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ।’

স্ট্যান লি যে দুনিয়ার সব থেকে সেরা বিনোদন তৈরি করে যাওয়া মানুষের ভেতরে অন্যতম, তা পৃথিবীজুড়ে তাঁর কোটি কোটি ভক্তকে দেখলেই দিব্যি টের পাওয়া যায়। শতবর্ষের একেবারে কোঠায় গিয়ে ওপারে চলে যাওয়া স্ট্যান লির ১০০ বছর বাঁচা না হলেও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন আরও ১০০ শতাব্দী, এ বিষয়ে অন্তত দ্বিমত করার কেউ নেই।