চলো একটা বন্ধুত্বের গল্প শুনি। তার চেয়ে বলা ভালো, সিনেমায় বন্ধুত্বের গল্প শুনি। ক্লাসরুমে তোমাকে সারাক্ষণ কলম দিয়ে খোঁচা মেরে বিরক্ত করে টিফিন পিরিয়ডে নিজের টিফিন বক্স হাসিমুখে তোমার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া বন্ধুত্বের গল্প নয়, কিংবা তুমি কাদায় আছড়ে পড়ে গেলে প্রথমে দাঁত কেলিয়ে বেদম হেসে পরে নিজেই হাত বাড়িয়ে তোমাকে কাদা থেকে টেনে তোলা বন্ধুত্বের গল্পও নয়। নিজের বাড়ি থেকে তিন শ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে আমাদের পৃথিবীতে এসে আটকে পড়া ছোট্ট-নিরীহ উদ্ভিদবিজ্ঞানী এক ভিনগ্রহবাসীর সঙ্গে পৃথিবীর ১০ বছর বয়সী বালক এলিয়টের বন্ধুত্বের গল্প!
একদল উদ্ভিদবিজ্ঞানী এলিয়েন ক্যালিফোর্নিয়ার বনে নমুনা সংগ্রহের জন্য এক গভীর রাতে স্পেসশিপে করে নেমে আসে। কিন্তু বন বিভাগের সরকারি প্রতিনিধিদের ধাওয়া খেয়ে স্পেসশিপে করে পালিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনাবশত বনেই থেকে যায় তাদের দলের একটা এলিয়েন। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফার্নান্দো ভ্যালির পাশের এক ছোট্ট শহরতলিতে ১০ বছর বয়সী এলিয়টরা থাকে। পৃথিবীতে আটকে পড়া এলিয়েনটা পালিয়ে এসে এলিয়টদের বাড়ির টুল শেডে লুকায়।
এরপরেই মূলত সূচনা হয় গত শতাব্দীর সিনেমা বিশ্বের সবচেয়ে মধুর বন্ধুত্বের গল্পটি। পৃথিবীতে আটকে পড়া অসহায় এলিয়েনটিকে লুকিয়ে রাখতে এলিয়ট জায়গা করে দেয় নিজের বাড়িতে। ঘটনাচক্রে তিন শ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দার সঙ্গে ছোট্ট এলিয়টের হয়ে যায় তুমুল বন্ধুত্ব।
দিন দিন নিরীহ এলিয়েনের নানা ধরনের অসম্ভব সব ক্ষমতার কথা জানতে পারে এলিয়টরা। সে খুব সহজেই শরীরের ক্ষত সারাতে পারে, শূন্যে বল ভাসাতে পারে, সাইকেল ভাসাতে পারে, এমনকি মরা গাছে ফুলও ফোটাতে পারে। এলিয়টের সঙ্গে সাইকিক কানেকশনের মাধ্যমে একে অপরের অনুভূতিও অনুভব করতে পারে তারা! তাদের একজন অসুস্থ হলে আরেকজনও অসুস্থ হয়ে পড়ে, একজন আনন্দিত হলে অন্যজনও দূর থেকেই সেই আনন্দে খুশি হয়ে যেতে পারে।
এলিয়নকে নিয়ে বেশ হাসি–আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল এলিয়টের দিন। কিন্তু সেই আনন্দও আর বেশি দিন থাকে না। সরকারি লোকজন পৃথিবীতে আটকে পড়া এলিয়েনটাকে খুঁজতে খুঁজতে ঠিকই চলে আসে এলিয়টদের শহরে। এলিয়েনটাকে খুঁজে পেলেই তারা ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কেটেকুটে নির্ঘাত মেরেই ফেলবে।
কিন্তু ছোট্ট এলিয়টও কম যায় না। বন্ধু এলিয়েনকে বাঁচিয়ে তার গ্রহে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য সে, তার ভাইবোন আর তার বন্ধুরা মিলে দাঁড়িয়ে যায় সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এত এত পেশাদার লোকের বিরুদ্ধে ওইটুকুন পিচ্চি ছেলেমেয়েরা কি পারবে বহু দূর থেকে আসা এলিয়েনটাকে তার নিজের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিতে?
সেটা জানতে হলে তোমাকে দেখতে হবে স্পিলবার্গের মাস্টারপিস ক্ল্যাসিক সিনেমা ই. টি. দ্য এক্সট্রা–টেরিস্ট্রিয়াল। ১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া এই দুর্দান্ত সিনেমাটিতে যেমন আছে মজাদার গল্প, ঠিক তেমনই আছে এক অন্য রকম নির্মেদ বন্ধুত্বের কাহিনি, যা দেখতে গেলে তুমি মুগ্ধ না হয়ে যাবেই না!
স্পিলবার্গের সিনেমাটি দুনিয়ার সব থেকে জনপ্রিয় এলিয়েন ঘরনার সিনেমা, যার কারণ হিসেবে সমালোচকেরা মনে করেন যে এই সিনেমাতেই প্রথম এলিয়েনদেরকে ভয়ংকরের বদলে বন্ধুভাবাপন্ন এবং নিরীহ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এই সিনেমার মাধ্যমেই পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ আরও একবার দেখিয়েছেন, বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেশ, জাতি, বর্ণ কিংবা গ্রহান্তরের দূরত্বও মানে না!
এ তো গেল মানুষ আর এলিয়েনের বন্ধুত্বের গল্প, এখন শোনা যাক মানুষ আর আরেকটা মানুষের বন্ধুত্বের গল্প।
গল্পটা লিখেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় কিশোর উপন্যাস লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ছিল দীপু নাম্বার টু। বইয়ের নামেই মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় সিনেমা।
গল্পটা ক্লাস এইটে পড়ুয়া আমিনুল ইসলাম হক ওরফে দীপুর। খামখেয়ালি বাবার একমাত্র সন্তান সে, মাকে চোখে দেখার স্মৃতিও মনে নেই তার। বাবার চাকরি আর খামখেয়ালিপনার কারণে দীপুকে বছর বছর স্কুল আর জায়গা বদলাতে হয়। এ কারণেই ক্লাস এইটে এসে দীপুকে ভর্তি হতে হয় রাঙামাটি জিলা স্কুলে। প্রথম দিন এসেই স্কুলটিকে ভালো লেগে যায় দীপুর। জুটে যায় নতুন কিছু বন্ধুও। নতুন এসব বন্ধুকে নিয়ে বেশ মজায় মজায় দিন কাটতে থাকলেও ক্লাসেরই এক ছাত্র তারিকের সঙ্গে প্রথম থেকেই কাঁচি-কাগজ সম্পর্ক তার। বয়সে বড়, গুন্ডা গুন্ডা চেহারার তারিককে ক্লাসের কেউই সহ্য করতে পারে না। দীপুও তাকে অপছন্দই করে শুরু থেকেই। কিন্তু ঘটনাচক্রে এই তারিকই হয়ে ওঠে দীপুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এরপর দীপু আর তার বন্ধুদের অপূর্ব কিছু দুরন্তপনা আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা অভিযানের গল্প নিয়ে সিনেমাটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, যা দেখতে বসলে এতটাই বুঁদ হয়ে যাবে তুমি যে কখন কোন দিক দিয়ে সময় পার হয়ে গেছে, খেয়ালও থাকবে না!
সব সময়ের ক্ল্যাসিক দীপু নাম্বার টু মূলত বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, ত্যাগ আর রোমাঞ্চকর এক অভিযানের গল্প। সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করে যাওয়া সিনেমাটা দেখতে বসলে তুমি কখনো হাসিতে, কখনো বিরাগে আবার কখনো উত্তেজনায় শিউরে উঠবে।
এবার অন্য রকম প্লটের একটা বন্ধুত্বের সিনেমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই তোমাদের। তোমরা নিশ্চয় ভিডিও গেম খেলো। কেউ কেউ নিশ্চয় ভিডিও গেমের একেবারে পোকা! কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছ, গেমের চরিত্রগুলোর জীবন থাকলে, আবেগ অনুভূতি থাকলে কী হতো?
তুমি ভাবার আগেই বিষয়টা নিয়ে আস্ত অ্যানিমেশন সিনেমাই পরিচালনা করে ফেলেছেন পরিচালক রিচ মুর। র্যাক-ইট রালফ নামের সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১২ সালে। সমালোচক এবং দর্শক উভয় মহলে প্রশংসা পাওয়া সিনেমাটা সম্পর্কে তাহলে বলি এখন।
সিনেমার প্লট মূলত আর্কেড গেমকে (কয়েন অপারেটেড একধরনের ভিডিও গেম, গত শতাব্দীর আশির দশকে বিশ্বব্যাপী দারুণ জনপ্রিয় ছিল) কেন্দ্র করে। প্রতি রাতে যখন লিটওয়াকস ফ্যামেলি ফান সেন্টার অ্যান্ড আর্কেড বন্ধ হয়ে যায়, তখন ভিডিও গেমের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।
গেমসের এই জগতেরই ফিক্স-ইট ফেলিক্স জুনিয়র নামক গেমের মূল ভিলেন হলো র্যাক-ইট রালফ। ভিলেন হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই রালফকে বাঁকা চোখে দেখে সবাই। এমনকি গেমের ৩০ বছর পূর্তির পার্টিতে তাকে দাওয়াতও দেয় না! গেমের চরিত্রের কারণে ভিলেন হতে হলেও আদতে বেচারা রালফ একেবারেই নিরীহ হৃদয়ের শান্ত-শিষ্ট! দাওয়াত না পাওয়ার অসম্মানে রালফের ভীষণ মন খারাপ হয়। সবার কাছে সম্মান পাওয়ার জন্য তাই রালফ বেরিয়ে পড়ে হিরো হওয়ার মেডেলের সন্ধানে!
কোনোমতে সে একটা মেডেল জোগাড় করে ঠিকই, কিন্তু তারপরেই বিপত্তি বাধে, রালফের সেই মেডেলটা ছিনিয়ে নিয়ে যায় সুগার রাস গেমের ভেনেলপি ভন সোয়েজ নামের পিচ্চি এক রেসার।
এবং এরপরেই ভজঘট পাকিয়ে যায় সবকিছুরই। নিজের গেম ছেড়ে অন্য গেমে এসে ভেনেলপির কাছ থেকে মেডেল ফিরিয়ে নিতে গিয়ে ঝামেলা বাধিয়ে পুরো আর্কেড গেম সিস্টেমেরই মাথা খারাপ করে দেয় রালফ।
তোমাদের হয়তো মাথায় প্রশ্ন আসছে, এ তো উদ্ভট এক অভিযানের গল্প, এখানে বন্ধুত্ব কোথায়? আছে আছে, মেডেল ফিরিয়ে নিতে গিয়েই একসময় রালফের সব থেকে প্রিয় এবং একমাত্র বন্ধু হয়ে ওঠে রেসার ভেনেলপি। কীভাবে?
সেটা জানতে হলে অবশ্যই তোমাকে দেখে নিতে হবে র্যাক-ইট রালফ সিনেমাটি।
দারুণ মজাদার সিনেমাটি দেখতে বসলে হাসতে হাসতে তোমার চোয়াল ব্যথা হয়ে যেতে বাধ্য!
বন্ধুত্ব নিয়ে সিনেমা কি এ কয়টাই?
মোটেই না! বন্ধুত্বের সম্পর্কে এতটাই মধু থাকে যে এটা নিয়ে স্বভাবতই রুপালি পর্দায় বন্ধুত্ববিষয়ক সিনেমার কোনো অভাবই নেই! অসংখ্য সেই সিনেমার ভেতর থেকে একে একে দেখে নিতে পারো স্ট্যান্ড বাই মি (১৯৯৬), ফ্রি উইলি (১৯৯৩), দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পাজামাস (২০০৮), দ্য লিটিল রাস্কেলস (১৯৯৪), দ্য গুনিস (১৯৮৫), এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০), আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১), মনস্টার, ইনক (২০০১), রাটাটুই (২০০৭), ক্রিস্টোফার রবিন (২০১৮), দ্য আয়রন জায়ান্ট (১৯৯৯), বিগ হিরো ৬ (২০১৪), ফ্রাঙ্কেনউইনি (২০১২), বল্ট (২০০৮), মিনিয়নস (২০১৫), রালফ ব্রেক দ্য ইন্টারনেট (২০১৮)।
এর বাইরে বন্ধুত্বে ভরপুর যে সিনেমাগুলো অবশ্যই দেখতে পারো, সেগুলো হচ্ছে ‘হ্যারি পটার সিরিজ’, ‘টয় স্টোরি সিরিজ’, ‘হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগন সিরিজ’, ‘মাদাগাস্কার সিরিজ’, ‘উইনি দ্য পুহ সিরিজ’।