উৎসব
সিনেমা বানিয়ে বান্দরবানে
সকাল আটটা। ঘন কুয়াশায় পুরো বান্দরবান শহর একদম ধোঁয়া ধোঁয়া। ডবল হুডি আর কানটুপি পরে বান্দরবান শহরের বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর দীপ। শীতে থরথর করে কাঁপছি। আশপাশের সবকিছুই আমাদের সম্পূর্ণ অচেনা। ডিসেম্বরের এই শীতে ঢাকা ছেড়ে আমরা বান্দরবানে কী করে এলাম, সে গল্প আগে তোমাদের বলি।
সিনেমা বানানোর গল্প
গত বছরের মার্চে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে মাত্রই চোখে রঙিন চশমাটা লাগিয়েছি। মাথায় তখন সিনেমা বানানোসহ অনেক ‘পরীক্ষা-পরবর্তী পরিকল্পনা’। রঙিন চশমা বেশি দিন চোখে রাখা গেল না। করোনাভাইরাস সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল। ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম।
বই পড়ে আর বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে কাটে সারা দিন। মাঝেমধ্যে টুকটাক ভিডিও এডিটিং শেখার চেষ্টা করলাম। এপ্রিলের শেষের দিকে সিনেমা বানানোর প্ল্যানটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আফসোস করতে থাকলাম, এত বড় ছুটি পেয়েও কিছু করতে পারছি না। প্রতিদিনের মতো সেদিন বিকেলে আমার বন্ধু দীপকে ভিডিও কল দিলাম। কল রিসিভ করতেই দেখলাম, স্ক্রিনে দীপের জায়গায় একটা পাপেট বসে আছে। আমাকে জিজ্ঞেস করছে, আমি কেমন আছি। তখনই স্ক্রিনে এক পাশ থেকে হাসতে হাসতে বের হলো দীপ। সিনেমার আইডিয়া পেয়ে গেলাম। সাপ, কুমির ও টিয়ার পাপেটের সাহায্যে ঘরে বসেই আমরা সিনেমা বানাব। প্রস্তাব দিতেই দীপ সানন্দে রাজি।
মে মাসে দুজন মিলে কাজ শুরু করে দিলাম। টানা ৯ দিন নিজ নিজ বাসায় বসে তৈরি করলাম গল্প ও চিত্রনাট্য। এবার শুটিংয়ের পালা। শুটিং হবে দীপের বাসায়। ওর বড় বোন ফাইরোজ তানজীমের চিত্রনাট্য অনুযায়ী পাপেট পরিচালনা করবে আর দীপ মুঠোফোনের ক্যামেরায় সেটা ফ্রেমবন্দী করবে। সে সময় প্রতিদিন ভোরে উঠে দীপের কলের অপেক্ষায় থাকতাম। ভিডিও কলে আমি ফ্রেম ও শট বুঝিয়ে দিতাম। ফ্রেম ধরেই কল শেষ করত দীপ। একই ফ্রেমে নির্ধারিত শট নিয়ে আমাকে পাঠাত। আমি ‘সব ঠিকঠাক’ বা ‘চলবে’ সিগন্যাল দিলে শুরু হতো পরের শটের প্রস্তুতি নেওয়া। চার–পাঁচ দিনে শুটিং শেষ করি। এরপর শুরু হয় সম্পাদনার কাজ। সিনেমাটির টাইটেল ডিজাইন করে জাহিন যাইমাহ কবির, ইন্ট্রো অ্যানিমেশন বানিয়ে দেয় আব্দুল ইলা ও সাবটাইটেল করে ফাইজা ফাইরোজ। পয়লা জুনের ভোররাতে শেষ হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘গল্পকল্প এবং অন্যান্য’র কাজ।
জুন মাসজুড়ে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে আমাদের সিনেমা পাঠালাম। আস্তে আস্তে পোস্টার, ট্রেলার, বিহাইন্ড দ্য সিন ও প্রেস কিট তৈরি করে ফেললাম। আমাদের সিনেমার গল্পটা ছিল মূলত করোনাভাইরাস ও টিকা ঘিরে। সিদ্ধান্ত নিই, জুলাই মাসেই মুক্তি পাবে আমাদের সিনেমা!
সিনেমার যাত্রা ও বান্দরবানে আমন্ত্রণ
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টার ও ট্রেলার আপলোড দিই। আরও বিভিন্নভাবে সিনেমার প্রচারণা চালাই। ১০ জুলাই কিশোর আলো ও গোল্লাছুট (প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র) এর ফেসবুক পেজে মুক্তি পায় গল্পকল্প এবং অন্যান্য। দর্শকের ইতিবাচক সাড়া আমাদের মুগ্ধ করে।
জুলাই ও আগস্টে ইংল্যান্ডের দুটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয় আমাদের সিনেমা। ২৬ জুলাই ও ২৩ আগস্ট উৎসব দুটির অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শিত হয়।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ‘সিনেমা বাংলাদেশ’ আয়োজিত গ্লোবাল ইয়ুথ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রতিযোগিতা বিভাগে (জাতীয়) নির্বাচিত হয় আমাদের সিনেমা। ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর উৎসবটির চতুর্থ আসর বসবে বান্দরবান শহরে। নির্মাতা হিসেবে সম্পূর্ণ আয়োজকদের খরচে আমরা সুযোগ পাব বান্দরবানে গিয়ে উৎসবে অংশ নিতে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেলাম আমন্ত্রণপত্র। সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবান দেখার সুযোগ!
বান্দরবান শহর
ঢাকায় শীতের ছোঁয়া লেগে গেছে ডিসেম্বরেই। মাসের শেষে তা আরও বেড়ে গেছে। অনেকগুলো শীতের কাপড় ব্যাগে ভরে অনেক রাতে দুজন রওনা হলাম বান্দরবানে। ঘুমে ঘুমেই কেটে গেল সম্পূর্ণ যাত্রাপথ।
ভোরে আলো মাত্র ফুটছে। সূর্যের আলোয় ঘুম ভাঙল। বান্দরবানে ঢুকছি আমরা। প্রায় পাহাড়ের মতো উঁচু রাস্তা দিয়ে উঠছে বাস। দুই ধারে পাহাড় আর নদী। একেকটা পাহাড় যেন আলাদা কোনো জগৎ। মুগ্ধ চোখে চারপাশ দেখছি। দীপের কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে ঘুম ভাঙালাম। সূর্যের আবছা আলোয় চোখ জুড়ানো পাহাড় ও আঁকাবাঁকা পথ আমাদের ঘোরের মধ্যে ফেলে দিল। কিছুক্ষণ পর সবকিছু যখন চোখে সয়ে এল, তখনই টের পেলাম বান্দরবানের হাড়কাঁপানো শীত। ব্যাগ থেকে শীতের কাপড় বের করে গায়ে জড়ালাম। মাথায় লাগালাম কানটুপি। ভোর আটটায় যখন বাস থেকে নামলাম, শীতে থরথর করে কাঁপছি আমরা।
বান্দরবান শহরে একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায়, পুরো শহর পাহাড় কেটে কেটে বানানো। পিচঢালা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বান্দরবান যতটা সুন্দর ভেবেছিলাম, এ তো দেখছি তার চেয়েও বেশি সুন্দর! বুঝতে পারলাম, বান্দরবানকে কেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়।
উৎসবের প্রথম দিনের সবকিছু শেষ হতে অনেক রাত হয়ে গেল। সকালে বাস থেকে নেমেই দ্রুত ভেন্যুতে চলে গিয়েছিলাম। সারা দিন সেখানেই ছিলাম। তাই বান্দরবানে গোটা একটা দিন শেষেও শহরটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুটা দূরে হলেও ভেন্যু থেকে হেঁটেই রওনা দিলাম ডাকবাংলোর দিকে। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।
রাতের বান্দরবান একদমই অন্য রকম। পুরো শহর রাত ১১টার মধ্যেই নীরব হয়ে যায়। হাতে গোনা অল্প কিছু মানুষ রাস্তাঘাটে। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের মতো উঁচু–নিচু পিচঢালা রাস্তা দেখে আফসোস হলো। এত সুন্দর শহর তখনো ঘুরে দেখতে পারিনি বলে। ডাকবাংলোতে পৌঁছে দুজন রুম পেলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কাল ভোরে উঠে আশপাশ ঘুরে দেখব। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ঘুম ভাঙল সকাল নয়টায়। আজও শহরটা ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। ১০টার মধ্যে ভেন্যুতে থাকতে হবে। হাত-মুখ ধুয়ে দ্রুত বের হলাম। ভেন্যুর কাছাকাছি গিয়ে এক দোকান থেকে কফি খেলাম। আগের দিনও এখান থেকেই কফি খেয়েছি। বান্দরবানের মানুষগুলো খুব ভদ্র ও বিনয়ী। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে মুদিদোকানদার—এ শহরের প্রত্যেক মানুষের আচরণ খুব সুন্দর। তাদের আপ্যায়ন তোমাকে মুগ্ধ করবেই।
দ্বিতীয় দিনের উৎসব শেষে ডাকবাংলোতে ফিরতেই মেসেজ পেলাম, উৎসবের আয়োজক ও নির্মাতারা পরদিন ভোরবেলা শহরে হাঁটতে বের হবে। চাইলে আমরাও জয়েন করতে পারি। বান্দরবানে কালই আমাদের শেষ দিন। কোনোভাবেই শহর ঘুরে দেখার সুযোগ মিস করা যাবে না। ভোর ছয়টার অ্যালার্ম দিয়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।
শেষ দিন অ্যালার্মের শব্দে সময়মতোই ঘুম ভাঙল। দীপকে ডেকে দিলাম। ভোরবেলা শীত আরও বেড়ে গেছে। মুঠোফোনে তাকিয়ে দেখি, বান্দরবান শহরের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতে কাঁপতে কাঁপতে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। ডবল হুডি আর কানটুপি পরে রুম থেকে বের হলাম। অবাক কাণ্ড, একজন মানুষও রুম থেকে বের হয়নি। ১০ মিনিট অপেক্ষার পরও কেউ বের হলো না। দীপ বলল, দুজনেই বের হই। রাস্তায় যখন বের হলাম, পুরো শহর তখন কুয়াশায় ঢাকা। ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
বান্দরবান শহরে অনেক ব্রিজ। অদ্ভুত দেখতে ব্রিজগুলো। ভারী এই ব্রিজগুলোর নিচে নদীর পানি একদম শুকিয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই ভোরবেলায় চলছে কনস্ট্রাকশনের কাজ। খেয়াল করলাম, এখানকার বেশির ভাগ বিল্ডিংই ছোট ছোট। বেশির ভাগ ভবন দোতলা, সর্বোচ্চ তিনতলা। শহরজুড়ে অনেক সরকারি ভবন। সুন্দর সুন্দর সব ভবন।
অনেকটা পথ পার করে সার্কিট হাউসের সামনে এসে দেখলাম, পাহাড়ের মতো একটা রাস্তা ওপরের দিকে উঠে গেছে। একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। দুজনের চোখই বলছে, ‘ওঠা কি ঠিক হবে? যদি হারিয়ে যাই?’ নীরবতা ভেঙে দীপের কাঁধে হাত রেখে বললাম, চল, উঠে পড়ি। কী আছে জীবনে!
পাঁচ মিনিট ধরে পাহাড়ের মতো খাড়া রাস্তা বেয়ে উঠছি। শেষ আর খুঁজে পাচ্ছি না। হাঁপিয়ে গেলাম দুজনই। শীতকাল না হলে ঘেমে যেতাম নিশ্চিত। দুই মিনিট পরই ওপরে এসে পৌঁছালাম। চারপাশ একদম সবুজ। পাহাড় আর পাহাড়। এত উঁচু থেকে শহরটাকে একদম ছোট্ট দেখাচ্ছে। ছোট ছোট ভবনগুলো আরও ছোট দেখাচ্ছে। পুরো শহরটা সবুজ পাহাড়ে ঘেরা। পাহাড়গুলোর দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। আমাদের দেশটা কত সুন্দর!
সেখান থেকে নামার সময় একদমই কষ্ট হলো না। দ্রুতই নেমে পড়লাম। অল্প পথ হাঁটার পরই ডাকবাংলোয় পৌঁছে গেলাম। ঘড়িতে তখন সময় ১০টা ছুঁই ছুঁই। প্রায় তিন ঘণ্টায় চক্রাকারভাবে পুরো বান্দরবান শহর ঘুরে ফেলেছি আমরা। বান্দরবান শহর একদমই ছোট্ট। তবে এ শহর বড় বড় সব শহরের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর!
ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল
বান্দরবানে চলচ্চিত্র উৎসবটি ছিল তিন দিনের। উৎসবে প্রদর্শিত হয় ৩৫টি দেশের ৭১টি চলচ্চিত্র। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পুরোটাই ছিল সেখানকার স্থানীয় সংস্কৃতিকেন্দ্রিক। আমরা তিন দিনে প্রায় অর্ধশত সিনেমা দেখেছি। একেক দেশের একেক রকম সিনেমা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। আমার বন্ধু রাশেদ, স্বপ্নজাল ও ন ডরাই। উৎসবে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকদের কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। মাত্র তিন দিনে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে ধ্যানধারণাই পাল্টে গেছে। অনেক শেখার বাকি, অনেক।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যার পর প্রথমবার বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয় গল্পকল্প এবং অন্যান্য। আমাদের সিনেমা দেখে বান্দরবানের দর্শকদের ইতিবাচক সাড়া আমাদের মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। গল্পকল্প এবং অন্যান্য প্রদর্শনীর পর দর্শকেরা আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। জানতে চান সিনেমা নিয়ে আমাদের ভাবনা ও অভিজ্ঞতা। এত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে একটু ভয় লাগলেও দুজন মিলে সবাইকে শোনাই গল্পকল্পের পেছনের গল্প।
গ্লোবাল ইয়ুথ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাদের ঝুলিতে কোনো পুরস্কার ঢোকেনি। তবে এত সুন্দর শহর দেখা এবং এত গুণী নির্মাতা আর দারুণ মানুষদের সঙ্গে তিন দিন সময় কাটানোটা পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশি।
গল্পকল্প এবং অন্যান্য
দেখে নাও আমাদের বানানো সিনেমাটি।