স্কুলের শান্তশিষ্ট, চুপচাপ একটা মেয়ে হিসেবেই পরিচিত তারান্নুম। স্কুলে যায়, চুপচাপ বেঞ্চের একটি কোনায় বসে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করে। তারপর স্কুল ছুটি হলে সোজা বাসায় ফিরে আসে। কিন্তু কখনো-সখনো এত সহজভাবে কাটে না তারান্নুমের দিনটা। প্রায়ই স্কুলের কিছু দুষ্টু সহপাঠীর দুষ্টামি সহ্য করতে ওকে। চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় নানা রকম বুলিংয়ের শিকার হয় ও। মুখে কিছু বলে না তারান্নুম। চেষ্টা করে গান লিখতে আর গাইতে। তারান্নুম অনুপ্রেরণা পায় টেলর সুইফটের কাছে। ওর খুব প্রিয় শিল্পী টেলর সুইফট। মার্কিন এই শিল্পী শুধু তারান্নুম নয়, এমন অসংখ্য টিনএজারের অনুপ্রেরণা।
১৯৮৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর আমেরিকার পেনসিলভানিয়াতে জন্ম এই পপতারকার। বাবা স্কট কিংসলি সুইফট ও মা অ্যানড্রিয়া গার্ডনার সুইফট। পুরো নাম টেলর অ্যালিসন সুইফট। ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি প্রবল আগ্রহ আর অসীম ভালোবাসা ছিল টেলরের। এ আগ্রহের পেছনে তাঁর দাদির একটি বড় ভূমিকা ছিল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করেন টেলর। দারুণ সাড়া ফেলে ‘টেলর সুইফট’ নামের সেলফ টাইটেল অ্যালবামটি।
গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। ৯ বছর বয়স থেকেই মিউজিক্যাল থিয়েটারের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। থিয়েটারে যাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত নিউইয়র্ক শহরে গান আর অভিনয় শিখতে যেতেন টেলর। তখন গানের ধরন পরিবর্তন করে কান্ট্রি মিউজিকের দিকে ঝোঁকেন তিনি। শুধু তা–ই নয়, গানকে ভালোভাবে বোঝার জন্য করার জন্য মায়ের হাত ধরে পাড়ি জমান আরেক শহর ন্যাশভিলে। সেখানে ক্যারাওকেতে গাওয়া নিজের দুটি গানের রেকর্ড জমা দেন ন্যাশভিল রেকর্ড লেবেলের কাছে। টেলরের এই রেকর্ড পছন্দ হলো না তাদের। টেলরের গান দুটিকে বাতিল করে দিল তারা। তাতে যে তিনি দমে গেলেন, তা কিন্তু নয়। কীভাবে ভিন্নভাবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটানো যায় তা ভাবতে শুরু করলেন তিনি। ১২ বছর বয়সে টেলরের গিটারে হাতেখড়ি হয় কম্পিউটার মেরামতকারী ও স্থানীয় গায়ক রনি ক্রিমারের হাত ধরে। আর সেটাই শুরু টেলরের আত্মপ্রকাশের। গিটার, উকুলেলেসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারা টেলরের গাওয়া বেশির ভাগ গান তাঁর নিজের লেখা। বিশ্বে সবচেয়ে কম বয়সী সংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি সনি বা এটিবি ট্রি পাবলিশিং হাউসের সঙ্গে গান করতে চুক্তিবদ্ধ হন। যদিও তা সম্পূর্ণ করেননি তিনি। ২০০৬ সালে টেলরের প্রথম অ্যালবাম টেলর সুইফট প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমতো হইচই পড়ে যায় শ্রোতাদের মধ্যে। সবাই বুঝে যায়, পপ বিশ্বে নতুন তারকার আগমন ঘটে গেছে।
টেলর সুইফটই প্রথম শিল্পী, যাঁর গান আমেরিকার বিলবোর্ডে সেরা ২০০–এর মধ্যে প্রায় ১৫৭ সপ্তাহ দীর্ঘায়িত হয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম থেকেই একের পর এক বাজিমাত করতে লাগলেন টেলর। ২০০৮-এ আসে তাঁর অ্যালবাম ফিয়ারলেস। এই অ্যালবাম দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েন তিনি। কান্ট্রি মিউজিকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার অর্জন করে অ্যালবামটি। আমেরিকা, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের মিউজিক চার্টে একই সঙ্গে প্রথম স্থান দখল করে নেয় এটি। এই অ্যালবামের ‘লাভ স্টোরি’ গানটি সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কান্ট্রি মিউজিকের ধারার বাইরেও যে টেলর অনবদ্য গান, তার প্রমাণ তিনি দেন অ্যালবাম রেড দিয়ে। ২০১২ সালে প্রকাশিত এ অ্যালবামে টেলরের লেখা গানের সংখ্যা ছিল নয়টি, যার মধ্যে ‘উই আর নেভার এভার গেটিং ব্যাক টুগেদার’, ‘আই নিউ ইউ অয়্যার ট্রাবল’ উল্লেখযোগ্য গান। এই গানগুলো দিয়েই ড্যান্স পপ, হার্টল্যান্ড রক ও ডাবস্টেপ ট্র্যাকেও তিনি যে সমান দক্ষ, তার স্বাক্ষর মেলে। রেড অ্যালবাম দিয়ে একজন নারী সংগীতশিল্পী হিসেবে দুই মিলিয়নসংখ্যক কপি বিক্রি হওয়ায় গিনেজ বুক ওয়ার্ল্ড অব রেকর্ডে তার নাম ওঠে। এরপর ১৯৮৯ অ্যালবাম দিয়েও সাড়া ফেলেন তিনি। নিজের জন্মসালের নামে রাখা এ অ্যালবামও বিক্রি হয় এক মিলিয়ন কপির বেশি, যার মাধ্যমে পরপর তিনবার এক মিলিয়ন কপি বিক্রি হওয়ার রেকর্ড গড়েন নতুন করে। ভাঙাগড়ার এই রেকর্ডগুলোর মধ্যে টেলর নিজের ঝুড়িতে পুরস্কারও জিতে নিয়েছেন অসংখ্যবার। গানের ভুবনে সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন ১১ বার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী গ্র্যামি জেতা শিল্পীও তিনি। মাত্র ২০ বছর বয়সে এ পুরস্কার নিজের করে নেন টেলর।
টেলর সুইফটই প্রথম শিল্পী, যাঁর গান আমেরিকার বিলবোর্ডে টপ ২০০–এর মধ্যে প্রায় ১৫৭ সপ্তাহ দীর্ঘায়িত হয়েছিল।
শুধু কণ্ঠশিল্পী বা গীতিকার হিসেবেই নন, অভিনয়–দক্ষতা দিয়েও ভক্তদের মনে স্থান করে নিয়েছেন টেলর। মিউজিক ভিডিওগুলোই প্রমাণ করে তা। কখনো তিনি প্রিন্সেস হয়ে উপস্থিত হন, কখনো–বা জম্বি সেজে। গানের কথা আর কণ্ঠের সঙ্গে অভিনয়েও পুরো বিষয়টি জীবন্ত হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে তাঁর ‘লুক হোয়াট ইউ মেড মি ডু’-এর মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যকবার দেখার রেকর্ড গড়ে। এই মিউজিক ভিডিওতেই বিভিন্ন সময়ে উঠে আসে তাঁর সঙ্গে হওয়া বুলিংয়ের বিষয়গুলো। টেলর সুইফটও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন। তবে তিনি দমে যাননি তাতে। জনপ্রিয় টিভি শো ‘অ্যালেন শো’-তে টেলর বলেছিলেন তাঁর বুলিংয়ের ঘটনা। যখনই স্কুলে তিনি এমন কোনো কিছুর মুখোমুখি হতেন, বাড়ি ফিরে এসে তখনই তিনি কাগজ-কলম নিয়ে গান লিখতে বসে যেতেন। তারপর গিটারে টুংটাং করে সুর দিতেন সেটায়। মানবতাবাদী টেলর মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেও কার্পণ্যবোধ করেননি কখনো। বিভিন্ন সময়ে অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন তিনি। ২০০৮ সালে আমেরিকার সিডার র্যাপিডস অঞ্চলে বন্যায় আক্রান্ত হয় অসংখ্য মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্যে ১ লাখ ইউএস ডলার অনুদান দেন টেলর। ২০০৭ সালে শিশুদের অনলাইন নিরাপত্তার জন্যও ক্যাম্পেইন করেন তিনি।
ভক্তদের প্রিয় টেলর পরিচিত বিভিন্ন ডাকনামে। T-Swizz, TayTay, Teffy, TS নানা ডাকনামে ভক্ত, বন্ধু ও পরিজনের কাছে পরিচিত।