রুপালি পর্দায় শার্লকের ১২০ বছর
১৮৮৭ সাল। লন্ডনের ২ নম্বর আপার উইম্পোল স্ট্রিটে অফিস কক্ষ ভাড়া নিলেন আর্থার কোনান ডয়েল নামের এক তরুণ চিকিৎসক। শহরে নতুন এসেছেন বলেই হয়তো তাঁর চেম্বারে তখনো রোগীর উপচে পড়া ভিড় নেই। ফাঁকা চেম্বারে বসেই বিশ্বসাহিত্যের প্রথম ‘কনসালটেটিভ গোয়েন্দা’-র চরিত্রটি দাঁড় করালেন তিনি। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতা, চৌকো মুখ, কালো ওভারকোট পরিহিত বিচক্ষণ গোয়েন্দাটির নাম ‘শার্লক হোমস’। দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে হু হু করে বাড়তে থাকল শার্লকের জনপ্রিয়তা। অতি দ্রুত এ জনপ্রিয়তা ছাড়াল বইয়ের পাতার গণ্ডি। বোর্ড গেম, কমিকস, নাট্যমঞ্চ, ভিডিও গেম থেকে শুরু করে টিভি পর্দায় এবং সেলুলয়েডেও দুর্দান্ত সাড়া ফেলে দিল মিস্টার হোমস।
তবে রুপালি পর্দার মতো অন্য কোনো মাধ্যমে এতবার, এত অভিনেতার অভিনয়ে মূর্ত হয়নি শার্লক হোমস। ‘পৃথিবীর সর্বাধিক অভিনীত চলচ্চিত্র-চরিত্র হিসেবে’ গিনেস বুকে প্রায় স্থায়ী আসন করে নিয়েছে আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট এই গোয়েন্দা। ১৯০০ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১০ যুগ আগে সেলুলয়েডে শার্লক হোমসের প্রথম আবির্ভাব। নির্বাক যুগে নির্মিত ‘শার্লক হোমস ব্যাফলড’ নামের সে চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩০ সেকেন্ড। আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা কোনো গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়নি চলচ্চিত্রটি। শার্লক হোমসের দারুণ জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে শুধু বইয়ের পাতা থেকে চরিত্রটি ধার নিয়েছিল আমেরিকান মুটোস্কোপ এবং বায়োগ্রাফি কোম্পানি। তবে পুরোপুরি কাকতালীয়ভাবে এখানেও শার্লকের প্রথম আবির্ভাবের সঙ্গে ভীষণ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন আর্থার নামের একজন। পুরো নাম আর্থার উইড মারভিন, তাঁর পরিচালনা ও চিত্রগ্রহণেই নির্বাক যুগের সে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত শার্লক হিসেবে অভিনয় করেছেন ৭৫ জনেরও বেশি অভিনেতা। তবে বড় পর্দার প্রথম শার্লক হোমস কে ছিলেন, তা এখনো এক অজানা রহস্য।
১৯০৫ সালে শার্লককে নিয়ে নির্মিত নির্বাক চলচ্চিত্র অ্যাডভেঞ্চার অব শার্লক হোমস-এ প্রথম স্পষ্টভাবে পাওয়া গেল কোনান ডয়েলের লেখার ছাপ। তবে এতেও নির্দিষ্ট কোনো গল্প অনুসরণ করা হয়নি এবং শার্লক চরিত্রের রূপদানকারী অভিনেতার পরিচয় নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শার্লক হোমসকে কেন্দ্র করে ১৩টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কিন্তু শুধু ‘শার্লক হোমস ইন কনম্যন ক্ল’জ’ সিনেমার ফিল্মটিই এখনো সুরক্ষিত রয়েছে। ফলে, শার্লক চরিত্রের সবচেয়ে প্রাচীন অভিনেতা হিসেবে ভিগো লারসেনের নামটিই খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর সময়ের সঙ্গে চলচ্চিত্রশিল্পে প্রযুক্তিগত যত উন্নয়ন হলো, রুপালি পর্দায় ‘হোমসিয়ান ডিডাকশন’ তত বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল।
জন ব্যারিমুর অভিনীত শার্লক হোমসই (১৯১৬) ‘শার্লক’ ফ্র্যাঞ্চাইজির ইতিহাসে প্রথম ব্যবসাসফল ছবি। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগেও বেকার স্ট্রিটের গোয়েন্দাকে নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষা করেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। কখনো অ্যান্থোলজি চলচ্চিত্রের ভাবগম্ভীর আবহে পুরোপুরি গোয়েন্দার বেশে, কখনো প্রখ্যাত নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার ক্রিস কলম্বাসের লেখায় নিজের শৈশবস্মৃতি নিয়ে, আবার কখনো ‘ডিজনি’র ডিটেকটিভ মাউস–এর অনুপ্রেরণা হয়ে বারবার সিনেমার পর্দায় এসেছে শার্লক হোমস।
কিন্তু ‘শার্লক হোমস’ সিরিজের সবচেয়ে সফল ছবি কোনটি? বক্স অফিসে আয়ের পরিমাণ বা দর্শকপ্রিয়তা, যা-ই বিচার করি না কেন, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র ও জুড ল অভিনীত ‘শার্লক হোমস’ (২০০৯) ও ‘শার্লক হোমস: আ গেম অব শ্যাডো’ই (২০১১) সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে। সমালোচকদেরও মুগ্ধ করেছিল আধুনিক হোমস-ওয়াটসন, প্রথম ছবিটি পেয়েছিল দুটো অস্কার মনোনয়ন। কোনান ডয়েলের ‘হোমস’–এর সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বাহবা পেয়েছিলেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, বছরের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ২০০৯ সালে জিতেছিলেন গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড।
প্রথম চলচ্চিত্রটিতে কোনান ডয়েলের কোনো নির্দিষ্ট লেখাকে উপজীব্য করেননি পরিচালক গাই রিচি। তবে দ্বিতীয় ছবিতে ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ এবং ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব এম্পটি হাউস’ থেকে বেশ কিছু উপাদান ধার করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে শার্লক হোমস নির্মাণের অনুপ্রেরণার কথা বলতে গিয়ে গাই রিচি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের শৈশবে, ‘ডরমিটরিতে থাকার সময় আমরা লাউডস্পিকারে শার্লকের গল্পগুলো শুনতাম। রাতে ঘুমের মধ্যেও মনে হতো সাত বছরের আমার সঙ্গে কথা বলছেন স্বয়ং শার্লক।’
১৮৯০-১৮৯১ সালের পটভূমিতে এনে ‘শার্লক হোমস’কে অনেকটাই আধুনিকায়ন করেছে চলচ্চিত্র দুটি। এ ছাড়া প্রচুর পাঠকের অভিযোগ, সিনেমার শার্লক বড় বেশি অস্থির ও মারমুখী। এ নিয়ে প্রযোজক লিওনেল উইগ্রাম বলেন, ‘প্রায় ১০ বছর ধরে আমি শার্লককে নতুনভাবে দেখানোর কথা ভেবেছি। কোনান ডয়েলের লেখা পড়ার সময় আমার চোখে মিস্টার হোমসের যে ছবি ভেসে উঠত, তা পুরোনো চলচ্চিত্রগুলো থেকে একেবারে আলাদা। আমার কাছে শার্লক আরও অনেক বেশি আধুনিক এবং খানিকটা বোহিমিয়ান এক চরিত্র।’
দ্বিতীয় ছবি মুক্তি পাওয়ার পরপরই ‘শার্লক হোমস ৩’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল ওয়ার্নার ব্রস স্টুডিও। সিনেমাটির নাম এখনো নির্ধারিত না হলেও জানানো হয়েছে মুক্তির তারিখ। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর ডিসেম্বরের ২২ তারিখে আবারও হোমস-ওয়াটসন রূপে বড় পর্দায় ফিরবেন রবার্ট ডাউনি জুনিয়র ও জুড ল।
গত ১২০ বছরে ২৫৪ বার নানা রূপে বড় পর্দায় এসেছে শার্লক হোমস। তবু আজও সারা বিশ্বের ‘হোমসিয়ানরা’ শার্লক হোমসের নতুন সিনেমার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন, বইয়ের সঙ্গে মিল-অমিলের তর্কে মুখর হয়ে ওঠেন।