ক্রিকেট বিশ্বকাপ নিয়ে তোমরা নিশ্চয় দারুণ উত্তেজনায় ভুগছ। চাপ না নিয়ে মগজটাকে একটু শান্তি দেওয়ার জন্য ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে ক্রিকেটবিষয়ক যে সিনেমা আছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নিয়ে আসি।
প্রথমেই ঘুরে আসা যাক কঠোর, হিংস্র ওয়ার্ডেন জন ‘হিটলার’ কাক্কারের জীর্ণ অনাথ আশ্রম থেকে। এই অনাথ আশ্রমের কঠিন পরিবেশেই লাথিগুঁতো খেয়ে দিনাতিপাত করে ১৩ বছর বয়সী কারান নামের এক ছেলে। অনাথ কারানের দুটি স্বপ্ন—এক. তার বাবা-মা হবে এবং দুই. সে একদিন অনেক বড় একজন ক্রিকেটার হবে। আশ্রমের কেয়ারটেকার বুড়ো ভোলু দাদা প্রায়ই আশ্রমের বাচ্চাকাচ্চাদের ১৯৮৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের গল্প শোনান। সেই বিশ্বকাপে কপিল দেবের অনবদ্য খেলার কথা বেশ রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেন তিনি। তাঁর এই গল্পগুলো শুনতে শুনতেই কারানের আদর্শ হয়ে যান কপিল দেব। কারান স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, সে–ও একদিন কপিল দেবের মতো বিরাট ক্রিকেটার হবে।
এক ঝড়ের রাতে কারান কুড়িয়ে পায় একটি পুরোনো ক্রিকেট ব্যাট, ব্যাটের গায়ে কপিল দেবের নাম আর ১৯৮৩ খোদাই করা লেখা দেখে কারান বুঝে যায় যে এটা স্বয়ং কপিল দেবেরই ব্যাট, যেটা দিয়ে খেলে তিনি বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন! একসময় এই ব্যাট দিয়ে ব্যাটিং করতে গিয়ে কারান আবিষ্কার করে, এই ব্যাট সাধারণ কোনো ব্যাট নয়, এটা একটা জাদুর ব্যাট, এই ব্যাট দিয়ে সে যে বোলারের বলই মারে, তার সবই বিরাট বিরাট ছয় হয়ে যায়! ঘটনাচক্রে একদিন কারানের একটা বিরাট ছয় গিয়ে পড়ে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট দলের কোচের গাড়ির কাচের ওপর! সেই আঘাতে গাড়ির কাচের তো দফারফা! এ ঘটনাই কারানকে নিয়ে যায় স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে! কারান ঢুকে যায় ইন্ডিয়ান জাতীয় ক্রিকেট দলে এবং ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নেমে প্রতি ম্যাচেই সে চার–ছয়ের বন্যা বইয়ে দেয় ওই জাদুর ব্যাট দিয়ে বল মেরে! সিনেমার গল্পের কি এখানেই শেষ? মোটেই না! মূলত এরপর শুরু হয় আসল গল্প। অনাথ আশ্রমের সামান্য এক অতি অবহেলিত ছেলে থেকে মুহূর্তেই কারান হয়ে যায় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ।
এরপর? এরপর কী হয়, সেটা জানতে হলে অবশ্যই তোমাদের দেখতে হবে ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া চেন কুলি কি ম্যান কুলি নামের দারুণ মজাদার সিনেমাটি। সিনেমাটি মূলত হলিউড সিনেমা লাইক মাইক–এর ভারতীয় সংস্করণ হলেও মজার দিক দিয়ে কোনো অংশে কম স্বতন্ত্র নয়!
এবার চলো ঘুরে আসা যাক সেই ব্রিটিশ আমল থেকে!
১৮৯৩ সাল।
ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনের নিচে দেবে থাকা এক পরাধীন সভ্যতার নাম। গুজরাটের ছোট্ট একটা শহর চাঁপনর। এই চাঁপনর ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রু রাসেল রাজ্যবাসীর ওপর উচ্চমূল্যের কর চাপিয়ে দিয়েছে।
সে বছর এমনিতে অনাবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট দীর্ঘ খরায় ফসল হয়নি, এর ওপর আরও বেশি কর! গ্রামবাসীর তো মাথায় হাত। ঘটনাচক্রে গ্রামেরই এক অধিবাসী ভুবন কমান্ডিং অফিসার অ্যান্ড্রু রাসেলকে চ্যালেঞ্জ করে বসে যে ক্রিকেট খেলায় তারা ব্রিটিশদের হারিয়ে দিতে পারবে। ক্রিকেট সে সময় একেবারেই অপরিচিত খেলা ভারতের গ্রামীণ জনগণের কাছে। আগে কখনো খেলা তো দূরে থাক, এরা দেখেইনি এই খেলা। তাই ক্যাপ্টেন অ্যান্ড্রু রাসেল ভুবনের এই চ্যালেঞ্জে সহজেই রাজি হয়ে যায় কিন্তু শর্ত জুড়ে দেয় যে যদি গ্রামবাসী জিতে যায়, তাহলে সব খাজনা মওকুফ করে দেওয়া হবে, যদি তারা হেরে যায়, তবে তিন গুণ বেশি খাজনা দিতে হবে! তার এই শর্ত মেনে গুজরাটের ছোট্ট একটা গ্রামের কয়েকজন অতিসাধারণ মানুষ ব্যাট-বল হাতে দাঁড়িয়ে যায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে!
আর এরপর যে ইতিহাস ঘটে, সেটা বলিউড সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা সিনেমাগুলোর একটি হওয়ার তকমা নিয়ে নিতে দেরি করে না!
এতক্ষণ যে সিনেমার গল্পটা বললাম, সেটার নাম লগান: ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ইন্ডিয়া। মুক্তি পেয়েছিল ২০০১ সালে। লগান শব্দের বাংলা করলে হয় কর বা খাজনা। শোষকদের বিরুদ্ধে ক্রিকেট দিয়ে শোষিতদের রুখে দাঁড়ানোর গল্প নিয়ে বানানো এই সিনেমা বহু আগেই বলিউডের সর্বকালের সেরা সিনেমার তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। বিদেশি ভাষার সিনেমা হিসেবে অস্কারে নমিনেশনও পেয়েছিল। একটুর জন্য অস্কার হাতছাড়া হয়ে গেলেও বলিউডের মিস্টার পারফেকশনিস্ট–খ্যাত আমির খান অভিনীত এই সিনেমা এখনো দারুণ জনপ্রিয়। অনেকের মতে, খেলাধুলা নিয়ে বানানো বলিউডের সবচেয়ে সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ সিনেমা এটাই।
ক্রিকেট নিয়ে বলিউডের আরেকটা সুন্দর সিনেমা হলো ইকবাল। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমা দর্শক ও সমালোচক—দুই ক্ষেত্রেই দারুণ প্রশংসিত।
সিনেমার গল্প ভারতের ছোট্ট এক গ্রামের অতিসাধারণ তরুণ ইকবালকে ঘিরে। সে কথা বলতে পারে না এবং কানেও শোনে না। কিন্তু সে বোলার হিসেবে খুবই দুর্দান্ত। তার স্বপ্ন ভারত ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার। কিন্তু তার এই স্বপ্নে বাদ সাধে তার বাবা। তার বাবা মনে করে, ইকবালের এই ক্রিকেট খেলা সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়। তাই সে ইকবালকে জোর করে কৃষিকাজে লাগিয়ে দিতে চায়।
কিন্তু ইকবালের ছোট বোন খাদিজা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে তার ভাই ইকবাল ভারতীয় ক্রিকেট দলে খেলার পুরো যোগ্যতা রাখে এবং সে তার বড় ভাইকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য ভাইয়ের সঙ্গে মিলে রীতিমতো সংগ্রামে লেগে পড়ে।
ভাইবোনের সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহে পরিচয় ঘটে স্থানীয় এক মাতালের সঙ্গে, যে একসময় অনেক বড় ক্রিকেটার ছিল। এই মাতালের তত্ত্বাবধানেই বাবার চোখ এড়িয়ে অতিগোপনে চলতে থাকে ইকবালের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ।
কিন্তু এত এত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে কি সম্ভব হবে ইকবালের স্বপ্ন পূরণ হওয়া? সে কি খেলতে পারবে ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলে? সেটা জানতে হলে তোমাদের দেখে নিতে হবে শ্রেয়াস তালপাড়ে ও নাসিরুদ্দিন শাহ অভিনীত ইকবাল সিনেমাটি।
এগুলোর বাইরেও ক্রিকেট নিয়ে আরও অনেক সিনেমা আছে, যেগুলো এই বিশ্বকাপের আগে আগে ঝালিয়ে নিতে পারো তোমরা। কলকাতার সিনেমা চলো পাল্টাই (২০১১) যদিও পুরোপুরি ক্রিকেটীয় সিনেমা না, তবু দেখে নিতে পারো শুরুতেই। এ ছাড়া দেখে নিতে পারো ফেরারি কি সাওয়ারি (২০১২), এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি (২০১৬), দিল বোলে হাড়িপ্পা (২০১৯) ইত্যাদি।