কৈশোরের সংগীতপিপাসা ঠিক উচ্চাঙ্গ থাকে না। এটা রাগপ্রভাবিত নয়। এই সূত্র সব প্রজন্মেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ধ্রুব সত্য হিসেবে। কৈশোর খোঁজে হালকা কিছু, সহজবোধ্য এবং অনেকটা চটুল কিছু। সেই জনপ্রিয়তার নিরিখেই পপ কথাটার উৎপত্তি এবং এর সাংস্কৃতিক বিস্তার। জগৎজুড়েই কৈশোর ও তারুণ্যের সংগীতমননে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে, রাখছে এবং রাখবে রক অ্যান্ড রোল। নানা মোড়কে টিকে আছে এই রক অ্যান্ড রোল, নানা নামে। চলো টাইম মেশিনে চড়ে একটু ফিরে দেখি ৭০-৮০ বছর আগের টিনএজাররা কতটা মোহিত ছিল রক অ্যান্ড রোল মৌতাতে। কারা ছিল তার কান্ডারি!
প্রেক্ষাপট আমেরিকা। সালটা ১৯৫০ এবং তারপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। সাদা-কালোর বর্ণবাদী দ্বন্দ্বটা তবুও পুরোটা কাটেনি সেখানে। কিন্তু গানের রং তো সাদা বা কালো নয়, রংধনুর মতোই পুরোটা রঙিন। তারপরও আফ্রিকান-আমেরিকান শিল্পীদের আসরে হোয়াইট আমেরিকানরা ঢুকত না, যেমন ঢোকার অধিকার ছিল না তাদের শিল্পীদের জলসায় কালোদের। প্রথম ঘরানায় চাক বেরি, লিটল রিচার্ড, বো ডিডলি ও ফ্যাটস ডমিনোরা রীতিমতো জনক হয়ে আছেন রক অ্যান্ড রোলের। আলাদা করে বলতেই হয় ডিডলির কথা। রক অ্যান্ড রোল কথাটার সৃষ্টিতেও তাঁরই অবদান। তখন তো সাদা-কালো টিভি আর রেডিওর যুগ। গান শোনার জন্য রেডিওই আশ্রয় সবার।
অস্ট্রেলিয়ান রেডিওতে একবার ডিডলির গান সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডিজে অ্যালান ফ্রিডের স্তুতিটা ছিল ‘দ্য ম্যান উইথ দ্য অরিজিন্যাল সাউন্ড দ্যাটস গেই টু রক অ্যান্ড রোল আউট অব ইওর শিট!’ যেহেতু প্রতিবাদ আসেনি কোনো, ধরে নেওয়া যায় এটাই সত্যি।
ব্যাপারটা ছড়িয়ে গেল সাদাদের মাঝেও। কারণ রেকর্ড কোম্পানিগুলো এ ধরনের গানের অপার সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ বুঝেই এর বিপণনে নেমে পড়েছিল। মাঠে তখন এলভিস প্রেসলি। তাঁর ব্যালাড আর ‘লাভ ইউ-নিড ইউ’ মার্কা হালকা চালের গানগুলোর বেশ কদর। কিন্তু তিনি তাতে আরও গতি আনলেন ফরম্যাট বদলে। পরিবর্তন এল তাঁর বডি ল্যাঙ্গুেয়জেও। টুইস্ট তখন ডান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারা। এলভিসের গানে এ টুইস্টের উপাদান খুঁজে পেলেন শ্রোতারা। সুদর্শন ও তত দিনে ‘আমেরিকান আইডল’ হয়ে যাওয়া কোমর দোলানো হিস্টিরিয়ার জন্ম দিল মার্কিন টিনএজারদের মাঝে। এলভিস মানেই তীব্র চিৎকারে শ খানেক কিশোরী-তরুণীর অজ্ঞান হয়ে পড়া।
এলভিস যদিও ‘দ্য কিং’ তবু আসরে তখন ছিলেন ‘বিল হেইলি অ্যান্ড দ্য কমেটস’। জেরি লি লুইসের পাগলামিতেও একই রকম উন্মাদনার জোয়ার। বাড হ্যালেন্স, বিগ বপার, জনি ক্যাশও ছিলেন আলোচনায়। এঁরা সবাই ঝাঁক বেঁধেই গাইতেন এবং একসঙ্গে ট্যুর করতেন ইউএস ও ব্রিটেনে। ব্রিটেন জয় করতে পারেনি আমেরিকানরা, উল্টো ব্রিটিশ রক এসে কাঁপিয়ে দিল ইউএস মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। ষাটের দশকের শুরুতে ‘দ্য ফেবুলাস সিলভার বিটলস’ নামে চার তরুণের রক ব্যান্ডটি ‘বিটলস’ নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। যাঁঁরা ‘বাডি হলি অ্যান্ড দ্য ক্রিকেটস’ গ্রুপের নব্য সংস্করণ ভাবতেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দিলেন জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টার। শুরু হলো বিটলস ক্রেজ।
বিটলস ক্রেজের পেছনে একটা বড় অনুষঙ্গ ছিল তাঁদের অ্যাটিচুড ও বডি লাঙ্গুয়েজ। সদ্য টিনেজ পার হওয়া সুদর্শন চার তরুণ, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, কালো কোট-স্কিন টাইট ট্রাউজার্স (সে সময় বলা হতো ড্রেন পাইপ), দুর্দান্ত লিরিকস এবং ড্রামের সঙ্গে শুধুই গিটার। তাঁদের রেকর্ড লেভেল মানে আগেকার শিল্পীদের মতো স্টুডিওতে দুগাল হাসিতে ভরিয়ে তোলা পোর্ট্রেট কাভার নয়। গম্ভীর, অভিব্যক্তিহীন। হালের ভাষায়-কুল! শ্রোতাদের পাগলপারা না হওয়ার কারণ নেই।
আরেকটা কথা না বললেই নয়, বিটলসের কনসার্টগুলো ছিল ‘চেস বোর্ড ক্রাউড’। সাদা-কালোর ভেদাভেদ একদমই ছিল না।
একই সঙ্গে বিটলস ছিল মার্কিন রক অ্যান্ড রোলের জন্য বড় একটা হুমকিও। একা বিটলস কেন, ব্রিটিশ রকই ছিল তা। পঞ্চাশের মাঝামাঝি ও ষাটের দশকের শুরুতে ব্রিটেনে শুরু ট্র্যাডিশনাল জ্যাজ মুভমেন্ট বা সংক্ষেপে ট্র্যাড জ্যাজের। আমেরিকা থেকে সফরে আসা ব্লুজ মিউজিশিয়ানরা ব্রিটিশ শ্রোতাদের নতুন ধরনের গান শুনিয়ে গেলেন যেন সে সময়। একই সঙ্গে ছাত্রদের যেন দিয়ে গেলেন গুরুমারা বিদ্যার মন্ত্রগুপ্তিটাও!
বিটলস ঠিক তা-ই করল আমেরিকা সফরে গিয়ে। প্রসঙ্গত বলে যাই, বিটলসের প্রাণপুরুষ জন লেনন ১৯৫৭ সালের মার্চের দিকে ‘দ্য কোয়ারি ম্যান’ নামে যে ব্যান্ডটি গড়েন, তার মূল ভাবধারাই ছিল জ্যাজ ফিউশন থেকে আসা রক অ্যান্ড রোল। সেটা আরও ইমপ্রোভাইজড হয় অন্যান্য শিল্পীর নিরীক্ষাতেও। এবং তাতে সফল নামটি ক্লিফ রিচার্ডস। যদিও আলেক্সিস কোরনারকে মানা হয় ব্লুজ-রক ফিউশনের জনক বলে, কিন্তু ‘মুভ ইট’ হিট সিঙ্গলসটি দিয়ে বাজার মাত করার কৃতিত্বটা একা ক্লিফ রিচার্ডসেরই। এবং সেই তোড়েই ভেসে গেল আমেরিকানরা! বিটলসের ক্লিন কাট ইমেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রক অ্যান্ড রোলে নিহিলিজম ঢুকিয়ে দিল আরেক ব্রিটিশ ব্যান্ড ‘রোলিং স্টোনস’। মিক জ্যাগারের ব্যান্ড প্রথমেই জানিয়ে দিল মিউজিক করতে হলে সুটেড-বুটেড হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যা ইচ্ছে—ড্রেসআপ! শুরুতে বিতর্ক তুললেও তাদের এই বিদ্রোহী ভাবধারাটাও খুব মেনে নিল ইউএস অডিয়েন্স।
এদিকে পপের সঙ্গে রকের সংঘাত তখন তুঙ্গে। কিং প্রেসলি গাইছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর গানগুলো অনেকখানিই মেয়ে পটানো কথাবার্তায় ভরপুর। শ্রোতারা তখন ভিন্ন আমেজের স্বাদ পেয়েছেন। এই লড়াইয়ে তখন যোগ দিল ফোক। বব ডিলানের মতো শুদ্ধতাবাদীরা মার্কিন গানের শেকড় হিসেবে কান্ট্রি মিউজিককেই তাঁদের সত্যিকারের সত্তা বলে দাবি করলেন, ইলেকট্রিকের বদলে আঁকড়ে থাকলেন অ্যাকুস্টিক গিটারকেই।
ব্রিটেনেও একই ঝড়, তবে অন্য আঙ্গিকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলেও যুদ্ধ শেষ হয়নি। আণবিক বোমার মতো নৃশংস ইস্যুগুলোকে মানবিকতার প্রলেপ দিয়ে শ্রোতা টানতে তখন যুদ্ধবিরোধী লিরিকসে মোলায়েম কিছু গানের দলও জনপ্রিয়তা পেল। একটু বাম ঘেঁষাদের কাছে কদর পাওয়া এসব গায়কের আরও আপত্তি ছিল ব্রিটেনের শ্রেণিবৈষম্যে। পাশাপাশি মার্কিন বর্ণবাদের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলল তাদের দ্রোহী কণ্ঠস্বর। লিজেন্ডারি সায়মন অ্যান্ড গারফাঙ্কেল এই ঘরানার। আর রক অ্যান্ড রোলকে তাঁরা মানতেন ‘কমার্শিয়াল পপ’ হিসেবে।
একই সময় সংগীত এবং তরুণ সমাজে ড্রাগের অনুপ্রবেশ। রক অ্যান্ড রোলারদের আউলে দিল এলএসডির মাতাল মৌতাত। এ সুবাদেই জন্ম সাইকেডেলিয়ার। সে প্রসঙ্গে একটু পরে বলছি। তার আগে জানিয়ে রাখি শুধু বিটলস বা রোলিং স্টোনস নয়, ষাটের মাঝামাঝি ‘দ্য অ্যানিমেলস’ ও ‘দ্য ইয়ার্ড বার্ডস’ও তুমুল জনপ্রিয়তা পেল আলাদা ধারার গানে—দ্য নিউ মড স্টাইল। এদেরই উত্তরসূরি ‘হু’। কনসার্টে গান শেষে গিটার ভাঙার মতো পাগলামি দিয়ে নতুন এক ট্রেন্ড জন্ম দিল তারা।
বিটলস ও অন্য ব্রিটিশ রকাররা তখন আমেরিকান গানের জগতে বড় এক প্রভাবক হিসেবে তুমুল পরাক্রম। তো তাদের অনুকরণে কিছু গ্রুপ গড়ে উঠেছিল সে দেশে। ইন্সট্রুমেন্টের বাড়াবাড়িরকম ব্যবহারের পাশাপাশি উঁচু ভোকাল ছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। এ ধারাটাই পরে ব্যাপ্তি পায় ‘পাঙ্ক রক’ বা ‘গ্যারাজ রক’ নামে। শুরুতে অন্যদের গাওয়া গানকেই একটু অন্য রকম করে গাইত এই ঘরানার ব্যান্ডগুলো। বর্তমানে তোমরা যেটাকে বলো ‘রিমিক্স’, সেই ধারণাটার জন্ম তখনই। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত ব্যান্ডগুলো ছিল ‘দ্য সনিকস অ্যান্ড দ্য মিস্টেরিয়ানস’ এবং ‘স্ট্যান্ডেলস’।