গুণীজন
যেভাবে জন্ম স্পাইডার–ম্যানের
মার্কিন কমিক বই লেখক ও মার্ভেল কমিকসের সাবেক প্রেসিডেন্ট স্ট্যান লি। স্পাইডার–ম্যান, এক্স–মেন, হাল্ক, আয়রনম্যান, ডক্টর স্ট্রেঞ্জের মতো দুনিয়াকাঁপানো সব চরিত্রের অন্যতম স্রষ্টা তিনি। পড়ো এক সুপারহিরো কারিগরের জীবনের গল্প। স্ট্যান লির বক্তৃতা অবলম্বনে লিখেছেন মো. সাইফুল্লাহ।
স্পাইডার–ম্যানের গল্প শুনে প্রকাশক বলেছিলেন—সবচেয়ে বাজে আইডিয়া
আমি বড় হয়েছি নিউইয়র্ক শহরে। খুব ছোটবেলার স্মৃতি যখন স্মরণ করি, চোখে একটাই দৃশ্য ভাসে—বাড়িভাড়ার টাকা জোগাড় করতে না পেরে মা-বাবা হতবিহ্বল হয়ে বসে আছেন। আমাদের কখনো ঘরছাড়া হতে হয়নি, সেটাকে একটা সৌভাগ্যই বলতে হবে। তবে বাবাকে বেশির ভাগ সময় বেকার থাকতে দেখেছি। অতএব, হাইস্কুলে পড়ার সময়ই আমাকে কাজের সন্ধানে নামতে হয়েছিল।
আমার মায়ের চেয়ে ভালো মা আর হয় না। তাঁর ধারণা ছিল, পৃথিবীর দোপেয়ে প্রাণীগুলোর মধ্যে আমিই সেরা! যদি স্কুলে ছোট্ট একটা রচনা লিখতাম, মা দেখে বলতেন, ‘চমৎকার! তুমি তো আগামী দিনের শেক্সপিয়ার!’ ফলে খুব ছোটবেলায়ই যা হওয়ার, তা-ই হলো। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, আমি সব পারি!
মার্টিন গুডম্যান ছিলেন আমার কাজিনের স্বামী। তিনি টাইমলি পাবলিকেশনস নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ‘কমিক বুক’ বিভাগে কাজের জন্য তারা একজন সহকারী খুঁজছিল। আমি ভাবলাম, যোগ দিয়েই দেখি। তখন এই বিভাগে দুজন কাজ করতেন। সম্পাদক জো সিমন ও আঁকিয়ে জ্যাক কারবি। তাঁরা তখন ক্যাপ্টেন আমেরিকা চরিত্রটা নিয়ে কাজ করছিলেন। আর আমি? আমার কাজ ছিল কলমে কালি ভরা, নিচে গিয়ে খাবার কিনে আনা আর প্রুফ রিড করা।
টনাক্রমে সিমন আর কারবির চাকরি চলে গেল। কমিক বুক বিভাগটা চালানোর জন্য মার্টিনের হাতে তখন আর কেউ ছিল না। মার্টিন বলল, ‘তুমি কি দায়িত্বটা নিতে পারো?’ ১৭ বছর বয়সে কোনো কিছুই অসম্ভব মনে হয় না। সুতরাং আমি বললাম, ‘পারব।’
নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার স্বাধীনতা পেলাম। আমার বেশ লাগত। শুধু কেউ যখন এসে জিজ্ঞাসা করত, ‘এই যে খোকা, সম্পাদক সাহেব কি আছেন?’ খুব লজ্জা পেতাম!
ফ্যান্টাস্টিক ফোর
মার্টিন আমার দেখা সবচেয়ে অনুকরণপ্রিয় মানুষ। তিনি অন্ধের মতো অন্যের সাফল্য অনুকরণ করতেন। বাজারে কী চলছে? হরর গল্প? রহস্য গল্প? যুদ্ধের গল্প? অন্যরা যা করছে, মার্টিনেরও তা-ই করা চাই। কিন্তু আমি নিজের মতো কিছু করতে চাইতাম।
চাকরিজীবনের ২০ বছর পর একদিন স্ত্রীকে বললাম, ‘এভাবে আসলে চলছে না। ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।’ আমার স্ত্রী তখন আমাকে জীবনের সেরা উপদেশটা দিল, ‘এক কাজ করো। মার্টিনের কথার তোয়াক্কা না করে তুমি নিজের ইচ্ছেমতো একটা কিছু করো। কী আর হবে? বড়জোর সে তোমাকে চাকরিচ্যুত করবে। তুমি তো এমনিতেও চাকরিটা ছাড়তেই চাইছ।’ তখন ডিসি কমিকসের একটা বই ছিল—জাস্টিস লিগ, একদল সুপারহিরোর গল্প। বেশ ভালো চলছিল বইটা। তাই ১৯৬১ সালে আমরা শুরু করলাম দ্য ফ্যান্টাস্টিক ফোর। আমি চরিত্রগুলো একটু অন্য রকম করতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এমন সব চরিত্র তৈরি করতে, যাদের জীবন বাস্তবসম্মত আবেগ, সমস্যায় জর্জরিত। বইটা পাঠকের নজরে এল। একে একে বাজারে আনলাম এক্স–মেন, দ্য হাল্ক। আমরা আর এমন একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকলাম না, যেটা স্রেফ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুকরণ করে।
যেভাবে স্পাইডার–ম্যানের জন্ম
আমি যখন কাজ শুরু করি, সুপারম্যান তত দিনে তৈরি হয়ে গেছে। হিউম্যান টর্চ, সাব-মেরিনার, ফাদার টাইম, হারিকেনের মতো বাজারে বেশ কিছু চরিত্র ছিল। তখন প্রচ্ছদকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো। ধরে নেওয়া হতো, প্রচ্ছদ আর নাম দেখেই পাঠক বইটা কিনবে। হারিকেন চরিত্রটা খুব জোরে দৌড়াতে পারত। একসময় আমি নতুন সুপারহিরো তৈরির দিকে মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ ভাবলাম, দেয়ালে হাঁটতে পারে, এমন একটা চরিত্র তৈরি করলে কেমন হয়? কোন নামটা মানুষকে আকর্ষণ করবে? মসকিউটো ম্যান? ফ্লাই ম্যান? নাহ্, কোনো নামই পছন্দ হচ্ছিল না। সব শেষে যে নামটা বেছে নিলাম, সেটা...স্পাইডার–ম্যান!
আমরা তত দিনে ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ নিয়ে কাজ করেছি, মনে হয় ‘এক্স–মেন’ও বাজারে এসেছিল। যত দূর মনে পড়ে আমার প্রকাশক এসে বলেছিল, ‘স্ট্যান, আমি চাই তুমি একজন নতুন সুপারহিরো তৈরি করো।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’ প্রকাশককে তো আর না করতে পারি না। চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে!
বাড়িতে ফিরে ভাবতে শুরু করলাম, কী করা যায়। একজন সুপারহিরোর মূল বৈশিষ্ট্যই হলো তার ‘সুপারপাওয়ার’। ‘সুপারপাওয়ার’টা কী হবে, সেটা ঠিক করে ফেলতে পারলে বাকিটা এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ দেখলাম, দেয়ালে একটা মাছি হাঁটছে। মনে হলো, আরে! আমি যদি এমন একজন সুপারহিরো তৈরি করতে পারি যে দেয়াল বেয়ে উঠতে পারে, তাহলে দারুণ হয়! বেশ। এখন এই নতুন সুপারহিরোর জন্য একটা নাম দরকার। ফ্লাইম্যান, মসকিউটোম্যান, এমন নানা কিছু ভাবতে ভাবতে অবশেষে ঠিক করলাম—স্পাইডার–ম্যান! ব্যস, আমি আমার সুপারহিরো পেয়ে গেলাম। তার বিশেষ ক্ষমতা পেয়েছি, নাম পেয়েছি। এবার তার জীবনে কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ঢেলে দেওয়া দরকার। তোমরা যেমন একটা চমৎকার জীবন পেয়েছ, বেশির ভাগ মানুষের এই সৌভাগ্য হয় না। সবার জীবনই নানা সমস্যায় জর্জরিত। ঠিক করলাম, স্পাইডার–ম্যান হবে একজন টিনএজ সুপারহিরো। কারণ, সে সময় যত দূর মনে পড়ে, কোনো টিনএজ সুপারহিরো ছিল না। অতএব এই অসাধারণ আইডিয়া নিয়ে আমি ছুটে গেলাম আমার প্রকাশকের কাছে।
প্রকাশক বলল, ‘আমি জীবনে যত আইডিয়া শুনেছি, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে বাজে!’ সে আমাকে যুক্তি দিতে শুরু করল, ‘মানুষ মাকড়সা ঘৃণা করে। অতএব তুমি একজন হিরোকে মাকড়সা-মানব নাম দিতে পারো না। তুমি চাও সে টিনএজার হোক? টিনএজাররা বড়জোর পার্শ্বচরিত্র হতে পারে। আর তুমি তার জীবনে ব্যক্তিগত সমস্যা দিতে চাও! ওহ্ স্ট্যান, তুমি জানো না সুপারহিরোদের কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে না?’ অতএব বেশ খানিকটা জ্ঞান এবং হতাশা নিয়ে আমি তাঁর অফিস ত্যাগ করলাম।
কিন্তু আমার মাথা থেকে স্পাইডার–ম্যান দূর হচ্ছিল না। তখন আমরা একটা ম্যাগাজিনের শেষ সংখ্যার কাজ করছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, ম্যাগাজিনটির নাম ছিল অ্যামাজিং ফ্যান্টাসি। ম্যাগাজিনটা ভালো চলছিল না। আমরা ওটা বন্ধ করে দেব ঠিক করেছিলাম। তখন ম্যাগাজিনটার শেষ সংখ্যা প্রেসে যাচ্ছে, অতএব কী ছাপা হচ্ছে, তাতে কারও কিছু যায়–আসে না। এই সুযোগই কাজে লাগালাম। আমি স্পাইডার–ম্যানকে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তুলে আনলাম।
এক মাস পর প্রকাশক পড়িমরি করে আমার কাছে ছুটে এল। বলল, ‘স্ট্যান! স্ট্যান! তোমার মনে আছে সেই চরিত্রটার কথা, যেটা তুমি আর আমি দুজনই ভীষণ পছন্দ করেছিলাম! সেই যে স্পাইডার–ম্যান! চলো, আমরা স্পাইডার–ম্যানের একটা সিরিজ চালু করি।’
এই গল্প তোমাদের কেন বলছি? তোমাদের সময় নষ্ট করা ছাড়া এই গল্প বলার আর কী উদ্দেশ্য? আমি বলতে চাইছি—তোমার মাথায় যদি একটা আইডিয়া থাকে এবং তুমি যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করো যে এটা একটা দারুণ আইডিয়া, তাহলে কোন গর্দভ কী বলল, তাতে কিছু যায়–আসে না। তার মানে এই নয় যে তোমার মাথায় যত উদ্ভট আইডিয়াই আসুক, সেটা ভালো কিছুই হবে। যদি আইডিয়াটার মধ্যে তুমি একটা কিছু খুঁজে পাও, যদি এটা তোমাকে আন্দোলিত করে, চেষ্টা করো। কারণ তুমি যা চাও, তা করতে পারলেই তুমি তোমার সেরাটা দিতে পারবে। ভেবো না তোমার সব ভাবনাই ভালো হবে, সব ভাবনার জন্য তুমি পুরস্কার জিতবে। আমি এমন অনেক কিছু ভেবেছি, যেটা থেকে শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু দাঁড়ায়নি। সেই ভাবনাগুলো নাহয় তোমরা এরপর আমাকে যেই পুরস্কারটা দেবে, সেটার জন্য তোলা থাক!
সবচেয়ে বড় ‘সুপারপাওয়ার’
আমি সব সময় বিশ্বাস করি, ‘সৌভাগ্য’ হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। কারও ভাগ্য ভালো হলে ভিলেনের গুলি তার কাছে ঘেঁষবে না, অনায়াসে সে যেকোনো রহস্য সমাধান করে ফেলবে। সৌভাগ্যের চেয়ে বড় ‘সুপারপাওয়ার’ আর কী হতে পারে? যদিও ‘লাকিম্যান’–এর কস্টিউম কেমন হবে, সেটা ভেবে বের করতে পারিনি।
আমি তোমাদের জন্য পৃথিবীর সেরা সৌভাগ্য কামনা করি। যা-ই করো না কেন, নিজের সেরাটা দাও।
ভালো আর খারাপের যুদ্ধ—এই গল্প মানুষের সব সময় প্রিয়। গল্পের শেষে তারা সব সময় ‘ভালো’র জয় দেখতে চায়। আমি মনে করি, পৃথিবীর এখন একজন নায়ক প্রয়োজন। ‘সুপারহিরো’ হতে হবে, সেটা বলছি না। ‘হিরো’ হলেই চলবে। যদি ইতিহাস দেখো, দেখবে মন্দ শক্তিটার সব সময় ‘সুপারপাওয়ার’ ছিল। সাধারণ মানুষই ‘সুপারপাওয়ার’কে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে।