বিটিএস কি জনপ্রিয়?

বিটিএস–এর সদস্যরা

সব কটি চোখ একসঙ্গে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। ওদের চোখে বিস্ময়, কারও কারও চোখে অবিশ্বাস। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পিনপতন নীরবতা। খানিক বাদে একজন কোনোমতে প্রশ্ন করল, ‘তুমি বিটিএসের গান শোনো?’

ঘটনা আর কিছুই না। আড্ডার একপর্যায়ে আমি শুধু বলেছিলাম, বিটিএসের গান শুনি। ব্যস! অমনি কয়েকজন এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, যেন এইমাত্র একটা স্পেসশিপ নিয়ে মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এলিয়েন নেমে এসেছে।

আমার কথার পর দুটি দল হয়ে গেল। এক দলের মন্তব্য, বিটিএসের গান শোনার কী আছে? আরেক দলের যুক্তি, গানের কোনো ভাষা নেই। কাজেই যে কেউ চাইলে বিটিএসের গান পছন্দ করতে পারে।

যারা একটু হলেও কোরিয়ান পপ মিউজিকের সঙ্গে পরিচিত, তারা হয়তো বিটিএস ব্যান্ডের নাম শুনে থাকবে। সাত সদস্যের দলটির পুরো নাম ‘ব্যাংতান সোনিয়ন্দন’। যার অর্থ, বুলেটপ্রুফ বয় স্কাউট। প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপরীতে তাদের শক্ত অবস্থান, সে জন্যই এমন নাম। কোরিয়ান অনেক ব্যান্ড আছে, কিন্তু তাদের নিয়ে এত মাতামাতি নেই। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বিটিএস নিয়ে এত বিতর্ক কেন? চলো জেনে নিই কেন বিটিএসকে নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা!

ভক্ত যখন আর্মি

ব্যাংতান বয়েজের সদস্যরা টুইটারে অনেক বেশি সক্রিয়। তারা পরিচিত ‌‌'বিটিএস আর্মি' নামে। টুইটারে অনুসরণকারী এই আর্মির সংখ্যা ৩১ মিলিয়নের বেশি। ২০১৭ সালে তারা গিনেস বুক রেকর্ড করে তারকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ রিটুইট পেয়ে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সংগীততারকা জাস্টিন বিবারের রিটুইটকে পেছনে ফেলে এই রেকর্ড করে বিটিএস। তাই সবার দৃষ্টি পড়ে ব্যান্ডটির ওপর। কেউ কেউ মনে করে, ভক্তদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখাটাই বিটিএসের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। এর ফলাফল দেখা যায় ২০১৭ সালের বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে। টপ সোশ্যাল আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর থেকেই তাদের নিয়ে আলোচনা বেড়ে যায়। এক দিকে বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়া প্রথম কোরিয়ান ব্যান্ড হিসেবে, আরেক দিকে পশ্চিমাদের মধ্যে বিশাল এক অংশ বিটিএস আর্মি তৈরি হওয়ায়—সব মিলিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে বিটিএস।

‘টাইম’ ম্যাগাজিন আর ‘ফোর্বস’–এর তালিকা

বিটিএসের যতই সমালোচক থাকুক, টাইম ম্যাগাজিন ২০১৭ সালে ইন্টারনেটে সেরা ২৫ উদ্বুদ্ধকারীর নামের তালিকায় স্থান দেয় বিটিএসকে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ২০১৮ সালে ম্যাগাজিনটির 'নেক্সট জেনারেশন লিডারস'-এর তালিকায়ও স্থান পায় ব্যান্ডটি। একই বছর ফোর্বস কোরিয়া পাওয়ার সেলিব্রিটির তালিকায় বিটিএসের নাম আসে একেবারে শীর্ষে! ২০১৯ সালে ‘ব্ল্যাকপিংক’-এর কাছে প্রথম স্থানটি হারালেও ২০২০ ও ২০২১ সালে আবারও সেটি ফিরে পায় তারা। এই তীব্র জনপ্রিয়তার জন্যই যেন বিটিএসকে নিয়ে আলোচনা থামছেই না!

জনপ্রিয়তাই সবকিছু নয়

মনে আছে, একবার সেভেরাস স্নেইপ ক্লাসে টানা প্রশ্ন করেন হ্যারি পটারকে। আর একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না হ্যারি? স্নেইপ তখন মন্তব্য করেন, ‘জনপ্রিয়তাই সবকিছু নয়!’ ঠিক তেমনি বিটিএসের ব্যাপারেও এমন ধারণা পোষণ করেন অনেক সংগীতপ্রেমী। কারও কারও মতে, বিটিএস গানের দিকে আরও মনোযোগী না হলে তাদের নিয়ে তৈরি হওয়া ‘হুজুগ’ শিগগিরই কেটে যাবে। বিলবোর্ড টপ চার্টে এক সপ্তাহ পার হতেই যাদের গান তালিকা থেকে ছিটকে ৬৭ নম্বরে চলে যায়, তাদের গান নিয়ে মাতামাতিকে হুজুগই বলেন কেউ কেউ। তবে এই সমালোচকেরা হুজুগ বললেও বর্তমানে বিলবোর্ড টপচার্টের এক নম্বরে কিন্তু বিটিএসের গানই আছে, তাও আবার টানা ৫ সপ্তাহ ধরে।

বিটিএসের সাত সদস্য ভি, জাংকুক, জিমিন, সাগা, জিন, জে-হোপ ও আরএম।

নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা, আর গাইতে না জানলে...

কেপপ মিউজিকের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, ব্যান্ডের সদস্যরা গাওয়ার পাশাপাশি নাচের ক্ষেত্রেও সমান পারদর্শী হন। কিন্তু বিটিএস আর্মির বাইরে একটা বড় সংখ্যা মনে করে, বিটিএস সদস্যদের নাচ এমন কোনো আহামরি নয়, অন্য অনেক কোরিয়ান ব্যান্ড তাঁদের চেয়েও ভালো নাচে! আর বিটিএসের গানেরও সমালোচনা কম নয়। উঁচু স্কেলের সুর কিংবা র‌্যাপ মিউজিক নাকি ঠিকঠাক গাইতেই পারেন না দলটির সদস্যরা!

গানের কথা নিয়ে যত কথা

ভাষাটাই তো কোরিয়ান। কোরিয়ার বাইরে কজন মানুষই–বা সেটা বোঝে? তা–ও, সমালোচকেরা মনে করেন, বিটিএসের গানের কথাও নাকি খাপছাড়া এবং বেশির ভাগ গানের সারমর্মই নাকি এক, ভিন্নতা নেই। তবে সমালোচকদের এসব কথার প্রতিবাদ করেন আর্মিরা। তাঁদের মতে, গানের কোনো ভাষা নেই। যেকোনো মানুষ সুর শুনে গানকে আপন করে নিতে পারে।

পোশাক–আশাক

অনেকেই মনে করেন, কোরিয়ান ব্যান্ডকে পছন্দ না করার আরেক কারণ তাদের পোশাক–আশাক বা চেহারা। কোরিয়ান ব্যান্ড সদস্যদের সাজগোজ করার ব্যাপারটাও নেতিবাচকভাবে দেখেন কেউ কেউ। জাতিবৈষম্য খুব খারাপ বিষয়, তাই ভক্তরা এমন মানসিকতার পাল্টা সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, বিশ্বায়নের যুগে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানানো উচিত।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিটিএস-এর জনপ্রিয়তা যেমন আছে, সমালোচনাও আছে তেমনই। প্রায় ২ মিলিয়ন অ্যালবাম যাদের বিক্রি হয় বিশ্বব্যাপী, তাদের নিয়ে আলোচনা–সমালোচনা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই ‘ফ্যান’ এবং ‘হেটার’দের তর্ক-বিতর্ক চলছে, চলবেই।

তা চলুক, আমরা বরং আড্ডার কথায় ফিরে যাই আবার। সেই আড্ডায় এক জুনিয়র বেশ ভাব নিয়ে বলছিল, ‘আরে! বিটিএস গাইতে পারে নাকি!’

ওর কথা শুনে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘তা কোন গানটা শুনে তোর মনে হলো ওরা গাইতে পারে না?’

এবার সোজাসাপ্টা উত্তর দিল সে, ‘আমি তো ওদের কোনো গানই শুনি নাই। এমনিতেই ভালো লাগে না ওদের!’

তোমরা আবার ওর মতো গান না শুনেই কোনো মন্তব্য কোরো না যেন। মন্তব্য করার আগে বিটিএসের গান শুনে নেওয়াই ভালো। গান শোনার পর ভালো না লাগলে তুমি সমালোচনা করতেই পারো, সে অধিকার তোমার নিশ্চয় আছে। তবে গান যদি ভালো লেগে যায়, তাহলে কে জানে, তুমি হয়তো তাদের ভক্তও হয়ে যেতে পারো।

সিদ্ধান্তটা একান্তই তোমার।

তথ্যসূত্র: বিলবোর্ড ডটকম, ফ্যাক্ট সাইট ডটকম, অ্যামিনো অ্যাপস ডটকম