তোমার জীবনের প্রথম সুপারহিরো কে? এমন প্রশ্ন করলে দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই জবাব দেবে, ‘বাবা’! বাবাই যে সব সুপারহিরোর বাবা, সেটা সেই ছোটবেলাতেই সবাই টের পেয়ে যায় সহজেই! ছোটবেলায় তোমার কাছে যেটা অসম্ভব মনে হয়, সেটাই বাবা কত অনায়াসেই না করে ফেলেন! যখন ২ যোগ ৩ দশমিক ৫ গুণ ০ সমান কত হয়, সেই উত্তর বের করতে গিয়ে তুমি কোনো কিনারা না পেয়ে মাথা গরম করে ফেলো কিংবা চুরি করে আচার খেতে বয়ামের শক্ত মুখ খুলতে গিয়ে আটকে যাও, তখন বাবাকে দিলে তিনি কত সহজে তুড়ি মেরেই এসব সমস্যার সমাধান বের করে ফেলেন, সে তো তুমি জানোই! বাবা যখন শাসন করেন, একটু আধটু পিট্টিও লাগান, তখন নিশ্চয় রাগে তোমার এটাও মনে হয় যে বড় হলে আমিও বাবা হব! তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!
বড় হয়ে যে বাবার মতো হতে চাও তুমি, সেই বাবা কিন্তু রুপালি পর্দায় মোটেই ফেলনা নন! সিনেমার জগতে বাবাগিরিতেও তাঁদের উপস্থিতি সরব!
এই যেমন দ্য বাইসাইকেল থিফ সিনেমাটার কথাই ধরো। গল্প সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ইতালির। বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে ইতালির অবস্থা তখন তোমার পড়ালেখার দুর্বলতার থেকেও দুর্বল! সে সময় ইতালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা তোমার হোমওয়ার্কসের নম্বরের থেকেও করুণ। চারদিকে হাহাকার আর বেকারত্ব।
কাজের সন্ধানে মানুষের সে কী আহাজারি!
অ্যান্টনিও রিকি নামের এক লোকও আর সবার মতো একটা চাকরির সন্ধানে দিশেহারা। বউ আর দুই বাচ্চা নিয়ে তার সংসার। ভাগ্যগুণে অ্যান্টনিও বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার লাগানোর একটা চাকরি পেয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও থাকে শর্ত। চাকরিটা করার জন্য অ্যান্টনিওর নিজস্ব সাইকেল থাকা লাগবে।
ঘরে ঠিকমতো খাবার জোগাড়েরই পয়সা নেই আর সাইকেল আসবে কোথা থেকে? অ্যান্টনিও পড়ল মহাসমস্যায়। সমস্যার সমাধান হলো বিয়েতে পাওয়া দামি চাদরগুলো বিক্রি করে। সেই টাকায় সাইকেল কেনার পর ছয়-সাত বছর বয়সী বড় ছেলে ব্রুনোর সে কী আনন্দ! কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা কাটে না তবু! কাজে নামার প্রথম দিনেই চুরি যায় এত কষ্টে কেনা সাইকেলটা!
ব্রুনোদের জীবনে একপশলা রোদ ছুড়ে ফেলেই যেন ভাগ্যবিধাতার শীতল চোখের দিকে তাকিয়ে ডুবে যায় একটু ভালো থাকার শেষ সূর্যটাও। সাইকেল চুরি যাওয়ায় অ্যান্টনিও পড়ে মহাবিপদে। সাইকেল ছাড়া অনেক কষ্টে জোগাড় হওয়া একমাত্র চাকরিটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে যে! তখন বউ–বাচ্চাকে নিয়ে তো তার পথে বসতে হবে!
তাই বাপ-ছেলে মিলে নেমে পড়ে চুরি যাওয়া সাইকেল উদ্ধারের ক্ষীণ আশাকে চোখে ধারণ করে।
রোমের প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি গলিতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে ওঠে বাবা-ছেলে, কিন্তু চুরি যাওয়া সাইকেল কি আর সহজে মেলে?
চুরি যাওয়া সেই সাইকেলের পথ ধরেই এরপর এগোতে থাকে দ্য বাইসাইকেল থিফ–এর কাহিনি। লুইজি বার্তোলিনির উপন্যাস দ্য বাইসাইকেল থিফ–এর ওপর ভিত্তি করে ভিত্তোরিও ডি সিকারের পরিচালনায় ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় এই কালজয়ী সিনেমাটি। সিনেমা–শিল্পের ইতিহাসে এ সিনেমাটি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি সিনেমা। বাবাদের নিয়ে সিনেমা দেখতে বসলে অবশ্যই এই সিনেমাটা তোমাকে সবার আগে দেখে নেওয়া উচিত!
বাস্তবতায় মোড়া সিরিয়াস ঘরানার সিনেমা থেকে এবার নাহয় চলো বেরিয়ে আসা যাক সাগরতলের গভীর থেকে! জায়গাটা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। অবস্থান ক্যাঙ্গারুর দেশ অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র উপকূলে। এই রিফেই বাস করে এক ক্লাউন ফিশ। নাম তার মারলিন। কমলা আর সাদা রঙের এই ক্লাউন ফিশের জগৎ বলতে তার একমাত্র ছেলে নিমো। নিমো যখন ডিমের ভেতর থেকে সদ্য ছানা মাছ হিসেবে বের হওয়ার বয়সে পৌঁছেছিল, তখনই তার মা তাকে বাঁচাতে এক রাক্ষসে মাছের খোরাক হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
সেই ঘটনার পর নিমো যখন বড় হতে থাকে, তখন তার বাবা তাকে কখোনই চোখের আড়াল হতে দেয় না। তার মতে সমুদ্রটা গিজগিজ করছে যত সব রাক্ষসে খারাপ মাছে! তারা যেকোনো সময় নিমোকেও মেরে ফেলতে পারে! বাবার এ রকম অতিরিক্ত বাবাগিরিতে নিমো যারপরনাই ত্যক্ত-বিরক্ত!
একদিন ঘটে যায় বিরাট এক দুর্ঘটনা! ছোট্ট নিমো ধরা পড়ে এক ডুবুরির হাতে। ডুবুরি নিমোকে ধরে নিয়ে স্পিডবোটে করে উধাও হয়ে যায় নিমেষে!
নিমোকে হারিয়ে বাবা মারলিনের অবস্থা পাগলপ্রায়! সারা জীবন গভীর সমুদ্রকে ভয় পাওয়া ছোট্ট ক্লাউন ফিস মারলিন ছোট্ট মাছটি থেকেও হয়ে ওঠে সাহসী একজন বাবা। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে উদ্ধার করতে বিরাট সমুদ্রে শুরু হয় তার অসাধারণ এক অভিযানের! বিরাট এবং ভয়ংকর সমুদ্রে ছোট্ট একটা ক্লাউন ফিস কি পারবে তার একমাত্র সন্তান নিমোকে খুঁজে বের করতে? যদি পারেও, তবে সেটা কীভাবে?
জানতে হলে তোমাকে দেখে নিতে হবে ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ফাইন্ডিং নিমো নামের পিকচার অ্যানিমেশনের অসাধারণ এই অ্যানিমেশন সিনেমাটি। সিনেমার অ্যানিমেশনের কাজ এতই চমৎকার যে সমুদ্রের তলদেশের দৃশ্য প্রথমবার করার পর এতই নিখুঁত হয়েছিল যে সেটাকে পুরোপুরি বাস্তব মনে হওয়ায় পর অ্যানিমেটররা আবার অ্যানিমেশন করে পুনরায় সমুদ্রের তলদেশ নতুন করে নির্মাণ করেন, যাতে দর্শকেরা এটাকে আসল সমুদ্র ভেবে বিভ্রান্ত না হন।
যেখানে অ্যাকুরিয়ামে রাখার জন্য কেউ ক্লাউন ফিশ কিনতেই চাইত না, সেখানে এই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর ক্লাউন ফিশের চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে এর দাম কয়েক গুণ বেশি হয়ে ওঠে নিমেষেই!
এবার বাবা–ছেলেকে নিয়ে একটা সায়েন্স ফিকশন সিনেমার গল্প করা যাক। সময়টা ২০২০ সাল। বক্সিংয়ে তখন মানুষের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে রোবট! বক্সিং রোবটে করে, আর পেছন থেকে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে কোনো মানুষ। এ রকম বক্সার রোবট নিয়ন্ত্রণ করে চার্লি ক্যানটন। চার্লি ছিল সাবেক এক বক্সার। কিন্তু ভাগ্যদেবীর কৃপা না পেয়ে এ ক্ষেত্রে তার ভাগ্য কখনো সুপ্রসন্ন হয়নি খুব একটা।
চার্লি একদিন খবর পায় তার সাবেক প্রেমিকা মারা গেছে, রেখে গেছে তাদের ১১ বছর বয়সী ছেলে ম্যাক্সকে! ম্যাক্সের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের শুনানিতে চার্লিকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। এরপর তিন মাসের জন্য চার্লির সঙ্গেই ঠাঁই হয় ম্যাক্সের। যদিও ছেলেকে সঙ্গে রাখার কোনো ইচ্ছাই ছিল না চার্লির। তবু বাধ্য হয়েই ম্যাক্সকে সঙ্গে নেন তিনি। বাপ-ছেলে মিলে বক্সার রোবট বানানোর জন্য রোবটের পার্টস খুঁজতে গিয়ে একদিন এক ভাগাড়ে খুঁজে পায় একটা ধ্বংসপ্রায় আস্ত রোবট! বাবা-ছেলে মিলে সেই রোবটকে বানিয়ে ফেলে সত্যিকারের বক্সার রোবট। নাম দেয় অ্যাটম! অ্যাটমকে নিয়ে চার্লি ধীরে ধীরে জয় করতে শুরু করে একের পর এক বক্সিংয়ের ম্যাচ। আর এর ভেতর দিয়েই ধীরে ধীরে দৃঢ় হতে থাকে বাবা-ছেলের সম্পর্ক। কীভাবে? সেটা জানতে হলে তোমাকে দেখে নিতে হবে ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া রিয়েল স্টিল সিনেমাটি।
সিনেমার গল্প নেওয়া হয়েছে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত রিচার্ড ম্যাথসনের লেখা সায়েন্স ফিকশন গল্প ‘স্টিল’ থেকে। সিনেমাটি দেখতে বসে রোবটদের অসাধারণ বক্সিংয়ের সঙ্গে কখন যে তুমি বাবা-ছেলের আদুরে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে, টেরও পাবে না!
এগুলোর বাইরেও বাবা-সন্তানের গল্প নিয়ে আরও অসংখ্য সিনেমা রয়েছে। তার ভেতর দেখে নিতে পারো ডেসপিকেবল মি (২০১০), দ্য পারসুইট অব হ্যাপিনেস (২০০৬), জারসি গার্ল (২০০৪), দ্য ক্রুডস (২০১৩), লাইফ ইজ বিউটিফুল (১৯৯৭), দ্য কিড (১৯২১), দেয়ার উইল বি ব্লাড (২০০৭), উড়ান (২০১০), আ ট্রি গ্রোস ইন ব্রুকলিন (১৯৪৫), ব্লিডিং স্টিল (২০১৭), ওয়্যার অব দ্য ওয়ার্ল্ড (২০০৫), ফ্লাই অ্যাওয়ে হোম (১৯৯৬), আফটার আর্থ (২০১৩), নিম’স আইল্যান্ড (২০০৮) ইত্যাদি।