একজন অভিনেতার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ কোনটি? প্রশ্নটা কঠিন মনে হলেও উত্তরটা খুব সহজ, মানুষকে হাসানো। মুখ টিপে হাসা নয়, যে হাসিতে জীবনের সব কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়, নতুন কিছু করার প্রেরণা পাওয়া যায় তেমন হাসি হাসানো। সারাটা জীবন রবিন উইলিয়ামস সেই কাজটিই করে গেছেন, মানুষকে খাঁটি হাসি হাসিয়েছেন তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা দিয়ে, কণ্ঠের জাদু দিয়ে। রবিন উইলিয়ামস কে? কেনই-বা তাঁকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে তাই ভাবছ তো? রবিন উইলিয়ামস ছিলেন এই পৃথিবীর সবচেয়ে মজার মানুষ। ছিলেন বলছি, কারণ গত ১১ আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
রবিন উইলিয়ামসকে বলা চলে কমেডি ছবির জাদুকর, জাদুর যন্তর-মন্তরটা যিনি নিজের হাতে গড়ে নিয়েছেন। অভিনয়জীবনের শুরুটা করেছিলেন সিরিয়াস অভিনেতা হিসেবে, জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে তিনি চলচ্চিত্রজীবনে নতুন অধ্যায় শুরু করেন, ঝুঁকে পড়েন শিশুদের জন্য মজার চরিত্রে অভিনয় করার প্রতি। শিশুদের আনন্দ দেওয়া কষ্টের কাজ, আর এই কাজটিই তিনি করেছেন সবচেয়ে নিখুঁতভাবে। পপাই, হুক, আলাদিন, টয়েস, মিসেস ডাউটফায়ার, ফ্লাবার, জুমানজি, হ্যাপি ফিট, নাইট ইন দ্য মিউজিয়ামে তাঁর অনবদ্য অভিনয় ছবিগুলোকে শুধু শিশুদের সীমানায় আটকে থাকেনি, সব বয়সের দর্শকের কাছে পেয়েছে সমান গ্রহণযোগ্যতা। রবিন উইলিয়ামস খুব ভালো কণ্ঠ অনুকরণ করতে পারতেন, একসঙ্গে অনেক কণ্ঠে কথা বলতে পারতেন। একবার এক অনলাইন পত্রিকাকে ১৫ মিনিটে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কথা বলেছিলেন ১৫ রকম কণ্ঠে। আর তাই তিনি যে অ্যানিমেশন ছবিতে কণ্ঠ দেবেন সেটা তো সহজেই বোঝা যায়। ১৯৯২ সালের অ্যানিমেশন ছবি আলাদিন-এ তিনি চেরাগের নীল দৈত্য জিনির কণ্ঠ দিয়েছিলেন। এই ছবিতে তিনি অনুকরণ করে শুনিয়েছিলেন অনেক তারকাশিল্পীর কণ্ঠ। জাদুর প্রদীপে ঘষা দেওয়ার পর গোলাপি-নীল-সোনালি আতশবাজির মধ্য দিয়ে দৈত্যের আগমন, এই দৃশ্য বারবার দেখলেও পুরোনো হয় না। আলাদিনের চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল বিশেষভাবে উইলিয়ামসের জন্য, যদিও তিনি প্রথমে এতে কাজ করতে রাজি হননি। এই ছবিতে তাঁর অনবদ্য কণ্ঠের জন্য সেই বছর গোল্ডেন গ্লোব শুধু তাঁকে সম্মান দিতে তৈরি করেছিল একটি বিশেষ সম্মাননা পদক। এ ছাড়া অ্যানিমেটেড ছবি ফার্নগালি দ্য লাস্ট রেইনফরেস্ট, রোবটস, হ্যাপি ফিট-এও কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনি।
রবিন উইলিয়ামসের জীবনের একটি সেরা কাজ বলা যায় মিসেস ডাউটফায়ার-কে। এই ছবিটিকে বলা হয় সর্বকালের সেরা একটি পারিবারিক ছবি। এখানে তাঁর চরিত্রের নাম ড্যানিয়েল, স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সন্তানদের কাছাকাছি থাকার জন্য যে ভারী মেকআপে মুখ ঢেকে, নকল চুল লাগিয়ে, নিজেকে মোটা মহিলা সাজিয়ে একজন ইংরেজ ন্যানির ছদ্মবেশ নেয়। জুমানজি ছবিতে রবিন উইলিয়ামস ছোট্টটি থেকে আটকা পড়ে আছেন একটি বোর্ড গেমে, যে কখনো বাস্তব জীবনে বাস করেনি। ফ্লাবার ছবিতে তাঁর চরিত্র একজন প্রফেসরের, যে ল্যাব চালাতে গিয়ে কাজের চাপে হিমশিম খেয়ে শেষ পর্যন্ত জাদুর খপ্পরে পড়ে। নাইট ইন দ্য মিউজিয়াম ছবিতে তিনি সেজেছিলেন থিয়োডর রুজভেল্ট।
রবিন উইলিয়ামস খালি বয়স আর শরীরটাতেই বেড়েছিলেন, মনের ভেতরে আসলে ছিলেন শিশু। শখ ছিল সাইকেল চালানো, গেম খেলা। নিজের মেয়ে জেলডা আর ছেলে কডির নামও রেখেছিলেন তিনি গেম-এর চরিত্র থেকে নিয়ে। শুধু ছবিতেই নয়, বিভিন্ন সময় মানুষের পাশে এসে তাদের দুঃসময়ে আনন্দ দেওয়ার ভারটাও যেন তুলে নিয়েছিলেন নিজের কাঁধে। অভিনেতা ক্রিস্টোফার রিভ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গুরুতর আহত ও পঙ্গু হওয়ার পর রবিন তাকে সান্ত্ব্তনা দিতে গিয়েছিলেন মুখ মাস্কে ঢেকে, ডাক্তার সেজে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রিভস এই কাণ্ড দেখে দুর্ঘটনার পর প্রথম হেসেছিলেন। এ ছাড়া অভিনয়ের ফাঁকে তিনি জড়িত ছিলেন বিভিন্ন দাতব্য কাজে। মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত কিশোরী জেসিকা কোলের জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল রবিনের সঙ্গে দেখা করা, তার সেই ইচ্ছা পূরণ করতে তিনি ব্যক্তিগত বিমান নিয়ে উড়ে গিয়েছিলেন জেসিকার বাড়িতে।
রবিন উইলিয়ামস আজীবন মানুষকে শুধু খুশি করেই গেছেন, নিজের জীবনের সুখের দিকে খুব একটা তাকাননি। শেষের দিকে বিষণ্নতা ও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। এই কারণেই হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিনি। সারা জীবন মানুষকে আনন্দ দিয়ে যাওয়া রবিনের নিজের ভেতর যে এত দুঃখ লুকিয়ে ছিল, তা কেই-বা ধরতে পেরেছিল?