‘আমরা ভেবেছিলাম, এভাবে ব্যান্ড করার আর কোনো মানে হয় না।’
শুরুর দিকের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিজেদের ভাবনার কথা মনে করতে গিয়ে বলছিলেন আফটারম্যাথ ব্যান্ডের ভোকাল নাভিদ। ‘বাসা থেকেও বলছিল, কত দিন আর এসব ছেলেমানুষী করব। কিন্তু আমাদের ভেতরে জেদ ছিল।’
এই জেদ না থাকলে শুরুতেই ঝরে যেত অল্টারনেটিভ গ্রাঞ্জ রক ঘরানার ব্যান্ড আফটারম্যাথ। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁদের প্রথম অ্যালবামের নামও জেদ। এরই মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলেছে অ্যালবামের গানগুলো। ২৫ ডিসেম্বর ইউটিউবে মুক্তি পায় এই অ্যালবামের প্রথম গান ‘হুংকার’। তারপর প্রতি সপ্তাহে দুটো করে গান মুক্তি দিয়েছে আফটারম্যাথ। খুব দ্রুতই মুক্তি পাবে জেদ অ্যালবামের শেষ গান ‘অস্পৃহ’।
এত দিন অনেকটা অস্পৃহই ছিল আফটারম্যাথ। শো হচ্ছিল, চলছিল নিয়মিত অনুশীলন। কিন্তু অ্যালবামের প্রসঙ্গে ‘আসছে’ কথাটা বলতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অ্যালবাম নেই বলে উপহাসও করেছে অনেকেই। কারণ, আফটারম্যাথের যাত্রা শুরু সেই ২০০৭ সালে। তখন ব্যান্ডের সদস্যদের কেউ পড়তেন এ লেভেল, কেউ ছিলেন এইচএসসি পড়ুয়া। তাঁদের গান শুনে মানুষের মধ্যে কেমন প্রভাব পড়বে, এর ফলাফল কী, সেটা ভেবেই আফটারম্যাথ নামটি রেখেছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম। ২০০৮-এ মুক্তি পেয়েছিল ব্যান্ডটির প্রথম গান ‘সূর্যাপেক্ষা’। এক বছর পর আরেকটি গান ‘মাটির রোদ’।
মূলত ‘মাটির রোদ’ গানটাই হুংকার দিয়ে জানায়, বাংলাদেশে অন্য গান শোনাতে আসছে আফটারম্যাথ। ‘মাটির রোদ শুনেই আমরা ভেবেছিলাম, আফটারম্যাথ অনেক দূর যাবে’, জানালেন আফটারম্যাথের গিটারিস্ট আসিফ। ২০০৮-এ তিনি ছিলেন আফটারম্যাথ–ভক্ত এক কিশোর! আসিফ তখন কল্পনাও করেননি একদিন গিটার হাতে তিনিও এগোবেন আফটারম্যাথের সঙ্গে।
কিন্তু এগোতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়েছে আফটারম্যাথ। ব্যান্ডে স্থিতিশীলতা আসছিল না। ‘মাটির রোদ’-এর পর ‘মোহ’ গানটি দিয়ে ভক্তদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয় আফটারম্যাথ। কিন্তু অনেক কিছুই মিলছিল না ব্যাটে-বলে। ব্যক্তিগত কিংবা পেশাগত কারণে ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন শুরুর দিকের সদস্য সন্ধি, সৈকত, ব্রেন্টন। একটা লম্বা সময় শুধু ফাহিম, সাকিব আর নাভিদ—এই তিনজন নিয়েই এগোচ্ছিল আফটারম্যাথ। অনিশ্চয়তার ধোঁয়া গ্রাস করেছিল তখনই।
২০১৪ সালে আফটারম্যাথে যোগ দেন মুনতাসির। তিনি তখন বেজ বাজাতেন ডিস্টর্টেড নামের একটি ব্যান্ডে। তাঁর হাত ধরেই আফটারম্যাথে আসেন একই ব্যান্ডের গিটারিস্ট আসিফ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আফটারম্যাথকে। সবার রসায়নটা এত চমৎকার হয়ে উঠল যে ব্যান্ডের লাইনআপ নিয়ে ভাবতে হয়নি আর। ভোকাল নাভিদ বলেন, ‘এটাই আমাদের লাইনআপ। এখন আমরা জানি আমাদের সাউন্ড কোনটা।’ এই পাঁচজন একই সঙ্গে বাজাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। ব্যান্ডের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনেও একে অপরের বোঝাপড়া দারুণ এই পাঁচজনের। এই পাঁচজনই আফটারম্যাথ।
তবে স্থিতিশীল লাইনআপের পরও স্বস্তি পাচ্ছিল না আফটারম্যাথ। কারণ, একসঙ্গে জ্যাম করার পছন্দমতো জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলেন না ব্যান্ডের সদস্যরা। তখনই তাঁদের স্বস্তি দিলেন নুমাইরি। তাঁর প্যাড ফাংকাডেলিক হয়ে উঠল আফটারম্যাথের চিরস্থায়ী ঠিকানা। ২০১৫ থেকে প্রতি বুধবার এখানেই জ্যাম করছে আফটারম্যাথ। তাই নুমাইরির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুললেন না কেউই।
আফটারম্যাথের সব সদস্যই এখন চাকরিজীবী। ফলে বুধবারের জ্যামিংয়ের এই তিন ঘণ্টা প্রত্যেক সদস্যের কাছে মহামূল্যবান। বুধবার কোনো দাওয়াত, কোনো কাজ রাখেন না তাঁরা। এমনকি প্রত্যেকের বাসা এবং অফিসও জানে, বুধবার সন্ধ্যায় তাঁদের পাওয়া যাবে না। জ্যামিংয়ের সময় এই পাঁচজন হয়ে যান অন্য মানুষ। সারা সপ্তাহের অফিসের চাপ, রাস্তার জ্যাম, বিরক্তি—সব ভুলে এই তিন ঘণ্টা তারা ডুবে যান সুরে। কখনো কখনো সবাই মিলে এমন জাদুকরী কিছু তৈরি করে ফেলেন যে চমকে যান নিজেরাই। কিছু সৃষ্টির এই আনন্দ কে ছাড়তে চায়? শো থাক বা না থাক, অ্যালবাম বের হোক বা না হোক, বুধবারের এই জ্যামিং কখনোই মিস করেন না আফটারম্যাথ সদস্যরা।
নিয়মিত অনুশীলনের কারণে আফটারম্যাথের সাউন্ডের মান বেড়েছে বলে মনে করেন ব্যান্ডের সদস্যরা। ফাহিম বলেন, ‘সাউন্ডটা বের করার পর আমরা বুঝতে পারি যে আমরা এখন গান কম্পোজ করতে পারব।’ সাউন্ডের জন্য আরও একজনের কাছে কৃতজ্ঞ আফটারম্যাথ—এ কে রাতুল। রাতুলের মিক্সিং ব্যান্ডের সাউন্ডে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
সে অনুযায়ী চলতে থাকে গান বানানো। গান বানানোর ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দকেই প্রাধান্য দেয় আফটারম্যাথ। শুরুতে তাঁদের দৃষ্টি ছিল গানের কম্পোজিশনে। গানটা কত ভালো করা যায়, তা নিয়েই কাজ করতেন ব্যান্ড সদস্যরা। এখন যোগ হয়েছে আরেকটি বিষয়—নতুনত্ব। এমন কিছু তাঁরা তৈরি করতে চান, যেটা মানুষ আগে শোনেনি।
মুন্তাসির বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের আটটা গান আট রকম। একটার সঙ্গে অন্যটার মিল নেই।’ গান নিয়ে নিজেদের ভেতর ক্রমাগত আলোচনা-সমালোচনার ফসল এই বৈচিত্র্য। ‘ভিন্নমতটা সবাই সম্মান করে’, বললেন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আসিফ। ‘আমরা জানি যে ও ফিডব্যাক দিচ্ছে আমাদের আরও ভালোটা বের করে আনার জন্য। ব্যান্ড করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইগোটাকে মেরে ফেলা। ব্যান্ডের সবাই মিলে একটা সত্তা তৈরি করা এবং আমরা সেটা করতে পেরেছি।’
সবাই মিলে যে সাউন্ড তৈরি হয়, সেটা নিয়ে কাঁটাছেড়া চলে। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে যোগ-বিয়োগ করেন। গানটাকে একটা কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেন সবাই মিলে। কম্পোজিশনটা কে শুরু করলেন সেটা বড় কথা নয়, সবাই মিলে গানটা শেষ করাই বড়—এভাবেই গান বানাতে পছন্দ করে আফটারম্যাথ। জেদ অ্যালবামের গানগুলো কয়েক বছর ধরে তৈরি করেছেন তাঁরা। তবে গান মুক্তি বা অ্যালবাম বের করার চেয়েও তাঁদের নজর থাকে নিজেদের সন্তুষ্টির দিকে। দেরি হলেও আফটারম্যাথ এমন কিছু গান করতে চায়, যা বহু বছর মনে রাখবে মানুষ। ‘আমরা শ্রোতাদের চমকে দিতে চাই’, বললেন ফাহিম, ‘সবচেয়ে বড় কথা, আমরা নিজেরাও চমকে দিতে চাই নিজেদের।’
ঠিক সেভাবেই প্রতি সপ্তাহে গান মুক্তি দিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে আফটারম্যাথ। একটা কিংবা দুটো নয়, ব্যান্ডের সদস্যরা চান তাঁদের সবগুলো গান শুনুক মানুষ।
এখন সবাই ইউটিউবে গান শোনে, তবু আফটারম্যাথ সদস্যদের ইচ্ছা আছে সিডি প্রকাশ করার। হবে অ্যালবাম লঞ্চিং অনুষ্ঠানও। পুরোটা সময় চুপ করে থাকা ড্রামার সাকিব জানান, ‘অ্যালবামের পাশাপাশি আমাদের টি–শার্ট এবং অন্যান্য মার্চেন্ডাইজিং নিয়েও কাজ করছি আমরা।’
শ্রোতাদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পাচ্ছে আফটারম্যাথ। কিন্তু পা মাটিতেই আছে তাঁদের। ‘প্রথম ১০ দিনেই এক মিলিয়ন ভিউ পেতে হবে, এমন ইচ্ছা আমাদের নেই।’ জানান নাভিদ, ‘আমরা যা এক্সপ্রেস করতে চাই, সেটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
এটাই আফটারম্যাথের দর্শন। ভক্তদের উৎসর্গ করতে আরও অনেকগুলো গান আছে তাঁদের ঝুলিতে। এখনো সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে, চলবে। ‘ম্যাথহেড’রা চাইবেন, খুব তাড়াতাড়িই যেন সেই গানগুলোর সঙ্গে হেডব্যাং করতে। এই অধিকার আফটারম্যাথের কাছ থেকেই পেয়েছেন তাঁরা।
আফটারম্যাথের গানগুলো শুনতে পারো ব্যান্ডটির ফেসবুক পেজে।