‘ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই, যারা তাদের স্বপ্নের সৌন্দর্যে বিশ্বাসী।’ এলিয়েনর রুজভেল্টের এই উক্তিকে আরও একবার বাস্তবে রূপ দিল বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান পপ ব্যান্ড ‘বিটিএস’। ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ কার্যালয়ে ৭৬তম সাধারণ অধিবেশনে অংশ নেন তুমুল জনপ্রিয় এই ব্যান্ডের সদস্যরা। তবে এবারই প্রথম নয়। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অংশগ্রহণ করল বিটিএস।
একটি গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। দক্ষিণ কোরিয়ার ছোট একটি কোম্পানি বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্ট। সেখান থেকে আসা সাত কিশোরকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিটিএস। ২০১৪ সালে ব্যান্ডটি অংশ নেয় ‘ফোর থিংস শো’ নামের এক রিয়েলিটি অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বিটিএসের লিডার আরএম তথা কিম নামজুনের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাঁদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা কিছু নেতিবাচক মন্তব্য। ক্যামেরার সামনে সেগুলো পড়ে শোনাতে বলা হয় তাঁকে। খুব বেশি পড়তে পারেননি, তার আগেই ২০ বছর বয়সী নামজুনের গলা ধরে আসে, ভিজে যায় চোখ। সেদিন টিভির সামনে থাকা দর্শক ও নেতিবাচক মন্তব্যকারীদের উদ্দেশে দৃঢ়কণ্ঠে নামজুন বলেন, ‘একদিন সবার সামনে নিজেদের প্রমাণ করে দেখিয়ে দেব!’
সত্যিই দেখিয়ে দিলেন তাঁরা। অভিষেকের মাত্র আট বছরের মাথায় বিটিএস হয়ে উঠল বিশ্বসংগীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ডের একটি। তবে এই জনপ্রিয়তা সহজে ধরা দেয়নি, সে জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন পথ। এই পথে বহুবার তাঁদের মুখোমুখি হতে হয়েছে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের মতো নানা সমস্যার। কিন্তু তাতে তাঁরা ভেঙে পড়লে থেমে যাননি কখনো। সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবার। ফলস্বরূপ আট বছরের ক্যারিয়ারে অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা, ভেঙেছেন হাজারো রেকর্ড। ২০১৭ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে টপ সোশ্যাল আর্টিস্টের খেতাব অর্জনসহ ২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনের ‘নেক্সট জেনারেশন লিডারস’ খেতাব এবং একই বছর ফোর্বস কোরিয়া পাওয়ার সেলিব্রিটির তালিকায় শীর্ষ স্থান অর্জনের মতো অগণিত প্রাপ্তি বিটিএসের খাতায়। ২০২০ ও ২০২১ সালেও দেখা যায় তাদের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা। করোনা মহামারির কঠিন সময়েও ২০২০ সালের আগস্টে বিশ্ববাসীকে বিটিএসের সদস্যরা উপহার দেন তাঁদের প্রথম ইংরেজি একক গান ‘ডায়নামাইট’; যা দিয়ে প্রথমবারের মতো তাঁরা জায়গা করে নেন বিলবোর্ড হট হান্ড্রেড সিঙ্গেলসের শীর্ষে! একই গানের জন্য ২০২১ সালে প্রথম কোরিয়ান ব্যান্ড হিসেবে সংগীতের সম্মানজনক পুরস্কার গ্র্যামির মনোনয়নও পায় বিটিএস। তবে অর্জন যা–ই হোক, সেই প্রাপ্তির সবটুকু কৃতিত্বই তাঁরা প্রতিবার সঁপে দেন তাঁদের আর্মি ভক্তদের হাতে।
এবার বলা যাক বিটিএসের জাতিসংঘ ভ্রমণ নিয়ে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো তাঁদের জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণ হলেও এবারেরটা ছিল একটু ভিন্ন। মূল অধিবেশন শুরুর এক দিন আগে সব আলো কেড়ে নিয়ে নেচে–গেয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মাতিয়েছেন বিটিএসের সাত তারকা। সেই সঙ্গে প্রায় সাত মিনিটের ভাষণে তাঁরা একে একে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে শুনিয়েছেন আশা ও অনুপ্রেরণার বার্তা। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে তাঁরা অংশ নেন জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলনে। এর আগে এ বছরের জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট মুন বিটিএস সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সংস্কৃতির বিশেষ প্রতিনিধি’ হিসেবে মনোনীত করেন। ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁদের হাতে তুলে দেন কূটনৈতিক পাসপোর্ট ।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া সাত মিনিটের ভাষণে একে একে কথা বলেন বয় ব্যান্ডের সাত তারকা আরএম, জিন, সুগা, জে-হোপ, জিমিন, ভি ও জাংকুক। এর আগে বিটিএসের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে আর্মি ভক্তদের উদ্দেশে করোনা মহামারির কঠিন সময়ে সবার টিকে থাকার গল্প জানতে চেয়ে পোস্ট দেন তাঁরা। ভক্তদের সেসব গল্প সঙ্গে করেই মঞ্চে ওঠেন তাঁরা। ভাষণের শুরুতেই দলপতি আরএম বলেন, ‘এত বড় মঞ্চে আসতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কাজ করে যাব। জলবায়ু পরিবর্তনসহ বৈশ্বিক মহামারিতেও কীভাবে টিকে থেকে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়েই কাজ করব আমরা। আর এতে আমাদের সঙ্গী হবে এই তরুণ প্রজন্ম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সম্ভাবনা ও প্রত্যাশায় বিশ্বাসী। তাই তো পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এ প্রজন্ম। অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলেও আমরা ভয় পেয়ে হাল ছাড়ব না।’ এরপরই বক্তব্য দেন ব্যান্ডটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জিন। এ প্রজন্মকে বাহবা দিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার সঙ্গে লড়াই করে আসা এই প্রজন্মকে ‘লস্ট জেনারশন’ না বলে বরং ‘ওয়েলকাম জেনারেশন’ বললে আমরা খুশি হব। কেননা, আমরা পরিবর্তনকে ভয় পাই না; বরং তাকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে যেতে পারি।’ ব্যান্ডের অন্য সদস্যরাও একে একে করোনা মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও দারিদ্র্য, বৈষম্য, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে তরুণদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।
এ সময় ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য জিমিন বলেন, ‘আমরা থেমে যেতে পারি না। এটা হতাশা কিংবা কাউকে দোষারোপের সময় নয়, বরং নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সময়। কোভিডের কাছে হারেনি এই প্রজন্ম।’ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কতটা মূল্যবান, সে কথা উল্লেখ করে সুগা বলেন, ‘কোভিড আমাদের কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছে, তার জন্য কষ্ট পেয়েছি। তবে এটাও বুঝতে পেরেছি, প্রতিটা মুহূর্ত কতটা মূল্যবান।’ ভাষণের একপর্যায়ে জলবায়ু সংকট নিয়ে আরএম বলেন, জলবায়ু সংকট নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা আসলেই কঠিন। তবে অনেক তরুণই এখন পরিবেশ নিয়ে ভাবছেন এবং কাজ করছেন। ভাষণের শেষ পর্যায়ে সবাইকে ভ্যাকসিনের আওতায় আসা এবং মহামারির কঠিন সময়ের সব হতাশা ভুলে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান বিশ্বখ্যাত এই তারকারা।
সাত সদস্যের বক্তব্য শেষে অধিবেশনে বিশ্বনেতাদের সামনে প্রদর্শিত হয় তাঁদের নতুন সুপারহিট গান ‘পারমিশন টু ড্যান্স’-এর পারফরম্যান্স ভিডিও। সেখানে মঞ্চ হিসেবে দেখা যায় জাতিসংঘের কার্যালয়কে।
নেচে–গেয়ে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের আসর মাতালেও অর্থবহ গানের কথা, দুর্দান্ত নাচ আর চমৎকার ভিজ্যুয়ালের কারণে কারণে এবারও বিটিএস তারকাদের মাঝে মুগ্ধতা ছিল অন্য সময়ের মতো। জাতিসংঘের ইউটিউব চ্যানেলে বিটিএস সদস্যদের ভাষণ ও পারফরম্যান্স বিশ্বজুড়ে লাইভ দেখেন প্রায় ১০ লাখ ভক্ত। বিকেলের মধ্যেই সেই ভিউ ছড়িয়ে যায় ৬০ লাখে। এর আগে ২০১৮ সালে তরুণদের প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ইউনিসেফের সঙ্গে সম্মিলিত ‘লাভ মাইসেল’ ক্যাম্পেইন প্রচারণার অংশ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেয় বিটিএস। এ ছাড়া ২০২০ সালে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল অধিবেশনে অংশ নেয় ব্যান্ডটি।
দক্ষিণ কোরিয়ার ছোট্ট কয়েকটি শহর থেকে আসা সাত সাধারণ স্বপ্নবাজ তরুণ আজ বিশ্বের দরবারে হাজির হয়েছেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে। বিটিএস সদস্যদের সততা, আত্মবিশ্বাস ও কঠিন পরিশ্রমের ফলই যে তাঁদের এই সাফল্য, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো আর্মিদের কাছে বিটিএস মানেই যেন এক অনুপ্রেরণার নাম!