আমার ছোটবেলার ঈদ অধিকাংশ সময় কেটেছে গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। প্রতিবছর ঢাকা থেকে ফুপা-ফুপু, কাজিনসহ আমরা সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। তখন আমার দাদি বেঁচে ছিলেন। প্রতিবছর দাদির কাছে যাওয়া এবং কাজিনদের নিয়ে ঈদ করার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল অসাধারণ। ঈদের সময়েই আমি প্রথম আমার কাজিনদের সঙ্গে বাংলা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। পিরোজপুরে যে সিনেমা হল ছিল সেটাতে সিনেমা দেখতাম আমরা। ব্যাপারটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, প্রতি ঈদে সিনেমা দেখতেই হবে।
রোজার ঈদে সবার একসঙ্গে হওয়াটাই তো সবচেয়ে বেশি আনন্দ। ঈদের সময় বিকেলবেলা একটা ক্রিকেট ম্যাচ হতো—যে ম্যাচে আমাদের কাজিনরা সবাই খেলত। থাকত পরিবারের সবাই। গ্রামের আশপাশের মানুষরাও থাকত। একটা প্রতিযোগিতা হতো। সবাই মিলে কাটত একটা সুন্দর সময়। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করত সবার মধ্যে। রাতের দিকে যখন কারেন্ট থাকত না, তখন সবাই মিলে কোনো না কোনো কিছু খেলতাম। ভূতের গল্প বলত কেউ কেউ। আবার সবাই মিলে কিছু একটা রান্নাও করত, আমরাও মজা করে খেতাম। মাঝেমধ্যে করতাম পিকনিক। নিজেরা সবাই মিলে রান্না করতাম।
ঈদের সময় ঈদকার্ডের প্রচলন ছিল। এ নিয়ে খুব মজার একটা স্মৃতি আছে। তখন শাহজাহানপুরে থাকতাম, ওখানেই আমার জন্ম। একদম ছোটবেলার কথা—ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি তখন। ঈদকার্ড এতটাই পছন্দ করতাম যে শাহজাহানপুরের সব বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, আমাদের গলিতে ঈদকার্ডের একটা দোকান দেব। আমাদের তো দোকান দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তারপরও মাদুর আর চাটাই নিয়ে গলির মাঝখানে দেয়ালে সুতা টানিয়ে ঈদকার্ড বিক্রি করা শুরু করলাম আমরা। কিছু কার্ড দোকান থেকে কিনে আনতাম, আর কিছু কার্ড বানাতাম হাতে। সেই কার্ড বিক্রি নিয়েও আছে মজার অভিজ্ঞতা। একটা স্মৃতি তো আমি কখনোই ভুলব না। মা-বাবা যখন অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলেন যে আমরা সবাই রাস্তায় বসে একসঙ্গে কার্ড বিক্রি করছি। তারপর মা-বাবা অন্য অভিভাবকদের কমপ্লেইন করে আমাদের ওখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আমরা খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এই ভেবে যে আমাদের ব্যবসাটা নষ্ট করে দিল! এর মধ্যে তো এক বন্ধু কার্ড বিক্রির সব টাকা নিয়েই চলে গেল। আরেকজন নিয়ে গেল সব কার্ড! এ ঘটনা সব সময়ই মনে হয় সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি শাহজাহানপুরের স্মৃতি এবং ছোটবেলার বন্ধুদের খুব মিস করি।
ঈদ মানে আনন্দ। ছোটবেলায় যখন গ্রামে গিয়েছি, তখনই বুঝেছি আনন্দ কখনো একা একা উপভোগ করা যায় না। গ্রামে যখন ছিলাম, ঈদে যখন জামাতে নামাজ পড়তাম, কখনো কোনো বিভাজন ছিল না। বড়–ছোট সবাই মিলে একসঙ্গে নামাজ পড়তাম। একসঙ্গে খাওয়ার চেষ্টাও করতাম। চাচা–ফুফুদের কাছ থেকে গল্প শুনতাম। আসলে আনন্দ তখনই আনন্দ হয়ে ওঠে, যখন তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। সবাই একই সঙ্গে আনন্দিত হতে হয়। সবাইকে নিয়ে যে ভালো থাকতে হবে, নিজেদের সেরা মুহূর্তগুলো কাটাতে হবে—এটাই ঈদ।