কৈশোরে বিটিএস

সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে যাও, স্কুল থেকে ফিরেই আবার কোচিং, রাতে হোমওয়ার্ক—তোমাদের নিত্যদিনের রুটিন। কিন্তু অনেকেই জানো না তোমার স্বপ্ন কী! তুমি কী হতে চাও বা তোমার কী ভালো লাগে। কারও কারও হয়তো ইচ্ছা চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু সেটাও যে তোমারই ইচ্ছা বা ভালো লাগা, তা তুমি জানো না। হতে পারে তোমার মা–বাবার ইচ্ছা। অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক চাপ বা মানুষ কী বলবে ভেবেও তুমি তোমার স্বপ্নের কথা বলতে পারছ না। আবার বলতে পারলেও তোমাকে সহজেই কেউ ডিমোটিভেট করে ফেলছে। অনেকটা এ ধরনের প্রেক্ষাপট থেকেই কে পপ বয় ব্যান্ড বিটিএস বা বাংতান সোনিয়েন্দানের প্রথম গান ‘নো মোর ড্রিম’ মুক্তি পায় ২০১৩ সালে। টার্গেট করা হয় সেসব কিশোর-তরুণকে, যাদের কোনো স্বপ্ন নেই। তারাও যে সব বাধা অতিক্রম করতে পারে, সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করে কে পপ জগতে নতুন পা ফেলা বিটিএসের সাত কিশোর। বিটিএসের গানগুলো কিশোর-তরুণদের কথাই বেশি বলে। এ কারণে তাদের এ বয়সী ভক্তও বেশি। বিটিএসের গল্পটা বেশ বড়, যাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই। ২০১৩ সালে ব্যান্ডের ডেব্যু হলেও প্রত্যেক সদস্যেরই ট্রেনিং শুরু এর বেশ কিছু বছর আগে। সবার বয়স তখন ১৫ থেকে ২১–এর মধ্যে। বিটিএসে যোগ দেওয়ার আগে তখনকার এই কিশোর বয়সী ছেলেগুলোর জীবন নিয়েই জানার চেষ্টা করব আজ।

আরএম

বিটিএসের দলনেতা আরএম ব্যান্ডের প্রথম সদস্য। নাম কিম নামজুন। র৵াপার, সংরাইটার ও রেকর্ড প্রডিউসার হিসেবেই আরএমের যাত্রা। ইংরেজিকে যারা ভয় পাও, তাদের জন্য আরএম এক অনুপ্রেরণার নাম হতে পারে। আরএম কোরিয়াতে থেকেও নিজে নিজেই অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে। জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ ‘ফ্রেন্ডস’ দেখে দেখে ও নিজেই চর্চা করে আরএম ইংরেজি শিখে নেয় ছোটবেলায়। এ জন্য ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরেও আরএমকেই সবার সঙ্গে কথা বলতে হয়।

১১ বছর বয়স থেকেই মিউজিকের প্রতি আগ্রহ জন্মায় আরএমের। এমিনেমের মতো র৵াপারদের কাজগুলো দেখতে দেখতে চর্চা শুরু করে। ২০০৭ সালে মিডল স্কুলের ছাত্র আরএম। তত দিনে সে র৵াপ পারফর্ম শুরু করে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্কুলে আরএমের রেজাল্ট এতটাই ভালো ছিল যে সে কোরিয়ার যেকোনো ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারত। পরিবারও তা–ই চাইছিল। কিন্তু মিউজিকের প্রতি ভালোবাসা তাকে টেনে নিয়ে আসে বিটিএসে। ২০১০ সালে বিগ হিট এন্টারটেইনমেন্টে অডিশন দিয়ে নির্বাচিত হয়। সেখানে তিন বছরের ট্রেনিং গ্রহণ করে আরএম। তাকে নিয়েই বিটিএসের যাত্রা শুরু।

২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আরএম বিটিএসের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে ভাষণ দেয়। জানায় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, কীভাবে গান তাকে হাল না ছাড়ার শিক্ষা দিয়েছে। এ জন্য আর্মিদের কাছে অনুপ্রেরণার এক নাম কিম নামজুন।

সুগা

ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য সুগার জন্ম হয় এক দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই ডিপ্রেশন ও বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগা ছেলেটির স্কুলে ভালো ছাত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিউজিকের প্রতি ছিল বেশ আগ্রহ। গানের লিরিক্স লিখে লিখেই বেশ বড় একটা সময় পার করত। সঙ্গে সঙ্গে বাস্কেটবলেও সমান পারদর্শিতা। তবে সুগার আগ্রহ যে মিউজিকে, তা সে বুঝে নেয় ১৩ বছর বয়সেই।

শুরুতে হাইস্কুল কাঁপাতে শুরু করে। ‘গ্লস’ নাম দিয়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করে। তবে পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তাকে কাজ করতে হতো। স্কুলে সুগার র৵াপিংই যে নাম ছড়াচ্ছিল তা নয়; সে এলাকার লোকাল আর্টিস্টদের জন্য প্রযোজক হিসেবে কাজ করত, গান কম্পোজও করে দিত। বিগ হিটে যোগ দিয়ে সুগা মজা করেই বলে, আসলে সে প্রযোজক হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বিগ হিটের কো-সিইও ব্যাং শি হিয়্যুক (Bang Shi Hyuk) ষড়যন্ত্র করে তাকে ব্যান্ডে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

বিগ হিটে ট্রেনিং নেওয়ার সময়ও তাকে পত্রিকা ডেলিভারি বয়ের কাজ করতে হতো। কিন্তু আজ সে একজন জনপ্রিয় কোরিয়ান র৵াপার, মিউজিক প্রডিউসার। সুগা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের মানসিক সমস্যার কথা জানিয়েছে সবাইকে। তার লিরিক্সগুলোয় ফুটে ওঠে তার সমস্যার কথা, সামাজিক চাপের কথা। সেসব তরুণের কথা, যাঁরা মানসিক সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, কিন্তু কাউকে বলতে পারছেন না। এ জন্য ভক্তদের কাছে জনপ্রিয় এক চরিত্র বিটিএসের সুগা।

জে-হোপ

‘জে-হোপ’ স্টেজ নামটি ‘দ্য হোপ অব বিটিএস’-এর প্রতিনিধিত্ব করে। জে-হোপের মূল বাড়ি কোরিয়ার গুয়াংজুতে। নাচ ভালো লাগার কারণে কিশোর বয়সে সে যোগ দেয় ‘নিউরন’ নামের এক স্থানীয় ড্যান্স ক্রুতে। বিটিএসের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বিগ হিটে অডিশন দেয় সে। নাচের দক্ষতা, তাল ধরতে পারা, র৵াপের কার্যকরিতা—সব মিলিয়ে নিয়ে নেওয়া হয় তাকে। তবে এর আগে জেইওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্ট নামের আরেক প্রতিষ্ঠানে অডিশন দেয় জে-হোপ। প্রথম কয়েকটা রাউন্ড পার করলেও অবশেষে তাকে বাদই দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

বেশ কিছু বছরের ট্রেনিংয়ের পর জে-হোপকে তবু বিটিএস লাইনআপের বাইরেই রাখা হচ্ছিল। জে-হোপ নিজে এবং আরএম বোঝানোর চেষ্টা করে বিটিএসের জন্য জে-হোপকে কতটা প্রয়োজন। বাকিটা তো ইতিহাস।

বর্তমানে ২৫ বছর বয়সী এই তারকার একটি বিশেষ দিক রয়েছে, যা অনেকেই জানে না। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে জে-হোপ কোরিয়ান দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন ওন ডোনেট করেন। এর আগেও তিনি প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ওন ডোনেট করেছিলেন। তবে তিনি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাঁর নাম প্রকাশিত না হয়।

জিন

বিটিএসের চতুর্থ সদস্য, জিন মূলত স্ট্রিট কাস্টেড। প্রথমে এসএম এন্টারটেইনমেন্ট তাকে বাছাই করলেও সে কোম্পানিটির সঙ্গে যুক্ত হয় না। এরপর সে পুনরায় বিটিএসের দ্বারা স্ট্রিট কাস্টেড হয়। যখন সে একজন কলেজছাত্র।

একদিন বিগ হিটের কর্মীরা তাকে বাস থেকে নামতে দেখেন। দেখা করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বুঝিয়ে তাকে অডিশনের জন্য রাজি করানো হয়। তার নাচ বা গানের তেমন অভিজ্ঞতা না থাকলেও অভিনয়ে দক্ষতা ছিল। মূলত, অভিনেতা হওয়ারই ইচ্ছা ছিল জিনের। তবে অনেকেই মনে করেন, কঠোর পরিশ্রম আর চর্চার কারণে জিন আজ গায়কে পরিণত হয়েছেন। বয়সে বিটিএসের সবচেয়ে বড় এই সদস্য ইউনিসেফ কোরিয়ার মাসিক ডোনার। এবং সেই ডোনেশনের পরিমাণ শুনলেও তোমার চোখ কপালে উঠবে।

জাংকুক

বয়সে বিটিএসের সবচেয়ে ছোট এই সদস্য আর্চারি, মুষ্টিযুদ্ধ—সবকিছুতেই দক্ষ। বুসানে একবার ‘সুপারস্টার কে’–এর তৃতীয় সিজনটি চলছিল। কিন্তু সেই অডিশন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় জাংকুককে। এখানেই সব শেষ হয়ে যেতে পারত। তা হয়নি।

আরও বেশ কিছু এজেন্সি জাংকুকের মধ্যে বিশেষ কিছু দেখেছিল। সেই সংখ্যাটাও কম না, সাতটি! জেওয়াইপি এন্টারটেইনমেন্ট, এফএনসি এন্টারটেইনমেন্ট, স্টারশিপ এন্টারটেইনমেন্টের মতো এজেন্সিতে তার ডাক পড়ে। কিন্তু অবশেষে সে যোগ দেয় বিগ হিটে। সেই সময়ের ক্ষুদ্র কোম্পানি বিগ হিট, কিন্তু কেন জাংকুক সেখানেই যোগ দিল? কারণ, আরেক সদস্য আরএম। আরএম ও তার র৵াপিং স্কিল জাংগুকের প্রচণ্ড ভালো লেগেছিল। সে একই কোম্পানিতে আরএমের সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিল। এ জন্যই বিটিএসে যোগ দেওয়া।

ভি

বিটিএস সদস্য ভি–এর মা–বাবা কৃষক। সবচেয়ে বেশি সময় প্রশিক্ষণ নেওয়া সদস্য সে। মিউজিকের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকায় সে স্কুলে থাকাকালে স্যাক্সোফোন শিখছিল। সেবার কোরিয়ার দেগুতে বিগ হিটের অডিশন ছিল। ভি সেখানে যায়, কিন্তু অডিশন দেওয়ার জন্য না। এক বন্ধুকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। তবে সেখানে এক কর্মী তাকে অডিশন দিতে বলে। দেগুতে ওই দিন ভি বাদে আর কেউ নির্বাচিত হয় না।

২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, কে পপ ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে গুগলে সবচেয়ে বেশি ভিকে নিয়ে সার্চ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্কুল–কলেজের বুলিং বন্ধ করার জন্য ইউনিসেফের অ্যান্টিবুলিং ক্যাম্পেইনে বিটিএস যুক্ত আছে। এ ছাড়া আর্মিদের ‘আই পারপেল ইউ’–এর আইডিয়াও ভির মাথা থেকেই আসা। পারপেল অর্থ বেগুনি, যা রংধনুর শেষ রং। যার অর্থ আজীবনের জন্য আমি তোমাকে বিশ্বাস করব ও ভালোবাসব। যার আরও অর্থ হয় আছে আমি তোমাকে ভালোবাসব, বিশ্বাস করব, সাপোর্ট করব ও আমার জীবনের শেষনিশ্বাস পর্যন্ত লয়্যাল থাকব।

জিমিন

বুসান হাইস্কুল অব আর্টসে পড়ালেখা করত জিমিন, ডিপার্টমেন্ট অব ড্যান্সের টপারও ছিল সে। জিমিনের নাচের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না কখনোই। বিগ হিটে অডিশন দিয়ে নির্বাচিত হয় সে। জিমিন সবচেয়ে কম সময়ে তার প্রশিক্ষণ শেষ করে। গ্রুপে যোগ দেওয়া শেষ সদস্যও সে।

তোমাদের অনেকেই স্কুলে ক্লাস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করো। কিশোর বয়সে বিটিএসের জিমিন টানা নয় বছরের জন্য ক্লাস প্রেসিডেন্ট ও স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য ছিল। সাধারণত বিটিএসের গানগুলোর কিলিং পার্টগুলোয় বেশি কণ্ঠ দেয় জিমিন। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে ক্লাইম্যাক্স ও ব্রেক ড্যান্স তো আছেই।

বিটিএসের সব সদস্যই গান ভালোবাসে, তা মনে ধারণ করে। চেষ্টা, সততা, পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই যে তারা সফলতার চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছে, তা আর বলতে বাকি থাকে না।