একটি আর্কাইভের গল্প

১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল। একের পর এক ব্যান্ড, সোলো আর্টিস্ট তখন গান করছেন। প্রতিনিয়ত মুক্তি পাচ্ছে গানের অ্যালবাম। ইউটিউব বা স্পটিফাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো সবার কাছে পৌঁছায়নি তখনো। গানগুলো তাই প্রকাশ পেত ক্যাসেট কিংবা সিডিতে। বইয়ে যেমন প্রচ্ছদ থাকে, এই ক্যাসেট বা সিডিগুলোরও থাকত নিজস্ব প্রচ্ছদ। চমৎকার অলংকরণ আর ডিজাইনের মাধ্যমে সাজানো হতো লিরিক বুক, আর্টওয়ার্ক, ইনলে, সিডি-সব মিলিয়েই গোটা একটা অ্যালবাম। লেখা থাকত ব্যান্ড বা সোলো আর্টিস্টদের নিজেদের কথা, গানগুলো তৈরি হওয়ার গল্প, উৎসর্গ এ ছাড়া আরও কত কী! সব মিলিয়ে সিডি অ্যালবামগুলো হয়ে উঠত চমৎকার স্যুভেনির।

গানের জগতের এই সুসময়ে সিডি, অ্যালবামের প্রচ্ছদ, সাজসজ্জার প্রতি ভীষণ মুগ্ধ হলো এক কিশোর। অদ্ভুত এক নেশা চেপে বসল সোহাইল মাহবুব নামের সেই কিশোরে মাথায়। ইচ্ছা হলো বিখ্যাত, অখ্যাত, উদীয়মান সব ব্যান্ডের সব অ্যালবাম সংগ্রহ করার। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। প্রবল উদ্যমে অ্যালবাম সংগ্রহের অভিযানে নেমে পড়লেন সোহাইল। চষে বেড়ালেন ঢাকার প্রতিটা দোকান। পল্টন থেকে উত্তরা, বাদ গেল না কোনো দোকান। সময়ের সঙ্গে বাড়তে লাগল তাঁর সংগ্রহের সংখ্যা। চলতে থাকল অভিযান। এল ২০১২ সাল। তত দিনে কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা দিয়েছেন সোহাইল মাহবুব। ছেলেবেলায় ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড ব্ল্যাকের অ্যালবাম উৎসবের পর। মুগ্ধতার যাত্রা শুরু সেখান থেকেই।

২০১০ সালের পর থেকেই সিডি অ্যালবামের দিন ফুরোতে শুরু করে। কমতে থাকে বিক্রি। তখন চলছে এমপিথ্রির যুগ। গোল সিডি থেকে গানের জায়গা, তখন চার কোনা ছোট্ট মেমোরি কার্ড। ইউটিউবেরও প্রসার ঘটছে। কমছে নতুন সিডি আসার হার। অন্যদিকে লোকসানের কারণে বন্ধ হচ্ছে একের পর এক সিডির দোকান। পুরোনো অ্যালবাম সংগ্রহের পথও তাই সংকুচিত হয়ে আসছে। গুগলে বিভিন্ন অ্যালবামসংক্রান্ত তথ্য থাকলেও সিডি, কভার বা আর্টওয়ার্কের ছবি নেই। কালেভদ্রে দু-একটা পাওয়া গেলেও সেগুলো অস্পষ্ট।

এমন সময়টাতে সোহাইলের মধ্যে এল নতুন উপলব্ধি। ‘আমি বুঝতে পারলাম, ভবিষ্যতে ব্যান্ড ও গান থাকবে ঠিকই কিন্তু অ্যালবামের সঙ্গে থাকা সিডি, ডিজাইন, আর্টওয়ার্ক, কভার এসব তো হারিয়ে যাবে,’ বলেন তিনি।

কিন্তু হাল ছাড়লেন না সোহাইল। অর্ণবের মতো তিনিও ঘোষণা করলেন, হারিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই এখানে, ‘ভাবলাম, আমার কাছে যেসব অ্যালবাম রয়েছে, সেগুলোর আর্টওয়ার্ক, লিরিক বুক, প্রচ্ছদ স্ক্যান করে একটা ওয়েবসাইট টাইপ কিছুতে ছবি হিসেবে আপলোড করতে পারি। যেন পরবর্তী সময় যে কেউ যেকোনো অ্যালবাম সহজেই খুঁজে পায়। অনেকটা আর্কাইভের মতো।’

পরিকল্পনামাফিক কাজে নেমে পড়লেন সোহাইল। আর্কাইভের নাম ঠিক করলেন ‘বাংলা সিডি কভারস’। স্ক্যান করতে থাকলেন একের পর এক অ্যালবাম। শুরুটা হলো ব্ল্যাকের আমার পৃথিবীর মাধ্যমে। এরপর তৈরি করলেন একটি ব্লগ পোস্ট ওয়েবসাইট। নিজেই করলেন ডিজাইন। শুরু হলো আপলোডের কাজ। সে তালিকায় ওয়ারফেজ, অর্থহীন, আর্টসেল, শিরোনামহীনের পাশাপাশি রয়েছে যাত্রী, বিভীষিকা, এলিফ্যান্ট রোডের মতো দারুণ সব ব্যান্ডের অ্যালবাম। এ ছাড়া আছে অসংখ্য মিক্সড অ্যালবাম। সোলো আর্টিস্ট হিসেবে অর্ণব, সুমন, উপলের অ্যালবামও পাওয়া যায় আর্কাইভটিতে। এখন অবধি বাংলা সিডি কভারসে রয়েছে ৯০টি অ্যালবাম, যার মধ্যে ব্যান্ড ৩৩টি, সোলো আর্টিস্ট ৩ জন। মিক্সড অ্যালবামের সংখ্যা ১৮।

শুধু ছবি আপলোড করেই থেমে থাকেননি সোহাইল। প্রতিটি অ্যালবাম নিয়ে লিখেছেন ফিচার। রেখেছেন অ্যালবামসংক্রান্ত অসংখ্য চমকপ্রদ তথ্য।

দেননি নিজের নাম। নেই কোনো ওয়াটারমার্কও। ‘ওয়াটারমার্ক দেওয়ার মতো কিছু করিনি। ব্যান্ডগুলোই তো সব করেছে। শুধু স্ক্যান করার জন্য কার্টেসি রাখার কোনো প্রয়োজন বোধ করিনি,’ সোহাইলের ভাবলেশহীন উত্তর। তিনি চেয়েছিলেন অ্যালবামের প্রচ্ছদগুলোর প্রসার ঘটুক। সে চাওয়া পূরণ হয়েছে। আজকাল স্পটিফাই, গান, ইমাজিন রেডিওর মতো মিউজিক স্ট্রিমিং সাইটগুলোতে রসদ জোগাচ্ছে বাংলা সিডি কভারস। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত আর্কাইভটি এ বছর পা দেবে ১০ বছরে।

এত কিছু করলেও কোনো গান কিন্তু নিজের আর্কাইভে রাখেননি সোহাইল। দৃপ্ত কণ্ঠে জানালেন, অন্যের গান বিনা অনুমতিতে কোথাও প্রকাশ করা খুব খারাপ একটা কাজ। বলাই বাহুল্য, পাইরেসি ঘৃণা করেন সোহাইল।

বাংলা সিডি কভারস একের পর এক সুন্দর মুহূর্তের জন্ম দিচ্ছে। কখনো সংগীতশিল্পীরা নিজেদের পুরোনো কাজ দেখতে পেয়ে আবেগাপ্লুত হচ্ছেন, স্মৃতিচারণা করছেন পুরোনো দিনগুলোর কথা। আবার কখনো এ প্রজন্মের সংগীতপ্রেমীরা বাংলা গানের সোনালি সময়ের নিদর্শন দেখতে পেয়ে হচ্ছেন বিস্মিত। প্রতিনিয়তই শ্রোতাদের প্রশংসায় ভাসছেন সোহাইল। সেই সঙ্গে যাঁদের গান নিয়ে তাঁর এ প্রচেষ্টা, ভালোবাসা পেয়েছেন তাঁদের কাছ থেকেও। জনপ্রিয় ব্যান্ড ক্রিপটিক ফেইটের ফ্রন্টম্যান শাকিব চৌধুরী, আর্টসেলের বেজিস্ট সেজান, ওয়াটসন ব্রাদার্সের ড্রামার আরাফাত কাজী, অসংখ্য মিক্সড অ্যালবামের সমন্বয়ক ইশা খান দূরের মতো গুণী ব্যক্তিরা জানিয়েছেন বাংলা সিডি কভারস নিয়ে নিজেদের মুগ্ধতার কথা।

এখন বদলে গেছে ব্যান্ডজগতের দৃশ্য। সিডি তো দূরের কথা, হারিয়ে যেতে বসেছে অ্যালবাম করার প্রবণতাও। ব্যান্ডগুলো নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে একটি করে গান প্রকাশ করছে। সব মিলিয়ে আফসোস হয় সোহাইলের।

সেদিনের কিশোর সোহাইল পড়ালেখা শেষে এখন চাকরি করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। জানালেন, তাঁর সংগ্রহের সংখ্যা অতিক্রম করেছে ডাবল সেঞ্চুরি, ২২০টি! তিনি স্বপ্ন দেখেন অ্যালবামগুলো নিয়ে একদিন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করার। সেই সঙ্গে তাঁর আশা, বাংলা গানের সুদিন ফিরবে অচিরেই। গান কেনা নিয়ে এ প্রজন্মের শ্রোতাদের ধ্যানধারণায় বদল আসুক, এটাই তাঁর চাওয়া।

সোহাইলের আর্কাইভটি দেখতে ঘুরে আসতে পারেন এই লিংকে banglacdcovers.blogspot.com। মুঠোফোন থেকে ঢুঁ মারলে ল্যান্ডস্কেপ মোডে ডিভাইস ঘুরিয়ে নেবেন। যুক্ত থাকতে পারেন বাংলা সিডি কভারসের ফেসবুক পেজের সঙ্গেও facebook.com/groups/banglaphysicalalbumcollectorsforum