‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলো রে... আরে সবার মাথা খাইলো রে।’
তখনো এ দেশে কেব্ল টিভি আসেনি, ইন্টারনেট তো দূরের কথা। অথচ একজন বিদেশি শিল্পী এ দেশের মানুষের ‘মাথা খাওয়া’ শুরু করলেন, তাঁকে নিয়ে একটা গানও লেখা হয়ে গেল বাংলাতে! বাংলাদেশের খ্যাতনামা রক শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘ঢাকার কোনো রিকশাওয়ালাকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় একজন বিদেশি শিল্পীর নাম বলুন, সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে দেবে মাইকেল জ্যাকসন’। তারকাখ্যাতির কোন উচ্চতায় পৌঁছালে নিজের দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের একজন শ্রমিকের কাছেও নিজের নাম পৌঁছে দেওয়া যায়? ডিসকো থেকে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত নিজের সৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিতে কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া যায়? তিনি পেরেছিলেন। এ জন্যই তিনি মাইকেল। শুধু একটা নাম নয়, একটি ইতিহাস। অনেকেই বলে সংগীত অকৃতজ্ঞ শিল্প। কারণ, সবাই শুধু শিল্পীকেই চেনে। যে গীতিকার বা সুরকার গান লেখেন, সুর দেন, তাঁরা রয়ে যান পর্দার আড়ালে। মাইকেলের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য নয়। বেশির ভাগ গানই তাঁর নিজের লেখা, সুর করা। নাচের ক্ষেত্রে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন মুন ওয়াক, অ্যান্টি গ্র্যাভিটি লিনসহ অসংখ্য জনপ্রিয় মুদ্রা, যা তাঁকে শুধু একজন সংগীতশিল্পী নয়, নৃত্যশিল্পী হিসেবেও সমাদৃত করেছিল গোটা পৃথিবীতে।
মাইকেল জ্যাকসনের জন্ম ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট। তাঁরা ছিলেন ১০ ভাইবোন। ভাইদের মধ্যে মাইকেলই ছিলেন সবচেয়ে ছোট। সবাই বলে ছোট হলে নাকি আদর বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু না। মাইকেলের ভাগ্যটা ছিল অন্য রকম। অনেক ট্র্যাজেডি আর যন্ত্রণায় ভরা। যার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায় তাঁর ‘চাইল্ডহুড’ গানটিতে।
'Before you judge me, try hard to love me, Look within your heart then ask, have you seen my Childhood?'
পৃথিবীর অগণিত ভক্ত আর অতি উত্সাহে গসিপ খুঁজতে থাকা মিডিয়ার প্রতি যেন এভাবেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
পাঁচ বছর বয়স থেকে মাইকেলের গান গাওয়া শুরু। ভাইদের নিয়ে গড়ে ওঠা ‘জ্যাকসন ফাইভ’ ব্যান্ডের কনিষ্ঠতম সদস্য ছোট্ট মাইকেলের জাদুকরি কণ্ঠ আর সাবলীল নাচ এখনো দেখা যাবে ‘এবিসি’ মিউজিক ভিডিওটিতে।
গান কিন্তু তাঁর শখ ছিল না। দরিদ্র বাবা জো জ্যাকসন পেটের দায়েই গানের দলে নামিয়েছিলেন পাঁচ ছেলেকে। পাঁচ বছরের ছোট্ট মাইকেল দিন দিন পরিণত হতে থাকলেন বাবার টাকা বানানোর মেশিনে। যৌবনে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জয়ের পর ৩৪তম গ্র্যামির আসরে ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করেছিলেন এভাবে।
—আমার শৈশব আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমার কোনো ক্রিসমাস ছিল না। ছিল না কোনো জন্মদিন। কোনো স্বাভাবিক শৈশব ছিল না আমার। শৈশবের কোনো আনন্দই আমার ছিল না। তার বদলে ছিল শুধু কষ্ট, হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর সংগ্রাম, অবশেষে যা এনে দিল জাগতিক আর পেশাগত সাফল্য।
জ্যাকসন ফাইভ ছেড়ে মাইকেল শুরু করেন তাঁর একক ক্যারিয়ার। ১৯৭৯ সালে বের হয় তাঁর প্রথম আলোচিত সলো অ্যালবাম অব দ্য ওয়াল। এই অ্যালবামের, ‘শি’জ আউট অব মাই লাইফ’, ‘ডোন্ট স্টপ টিল ইউ গেট এনাফ’ ইত্যাদি আরও কিছু গান এখনো জনপ্রিয়। মাইকেলের ভাগ্যে গ্র্যামি, আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, বিলবোর্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসহ কয়েকটি পুরস্কার জোটে এই অ্যালবামের কারণে।
১৯৮২ সালে বাজারে আসে তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যালবামগুলোর একটি। থ্রিলার। মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই বিক্রি হয়ে যায় এক মিলিয়ন কপি। এই অ্যালবামের ‘থ্রিলার’ গানটি ভূত নিয়ে লেখা। ১৩ মিনিটের মিউজিক ভিডিওটি ভূতের গল্পনির্ভর একটি শর্টফিল্ম। এখনো হ্যালোইনের যেকোনো পার্টিতে তুমুল জনপ্রিয় এই মিউজিক ভিডিও। এবং মাইকেলের লাল জ্যাকেটটাও। এই অ্যালবামের আরেকটি অলটাইম হিট গান ‘বিট ইট’। এই গানটিতে গিটার বাজিয়েছিলেন বিখ্যাত গিটারিস্ট এডি ভ্যান হ্যালেন। শুধু বিট ইট গানটিই জিতেছিল দুটি গ্র্যামি এবং একটি আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড। আরও ছিল ‘বিলি জিন’। আর ‘দ্য গার্ল ইজ মাইন’। যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তি, বিটলসের পল ম্যাকার্টনি। এই অ্যালবামটি সেই বছর আটটি গ্র্যামি জয় করে রেকর্ড গড়ে। এখন পর্যন্ত শুধু আমেরিকাতেই থ্রিলার অ্যালবামটি প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কপি বিক্রি হয়।
পুরো পৃথিবীকে নিয়েই ভাবতেন তিনি, যার প্রতিফলন দেখা যেত গানগুলোতে। চার বছর পরপর অ্যালবাম বের করতেন মাইকেল জ্যাকসন। ১৯৮৭ সালে বের হলো ব্যাড। রচিত হলো আরেক ইতিহাস। ‘ব্যাড’ গানটি আজও শোনা যায় বিভিন্ন মিউজিক আর এফএম চ্যানেলে। প্রগাঢ় প্রেমের গান ‘লাইব্রেরিয়ান গার্ল’ উত্সর্গ করেছিলেন বন্ধু, চিত্রনায়িকা এলিজাবেথ টেলরকে। ‘স্মুথ ক্রিমিনাল’ গানটিতে দেখালেন আরেক চমক। নিজের শরীরকে পুরো সামনে নুয়ে ফেললেন মাধ্যাকর্ষণ বলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। প্রথমে অনেকে ভাবল ক্যামেরার কারসাজি। কিন্তু লাইভ কনসার্টেও এই একই দৃশ্য দেখার পর হতবাক হয়ে গেল দর্শকেরা। এই মুদ্রাটি ‘অ্যান্টি গ্র্যাভিটি লিন’ নামে পরিচিত। ‘ম্যান ইন দ্য মিরর’ গানটিতে শ্রোতারা চিনল এক নতুন মাইকেলকে। ভিডিওটিতে ছিল না কোনো নাচ বা কোনো সুন্দরী মডেল। ভিডিওজুড়ে ছিল মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসাদের মতো মহান ব্যক্তিদের আর যুদ্ধাহত, অনাহারী শিশুদের ফুটেজ। ‘পৃথিবীকে আরও সুন্দর করতে চাইলে নিজের দিকে তাকাও, বদলে দাও’। এটা ছিল গানের মূল কথা। ১৯৮৯ সালে গ্র্যামিসহ কয়েকটি পুরস্কার জেতা ব্যাড অ্যালবামটি ২০১২ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ মিলিয়ন। ভিয়েনায় ব্যাড অ্যালবাম নিয়ে মাইকেলের কনসার্টে তাঁকে সামনাসামনি দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ১৩০ জন নারীভক্ত! এ ঘটনা ঘটত তাঁর প্রতিটি কনসার্টেই। ১৯৮৪ সালে পেপসির একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের সময় চুলে আগুন ধরে গুরুতর আহত হন মাইকেল। এরপর থেকে সারা জীবনের জন্য সঙ্গী হয় অসহ্য মাথাব্যথা। তবু নাচের প্রতিটি মুদ্রা নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত চলত তাঁর রিহার্সাল। ফলাফল, শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা। পেইনকিলার একসময় হয়ে গেল তাঁর নিত্যসঙ্গী। গায়ের রংটাও দিন দিন কালো থেকে শ্বেতাঙ্গদের মতো সাদা হয়ে যেতে লাগল। বাতাসে জোর গুজব উঠল তিনি নাকি পুরো শরীর ব্লিচ করে ফেলেছেন। পরে ১৯৯৩ সালে অপরাহ উইনফ্রে শোতে তিনি জানান তিনি শ্বেতী রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
১৯৯১ সালে মুক্তি পায় ডেঞ্জারাস। অ্যালবামটির ‘ব্ল্যাক অর হোয়াইট’ গানে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করলেন—
I said if you’re thinkin’ of being my baby
It don’t matter if you’re black or white
I said if you’re thinkin’ of being my brother
It don't matter if you're black or white
পুরো পৃথিবীকে নিজেদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সুন্দর করার আহ্বান জানিয়ে গাইলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড’। এই গানের নামেই মাইকেল গড়ে তুলেছিলেন ‘হিল দ্য ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন’ যা ক্যানসার আক্রান্ত শিশুদের কল্যাণে কাজ করত।
মোনাকোর প্রিন্সের স্টেফানির সঙ্গে গাইলেন ‘ইন দ্য ক্লজেট’। গানটিতে মাইকেলের সঙ্গে নেচেছিলেন বিখ্যাত মডেল নাওমি ক্যাম্পবেল। এই অ্যালবামের আরেকটি হিট গান ‘গিভ ইন টু মি’। এতে গিটার বাজিয়েছিলেন গানস এন রোজেজের সাবেক গিটারিস্ট স্ল্যাশ। আর ‘রিমেম্বার দ্য টাইম’ গানটির কথা তো না বললেই নয়। এই অ্যালবামটি মাইকেলের ঝুলিতে যুক্ত করে তিনটি আমেরিকান মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, একটি গ্র্যামি।
নতুন-পুরোনো বেশ কয়েকটি গান নিয়ে ১৯৯৫ সালে বের হলো হিস্ট্রি পাস্ট, প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার-বুক ওয়ান।
গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বনভূমি উজাড় করা আর বন্য প্রাণী হত্যার প্রতিবাদে গলা ফাটিয়ে গাইলেন ‘আর্থ সং’। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যুগ যুগ ধরে চলে আসা অত্যাচারের প্রতিবাদে গাইলেন ‘দে ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট আস’। নির্যাতিত এক শিশুর যন্ত্রণা তুলে ধরলেন ‘লিটল সুজি’ গানে। ‘ইউ আর নট অ্যালোন’, স্ক্রিম ইত্যাদি আরও বেশ কিছু হিট গানের এই অ্যালবামটি মুক্তির প্রথম সপ্তাহেই বিক্রি হয় ৩৯ লাখ ১ হাজার কপি। উঠে আসে বিলবোর্ড চার্টের ১ নম্বরে। ২০১০ সালেও এই অ্যালবামটি বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন কপি।
১৯৯৬ সালে করলেন ভূত নিয়ে একটি মিউজিক্যাল শর্টফিল্ম ‘ঘোস্ট’। মাইকেলের সঙ্গে এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিশ্বনন্দিত হরর লেখক স্টিফেন কিং।
২০০১ সালে মুক্তি পায় তাঁর জীবদ্দশার শেষ অ্যালবাম ইনভিনসিবল। একাধিকবার শিশু নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শেষে ২০০৫ সালে মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান মাইকেল। এরপর থেকেই অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান এই শিল্পী। ২০০৯ সালে ঘোষণা দেন দিস ইজ ইট নামে জীবনের শেষ অ্যালবাম বের করে ক্যারিয়ারের ইতি টানার। এই দিস ইজ ইট অ্যালবামের প্রচারণার কনসার্টের প্রস্তুতিকালে সেই বছরের ২৯ জুলাই অতিরিক্ত পেইনকিলার সেবনের ফলে ৫০ বছর বয়সেই নিভে যায় এই মহাতারকার জীবনপ্রদীপ। ক্যানসারে মারা যাওয়া এক শিশুকে নিয়ে নিজের গাওয়া ‘গন টু সুন’ গানটির মতোই যেন তাঁর জীবনের গল্প— Born to amuse, to inspire, to delight. Here one day, gone one night.