পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন, এমনটা বললে ভুল হবে। তবে প্রীতম হাসানকে পড়ুয়া বলাই যায়। বইয়ের বাইরেও তো জানা–শোনার আলাদা একটা জগৎ আছে। প্রীতম সেই জানা-শোনার জগৎ নিয়ে ভীষণ পাগলাটে। একবার মাথায় কোনো নতুন কিছু জানার ঝোঁক চাপলে আর থামাথামি নেই। রাত–দিন একের পর এক ওই বিষয়ের ভিডিও দেখতেই থাকেন। এই যেমন আমরা যেদিন প্রীতমের সঙ্গে কথা বলতে বসি, সেদিন প্রীতম সৌরজগৎ, গ্রহ, কক্ষপথ—এসবের গবেষণায় বুঁদ। এর মধ্যেই আমাদের সময় দিয়েছেন প্রীতম হাসান, কথা বলেছেন গান নিয়ে, তাঁর উঠে আসা, বেড়ে ওঠা আর নিজের স্বপ্নকে জাপটে ধরে এগিয়ে যাওয়া নিয়ে।
প্রীতম হাসানের বাসায় ঢুকে দেখি ছিমছাম ঘরে একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা কি-বোর্ড। একটা অ্যাকুয়েস্টিক গিটার আছে, তবে সেটা একটু আড়ালে রাখা। আদতে তো প্রীতমের সঙ্গে অ্যাকুয়েস্টিক গিটারটা ঠিক যায় না। এই শিল্পী পুরোদস্তুর ইলেকট্রনিক মিউজিক ঘরানার। প্রীতমের সঙ্গে আড্ডা যত দূর গড়ায়, আমরা সেটা আরও উপলব্ধি শুরু করি।
যেভাবে শুরু
শিল্পী হিসেবে তালিম নিয়ে গানের সঙ্গে প্রীতমের সখ্য শুরু হয়নি। প্রীতমের তালিমটা শুরু হয়েছে একটি ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ কায়দায়। হারমোনিয়াম-তবলা নয়, সফটওয়্যারে গানের লেয়ার ভেঙে ভেঙে সুর-তালের জগতে হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর। বড় ভাই প্রতীক হাসান একেকটা গান তৈরির সময় সংগীতায়োজনের (কম্পোজিশন) নতুন নতুন সফটওয়্যার এনে বাসার কম্পিউটারে জমা রাখতেন। আর প্রীতম সেই সফটওয়্যার ব্যবহার করে একেক দিন একেকটা গান পরতে পরতে ভেঙে আবার সুর বাঁধতেন নতুন করে। প্রিয় ব্যান্ড লিংকিনপার্কের গানও ভাঙচুর করার সাহস দেখিয়েছেন প্রীতম। সেটা স্কুলবেলার কথা। গান ভেঙে আবার নিজের মতো করে সফটওয়্যার দিয়ে সুর করে নতুন করে জুড়তেন। এরপর বড় ভাই প্রতীকের সঙ্গে কাজ করে এমন সংগীত পরিচালকদের শোনাতেন সেটা। অন্যের গানের বিট গুনতে গুনতে এভাবেই একদিন হিসাব-নিকাশ, মাপঝোঁক করে নিজের সুর বানিয়ে ফেলেন। ব্যাস, এই ভাঙাগড়া আর বিট গোনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় প্রীতমের যাত্রা।
স্কুল ছিল স্টুডিও
গান নিয়ে এখন পড়াশোনার অনেক সুযোগ চারপাশে। মিউজিক স্কুলগুলোয় গানের মোড়-মুড়কি থেকে শুরু করে শব্দ প্রকৌশলের জটিল সমীকরণও শেখানো হয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এত জনপ্রিয় গানের সংগীত পরিচালক প্রীতম কিন্তু এমন কোনো স্কুলে কখনো পড়েননি। তাঁর স্কুল ছিল সরাসরি গানের স্টুডিও। গানের আঁতুড়ঘরে গান তৈরি হতো, প্যানেলে বসে প্রীতম সেসব দেখে দেখে শিখেছেন কাজ করা। তিনি শুরু করেন সংগীতশিল্পী হাবিব ওয়াহিদের সঙ্গে তাঁর স্টুডিওতে কাজ করে। প্রীতম বলেন, ‘মেন্টরের (গুরু) কথা বলতে হলো বলব হাবিব ভাইয়ের নাম। তাঁর কাছ থেকে যেমন কম্পোজিশনের খুঁটিনাটি শিখেছি, তেমনি শিখেছি ইন্ডাস্ট্রিতে পেশাগত মূল্যবোধ ধরে রেখে কীভাবে কাজ করতে হয়।’ একেবারে স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরপরই প্রীতমের যোগ দেন হাবিবের স্টুডিওতে শব্দ প্রকৌশলের খুঁটিনাটি জানতে। কারণ, গান গাওয়ার চেয়ে, একটা গান তৈরি ছোট ছোট বাইনারি আর বিটের হিসাব খুব টানত প্রীতমকে। হাবিব ওয়াহিদের স্টুডিওতে ‘রিদম’ বিভাগে কাজ করতেন প্রীতম।
নিজের জন্য গান
হাবিবের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই প্রীতম বুঝতে পারেন, প্রত্যেক শিল্পীর একেকটা নিজস্ব মৌলিক সুরের ধাঁচ থাকে। তাই হাবিবের জন্য কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে একদম নিজের সেই সুরটা খুঁজতে থাকেন প্রীতম। একটা সময় পেয়েও যান। পেয়েই সেটা শোনান ‘মেন্টর’ হাবিবকে। এরপর হাবিবই তাঁকে নিজের স্টুডিও থেকে বের করে এনে তুলে ধরেন গানের জগতে। তখনই প্রীতমের সঙ্গে পরিচয় হয় সংগীতশিল্পী অদিতের। ‘যদি বলি হাবিব ভাই আমাকে কম্পোজিশনের আদ্যপান্ত শিখিয়েছেন। তাহলে বলতে হবে অদিত ভাই আমাকে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার কৌশল শিখিয়েছেন। আমি অদিত ভাইয়ের স্টুডিওর একটা অংশ নিজের সেটআপ নিয়ে কাজ শুরু করি। সেখান থেকেই আমার মৌলিক কাজের শুরু।’
প্রীতম আর কী করেন
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে ‘নার্ড’। প্রীতমের সঙ্গে এই শব্দ একেবারেই মিলে যায়। তরুণ শিল্পীরা যেখানে চেষ্টা করেন কাজ শেষ করে সামাজিক আয়োজনগুলোয় গিয়ে মানুষের সঙ্গে মিশতে, পার্টি করতে কিংবা সুযোগ পেলেই দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে, প্রীতম সেই সময়েও তাঁর জানা-শোনার ক্ষুধা জিইয়ে রাখেন। গানের কাজ না থাকলে কখনো দেখেন কী করে উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে এমন সব ভিডিও, কখনো আবার যুদ্ধযান বানানোর কারিগরি নিয়ে জানাশোনা করতে করতে দিন–রাত এক করে দেন। এখন প্রীতম দেখছেন ‘ভয়েজার ওয়ান’ আর মহাকাশে বিচরণকারী নানা ধরনের মহাকাশযানের ব্যাপারে। সেখান থেকেই একটা গল্প প্রীতম আমাদের শোনালেন। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আজকাল এত নেতিবাচকতার (নেগেটিভিটি) মধ্যেও ভালো কাজ করার জন্য প্রীতম অনুপ্রেরণা পান কোত্থেকে? তখনই প্রীতম বললেন ‘ভয়েজার ওয়ান’-এর কথা।
প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন ঘেঁটে বের করলেন মহাকাশযান ভয়েজার ওয়ানের তোলা একটি ছবি। বোঝা গেল, ছবিটি প্রীতমের ফোনে আগে থেকেই ছিল। ছবিটি দেখিয়ে প্রীতম গল্পটা বলা শুরু করলেন, ‘ভয়েজার ওয়ান হচ্ছে নাসার স্পেস প্রোব, যেটা ১৯৭৭ সালে মহাকাশে ছাড়া হয়। এখনো এটা মহাকাশেই আছে। ভয়েজার ওয়ানই এখন পর্যন্ত মহাকাশে সবচেয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে। মহাকাশের সবচেয়ে ছোট গ্রহ প্লুটোকেও অতিক্রম করেছে এটা। সেদিন চোখে পড়ল প্লুটোর কাছ থেকে তুলে ভয়েজার ওয়ানের পাঠানো একটা ছবি। যখনই মনে হবে আমি খুব বড় কিছু হয়ে গেছি, আমার আশপাশের সবাই খুব ছোট, সব খারাপ হচ্ছে, ভালো কিছু করার কোনো মানে নেই; তখন গুগলে গিয়ে প্লুটো থেকে তোলা ভয়েজার ওয়ানের পাঠানো সেই ছবি দেখতে হবে। ছবিটায় পৃথিবীর আকৃতি দেখলে সব হতাশা কিংবা অহংবোধ ভেঙে যাবে। মহাকাশে পৃথিবীটাই যেই ছোট, এর মধ্যে আমার অবস্থান তো কিছুই না। তাহলে আমার এত অহংয়ের তো কোনো মূল্যই নেই। এই ছোট পৃথিবীতে নিজের কাজের ছাপ রেখে যেতে পারাটাই সবচেয়ে জরুরি। বাকি সব প্লুটোর পাশ থেকে তোলা পৃথিবীর ছবিটার মতোই ক্ষুদ্র।’