আয়রন ম্যান-এ বাজিমাত

২০০৫ সালে মার্ভেল সিদ্ধান্ত নিল, অন্যের কাছে আর ধার দিয়ে নয়, বরং নিজেদের চরিত্রদের নিয়ে মুভি বানাবে নিজেরাই। এখন স্বপ্নটাকে খুব সাধারণ বলে মনে হতে পারে তোমার কাছে। কিন্তু প্রায় দুই দশক আগে এটা ছিল আকাশছোঁয়া এক স্বপ্ন। মুভি প্রযোজনার কাজ ছিল মুভি স্টুডিওগুলোর। কমিক বা বইয়ের কোম্পানিগুলো শুধু নিজেদের চরিত্রগুলোর স্বত্ব ধার দিত স্টুডিওগুলোর কাছে। সেই ধারা ভেঙে শুরু হলো নতুন মুভি মুক্তির কাজ। তখনই একটা সমস্যা কড়া নাড়ল মার্ভেলের দরজায়। সিনেমা বানানোর মতো চরিত্র কোথায়?

গত দুই দশকে বিভিন্ন স্টুডিওর কাছে জনপ্রিয় সব চরিত্রের মুভি স্বত্ব বিক্রি করেছে মার্ভেল। সনির কাছে ‘স্পাইডার-ম্যান’; ‘এক্স-মেন’, ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের কাছে; ‘ব্লেড’ নিউ লাইন সিনেমার কাছে। বাকি থাকে শুধু অ্যাভেঞ্জার্স। কমিকস-দুনিয়ায় এমন কথাও প্রচলিত ছিল, ‘যদি কোনো হিরোর কমিকস না চলে, তবে তাকে অ্যাভেঞ্জার্সে পাঠিয়ে দাও।’ এককথায় আয়রন ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, থর, ব্ল্যাক উইডো থেকে শুরু করে পুরো অ্যাভেঞ্জার্স ছিল মার্ভেলের বি-টিম।

এই বি-টিম থেকেই মার্ভেল বেছে নিল নিজেদের প্রথম মুভির সুপারহিরো। বিলিয়নিয়ার আয়রন ম্যানকে পছন্দ করার পেছনে কারণও ছিল। নব্বইয়ের দশকে আয়রন ম্যান কার্টুন বেশ জনপ্রিয় ছিল শিশুদের কাছে। কার্টুনের জনপ্রিয়তা দেখে মার্ভেলের কাছ থেকে আয়রন ম্যানকে ধার নিয়ে সিনেমা বানাতে চেয়েছিল ফক্স। বিলিয়নিয়ার টনি স্টার্ককে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্য রাজি ছিলেন নিকোলাস কেইজ, টম ক্রুজের মতো তারকারা। কিন্তু ব্যাটে-বলে না মেলায় মুভি আর বাস্তবের মুখ দেখেনি। বছর দশেক পর মার্ভেল যখন নিজেদের বি-টিম নিয়ে পরিকল্পনা করছিল, তখন আয়রন ম্যানই ছিল তাদের প্রথম পছন্দ।

২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো আয়রন ম্যান নিয়ে হাজির হয় মার্ভেল

কিন্তু শুধু চরিত্র পছন্দ হলেই তো হবে না, বড় পর্দায় ফুটিয়ে তোলার জন্য মানানসই পরিচালকও তো দরকার। আয়রন ম্যানকে বড় পর্দায় আনতে মার্ভেলের পছন্দ ছিল জন ফ্যাভরো। পরিচালক হিসেবে ফ্যাভরো তখনো নামকরা কেউ হয়ে উঠতে পারেননি। তবে ‘এলফ’ মুভিতে তাঁর ক্যামেরার কারসাজি ও ‘জাথুরা’র ভিএফএক্স যথেষ্ট ছিল মার্ভেল প্রযোজকদের মন গলাতে। আয়রন ম্যানকে বড় পর্দায় তুলে আনার জন্য যে কাঠখড় পোড়াতে হবে, তা জানতেন ফ্যাভরো। ২০০৬ সালে সান ডিয়েগো কমিকনে প্রথমবারের মতো দর্শকদের সামনে আয়রন ম্যানের টিজার নিয়ে হাজির হয় মার্ভেল। তখন পর্যন্ত তারা নিশ্চিত নয়, কে হবেন তাদের মূল তারকা।

ফ্যাভরো ও ফাইগি উঠেপড়ে লাগলেন মার্ভেলের প্রথম সুপারহিরোর সন্ধানে। হলিউডজুড়ে নামকরা তারকাদের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করলেন তাঁরা। টম ক্রুজ, হিউ জ্যাকম্যান, টিমোথি ওলিফ্যান্ট থেকে শুরু করে স্যাম রকওয়েল—মোটামুটি হলিউডের তৎকালীন সেরা তারকাদের প্রত্যেকের নামই ভাবা হয়েছিল। তবে এদের মাঝেই একজন বিশেষভাবে নজর কেড়েছিলেন ফ্যাভরোর—রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। ডাউনি তখন হলিউডের কালোতালিকায়। তাঁকে মুভিতে নেওয়া মানেই নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। চার্লি চ্যাপলিনের চরিত্রে অভিনয় করে অস্কারে মনোনয়নও পেয়েছিলেন। কিন্তু সে অনেককাল আগের কথা। এখনকার ডাউনির সঙ্গে তার কোনো মিলই নেই। এখনকার ডাউনি মাদকাসক্ত, জেলখাটা আসামি। একে তো আয়রন ম্যান মুভি একটা বাজি, তার ওপর রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের মতো লোককে অভিনেতা হিসেবে নেওয়া—মার্ভেলের কেউই রাজি ছিলেন না ফ্যাভরোর দাবিতে।

রবার্ট ডাউনি জুনিয়রকে আয়রন ম্যান চরিত্রে নেওয়ার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করেছিলেন পরিচালক জন ফ্যাভরো।

কিন্তু ডাউনি ও টনি স্টার্কের মধ্যে এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলেন ফ্যাভরো। অত্যন্ত প্রতাপশালী পরিবার থেকে এসেও দুজনেই চলে গিয়েছিলেন বিপথে। স্টার্কের সুপারহিরো হওয়ার চাপ আর ডাউনির অভিনেতা হওয়ার চাপকে একসূত্রে মেপেছিলেন ফ্যাভরো। আয়রন ম্যান চরিত্রের জন্য এমন একজনকেই দরকার ছিল তাঁর, টনি স্টার্ককে হয়তো পর্দায় প্রথমবার দেখবে দর্শক কিন্তু ডাউনিকে ১০ বছর ধরে দেখে আসছে দর্শক। তাঁর চলাফেরা, জীবনযাপন, উত্থান-পতনের সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত। এমন একজনকে টনি স্টার্কের সঙ্গে মেলাতে খুব একটা কষ্ট করতে হবে না দর্শকদের। ফ্যাভরো ও ফাইগি রাজি থাকলেও রাজি ছিলেন না মার্ভেলের অন্য প্রযোজকেরা। বিশেষ করে ডাউনিকে নেওয়ার দ্বন্দ্বে মার্ভেলের প্রযোজকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন আভি আরাড। মার্ভেল স্টুডিওজের হেড অব প্রোডাকশন হিসেবে পদোন্নতি পান কেভিন ফাইগি। মার্ভেলের বাকি প্রযোজকদের রাজি করতে ডাউনির স্ক্রিন টেস্ট নেন কাস্টিং ডিরেক্টর সারাহ ফিন। তাঁর অভিনয় দেখে একে একে সম্মতি দেন বাকি প্রযোজকেরাও। বাকি রইল গল্প আর চিত্রনাট্য!

ফ্যাভরোর সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল এখানেই। চরিত্র, অভিনেতা ঠিক হয়ে গেলেও গল্প আর চিত্রনাট্য তখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। আর্ট মার্কাম ও ম্যাট হলওয়ে তখনো গল্পের প্লট শেষ করতে পারেননি। সিনেমা তৈরির সময় তাই অদ্ভুত এক সমস্যার মুখোমুখি হলো মার্ভেল। অভিনেতা, লাইটবয় থেকে শুরু করে স্টান্টম্যান—সবাই তৈরি অথচ তখনো কাগজের পর কাগজ চিত্রনাট্য লিখে চলেছেন জন ফ্যাভরো ও তাঁর লেখকেরা। শুটিং শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেও মুভির মূল ভিলেন ছিল ম্যান্ডারিন (শাং-চি সিনেমার জু ওয়েনয়ু)। মূল ভিলেন ওবাদায়াহ স্টেইন ছিলেন পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ওবাদায়াহকে দিয়ে দেওয়া হয় মূল ভিলেনের চরিত্র।

শুটিং শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেও মুভির মূল ভিলেন ওবাদায়াহ স্টেইন ছিলেন পার্শ্বচরিত্র

শুটিংয়ের সময় নিয়মিতই দেখা যেত ফোনে স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা বলছেন ফ্যাভরো ও ডাউনি। বন্ধু ও পরিচালক শেন ব্ল্যাকের (পরে আয়রন ম্যান-৩-এর পরিচালক) কাছ থেকে চিত্রনাট্য নিয়ে পরামর্শ চাইছেন। নিয়মিতই চিত্রনাট্য ও সংলাপে নিজের ইচ্ছেমতো পরিবর্তন আনতেন দুজনে। ক্যামেরা চলাকালে সংলাপ তৈরি, ইচ্ছেমতো অভিনয় করা—সবটাই ছিল তাৎক্ষণিক। যা সুযোগ করে দিয়েছিল এজেন্ট কোলসন, ক্রিস্টিন এভারহার্টের মতো ছোট চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে পরিণত করার।

এত সব পরিবর্তন বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিনেমার ভিলেন ওবাদায়াহ স্টেইন চরিত্রে অভিনয় করা জেফ ব্রিজেসের জন্য। গল্প শুনে চরিত্রকে এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে প্রথমবারের মতো মাথার সব চুল কামিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ক্যামেরার সামনে এত পরিমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা পছন্দ ছিল না তার। “আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই সব প্রস্তুতি শেষ করে। আগের রাতে ১০-১২ বার লাইন রিভাইস করি। আর এখানে এসে দেখি স্টুডিওর সব লোকজন বসে বসে স্ক্রিপ্ট লিখছে। নিজের মনকে বোঝালাম, এখানে ২০০ মিলিয়ন ডলারের স্টুডেন্ট ফিল্ম হচ্ছে। জাস্ট এনজয় করো।”

একদিকে যখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে সবার মাথায় হাত, অন্যদিকে পুরোদমে চলছিল আয়রন ম্যানের স্যুট তৈরির কাজ। হ্যাঁ, আয়রন ম্যান সিনেমার তিনটি স্যুটই তৈরি করা হয়েছিল বাস্তবে। প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, আয়রন ম্যানের স্যুট বানানো হবে সিজিআই দিয়েই। কিন্তু পুরো দৃশ্য সিজিআই করতে যে পরিমাণ খরচ করতে হবে, তা বাস্তবে তৈরি করে শুট করতে খরচ হবে অর্ধেকেরও কম। আর জন ফ্যাভরো বরাবরই প্র্যাক্টিক্যাল ইফেক্টের ভক্ত। স্ট্যান উইন্টন স্টুডিওতে তৈরি করা হয় আয়রন ম্যানের প্রতিটি স্যুট। রবার্ট ডাউনি জুনিয়র আয়রন হিসেবে কাস্ট হওয়ার আগেই শুরু হয় স্যুট তৈরির কাজ। মুভি শুটিং ফ্লোরে যাওয়ার আগেই তৈরি ছিল বাস্তবের আয়রন ম্যান।

পরিচালক জন ফ্যাভরো বরাবরই প্র্যাক্টিক্যাল ইফেক্টের ভক্ত।

এত কিছুর মধ্যেও দর্শকদের জন্য একটা সারপ্রাইজ লুকিয়ে রেখেছিলেন জন ফ্যাভরো। ক্রিটিক ও স্পেশাল শোতে জন্য পুরো মুভি মুক্তি পেলেও সেখানে ছিল না কোনো পোস্ট ক্রেডিট সিন। সেটুকু মুক্তি পেয়েছিল মূল মুভির সঙ্গে। স্যামুয়েল এল জ্যাকসনের নিক ফিউরি ছিল শুধু সাধারণ দর্শকদের জন্য। ফিউরি যে আয়রন ম্যানে আছেন, মুক্তির আগে তা জানতেন হাতে গোনা কয়েকজন। সেদিন শুটিং সেটে উপস্থিত ব্যক্তিরা আর স্যামুয়েল এল জ্যাকসনের এজেন্ট বাদে কারোরই জানা ছিল না ফিউরির ব্যাপারে।

অবশেষে ২০০৮ সালের ২ মে মুক্তি পেল আয়রন ম্যান। মুক্তির দিনই সিনেমাটি সারা ফেলে দেয় পুরো বিশ্বে। প্রথম দিনই মুভিটি আয় করে ৯৭ মিলিয়ন ডলার। দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক সবার মুখে ছিল আয়রন ম্যানের প্রশংসা। আয়রন ম্যানের সাফল্য মার্ভেলকে সাহস দেয় নিজেদের নতুন ইউনিভার্স তৈরি করার। এক মাস পর মুক্তি পায়ে হাল্ক। বক্স অফিসে সফলতা না পেলেও তত দিনে ভিত্তিটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মার্ভেলের। আর এর পরের গল্পটা শুধুই সামনে এগোনোর।