টেলর সুইফটের ইরাস ট্যুর : মন্ত্রমুগ্ধকর একদিন

টেলর সুইফটছবি: সংগৃহীত

শহর যখন ‘রেডি ফর ইট’

ডাবলিনের কিছু নির্দিষ্ট রাস্তায় পুলিশ আর নিরাপত্তাকর্মীদের হিড়িক আজ। দুপুর তখন সাড়ে ১২টা। রোদের মতোই এখানে পুলিশের দেখা পাওয়া দুষ্কর। নিস্তেজ আর শান্ত শহর বলেই হয়তো পুলিশ কদাচিৎ দেখা যায়। তাহলে এতশত নিরাপত্তাকর্মীর ব্যাপারটা কী? হেঁটে একটু সামনে যেতেই চোখে পড়ল মানুষের ভিড়। লাইন ধরে কোথায় যেন যাচ্ছে তারা। বাতাসে অন্য রকম এক আভাস—‘আজ কিছু হতে চলেছে’!

তবে শহরের সবাই যেন প্রস্তুত বিশেষ কিছুর জন্য। হবে না-ইবা কেন? টেলর সুইফটের কনসার্ট বলে কথা! বছরখানেক আগে কনসার্টের টিকিট কাটার সেদিনটার কথাই যদি বলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হুমড়ি খেয়ে অনলাইনের লম্বা লাইনে বসে থেকে, চড়া দামে টিকিট পেয়ে কিংবা না পেয়ে, টিকিটের জন্য কী হাহাকারটাই না করেছিলেন তাঁর ভক্তরা! তাই তো সরাসরি গান শোনার দিনে সবাই একেবারে প্রস্তুত। নানা রকম পোশাক আর সাজে দেখা মিলল ভক্তদের। কারও গায়ে ‘টেলর’স ভার্সন’ টি–শার্ট, তো কেউ পরেছে ‘মাই ডটার ইজ আ সুইফটি (অ্যান্ড সো অ্যাম আই)’ লেখা জামা। অনেকেই আবার পুরো পরিবার নিয়ে হাজির। যেখানে কনসার্ট সেই অ্যাভিভা স্টেডিয়াম পৌঁছানোর বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও রাস্তাজুড়ে। এমন সময় কেউ একজন বলল, ‘গ্রিন রুট কি এদিকেই?’ হাঁটা থামিয়ে মাথা নাড়লাম। সমবয়সী গোছের এক আইরিশ মেয়ে। ঝলমলে জামা, গ্লিটার আর হাতের ব্রেসলেট চোখে পড়ল। জানালাম, গ্রিন রুট আমারও গন্তব্য। পরিচয়পর্ব সেরে, একগাদা গল্প নিয়ে আমার সঙ্গে জুটে গেল সে। জানলাম, তার নাম মেগান।

আরও পড়ুন

‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেট’ ও ‘ইটস নাইস টু হ্যাভ আ ফ্রেন্ড’

টেলর সুইফট
ছবি: ফাহমিদা আলম

ইতিপূর্বেই টিকিটের ধরন অনুযায়ী ভক্তদের স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিল টিকিট মাস্টার। সে অনুযায়ী ঠিক সময়েই আমরা পৌঁছে গেলাম স্টেডিয়ামে। কনসার্ট শুরু হওয়ার তখনো কয়েক ঘণ্টা বাকি। সুইফটিরা ‘ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেট’ আদান–প্রদান করে, সে তথ্য আগেই জানা ছিল। ভক্ত থেকে শুরু করে মাঠের নিরাপত্তাকর্মী—সবার হাতভর্তি ছিল টেলরের গানের লিরিক, অ্যালবামের নামসংবলিত এসব ব্রেসলেট। তবে আমি গিয়েছিলাম একেবারেই খালি হাতে। সদ্য পাওয়া নতুন বন্ধু মেগান আক্ষরিক অর্থেই এক ঝুড়ি ব্রেসলেট নিয়ে এসেছিল। আমার হাতে একগাদা ব্রেসলেট পরিয়ে দিল সে। এরপর না চাইতেই কেউ আমাকে দিল টেলরের জন্মদিনসংক্রান্ত ‘১৩’ সংখ্যা লেখা ট্যাটু, আবার কেউ দিল গ্লিটারসহ স্টিকার। ছোট-বড় কয়েকজনের সঙ্গে হয়ে গেল ব্রেসলেট অদল–বদলও। যুক্তরাষ্ট্রে টিকিট না পেয়ে সেখান থেকে আয়ারল্যান্ডে কনসার্ট দেখতে আসা এক মা-মেয়ের সঙ্গেও আলাপ হলো। আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরেক দল। ১২–১৪ বছর বয়সী তিন মেয়ে ও তাদের বান্ধবীসহ এক মা। খাবার কিনতে যেতে চায় সে, কিন্তু জায়গা দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে যেতে পারছে না। তাকে আশ্বস্ত করলাম, তাদের জায়গা আমরা ধরে রাখব। পুরো দল আনন্দ নিয়ে খাবার কিনতে গেল, ফিরে এল আমাদের জন্যও হাতভর্তি খাবার নিয়ে! গল্পের একপর্যায়ে আমরা তখন ঠিক করে নিলাম বিরতি নিতে হলে একজন আরেকজনের জায়গা পালাক্রমে পাহারা দেব। লক্ষ করলাম, আশপাশে থাকা নানা বয়সী এসব অপরিচিত মানুষ একেবারে হুট করেই কেমন বন্ধু হয়ে গেল। কেউ কেউ তো যুক্ত হয়ে গেল ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামেও। টেলরের গানের মতোই বলা যায়, ইটস নাইস টু হ্যাভ আ ফ্রেন্ড!

আরও পড়ুন

প্যারাবিহীন প্যারামোর

ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬টা ১৫। গানের দল ‘প্যারামোর’ মঞ্চে উঠল। বিশাল মঞ্চ। শিল্পী এক প্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত থেকে তাঁকে দেখা যায় না। মঞ্চের মাঝবরাবর সামনের দিকের অংশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। প্যারামোরের মূল গায়িকা হেইলি উইলিয়ামস যখন অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে গান করছেন, মনে মনে তখন ভাবছি, টেলরকে স্পষ্ট দেখতে পাব তো? একটা গান শেষ হতেই হেইলি আমাদের সামনে চলে এলেন। দর্শকদের উদ্দেশ করে বললেন, ‘উই আর প্যারামোর!’ তাঁদের দল যে অনেকের কাছেই অপরিচিত এবং সেটা নিয়ে যে তাঁদের মোটেও ‘প্যারা’ নেই, সেটাও জানিয়ে দিলেন তিনি। বললেন, ‘আমি জানি অনেকেই প্যারামোরকে এই প্রথম শুনছ। গানের লিরিক না জানলেও আমার সঙ্গে সুর মেলালেই চলবে।’ এরপর টানা ৪৫ মিনিট গান শোনাল বেশ প্রাণবন্ত এই রক ব্যান্ড।

দ্য টেলর সুইফট

টেলর সুইফট
ছবি: ফাহমিদা আলম

পরীক্ষার হলে যেমন ঠিক মিনিট-সেকেন্ড হিসাব করে পরীক্ষা শুরু হয়, এই কনসার্টেও তেমন সময় ব্যবস্থাপনা লক্ষ করলাম। ঘড়ির কাঁটায় ৭টা ১৪ বাজতেই স্ক্রিনে ১ মিনিট সময় গণনা শুরু হলো। কারও আর বুঝতে বাকি নেই যে টেলর এখন মঞ্চে উঠবেন। ৪...৩...২...১...! টেলরের দল প্রথমে মঞ্চে চলে এল। আর তার কিছু পরেই ‘ক্রুয়েল সামার’ গাইতে গাইতে দেখা দিলেন টেলর সুইফট। তাঁকে দেখতে পেয়ে জোরে চিৎকার করে উঠল স্টেডিয়ামে থাকা প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। পাশে থাকা মেগানসহ অনেককেই দেখলাম চোখের পানি দিয়ে সমুদ্র বানিয়ে ফেলছে। প্রথম গান শেষ হতেই টেলর–ভক্তদের বলে উঠলেন, ‘ডাবলিন, আমরা চলে এসেছি! তোমাদের জন্য আমার এতটাই ভালো লাগছে যে নিজেকে খুব ক্ষমতাবান কেউ মনে হচ্ছে!’ কথার সঙ্গে মিলিয়ে তিনি গাইতে শুরু করলেন ‘দ্য ম্যান’ গানটি। ‘লাভার’ এরার একের পর এক গান দিয়ে টেলর তখন জগতের আনন্দযজ্ঞে সবাইকে মাতিয়ে তুলেছেন।

আরও পড়ুন

প্রত্যেক এরার জন্য টেলরের ছিল ভিন্ন ভিন্ন পোশাক। বিখ্যাত সব ফ্যাশন ডিজাইনারের করা এসব পোশাক ছিল বিভিন্ন অ্যালবামের থিমের সঙ্গে মিল রেখে। পোশাকের পাশাপাশি মঞ্চের পরিবেশও থিম অনুযায়ী পরিবর্তন হচ্ছিল। এই যেমন ‘ইনচ্যানটেড’ গান করার সময় টেলর পরলেন রাজকন্যাদের মতো পোশাক। তার সঙ্গে তৈরি করলেন চমৎকার এক আবহ। সত্যিই যেন সুরে সুরে কিছুক্ষণের জন্য সবাই রূপকথার দেশে চলে গেল বিনা পাসপোর্টে! আবার ‘১৯৮৯’ এরার গানের সময়, তাঁর পরনে ছিল আয়ারল্যান্ডের পতাকার রঙের স্কার্ট। এক এরা থেকে আরেক এরার গানে ট্রানজিশনের সময়টাতে তিনি তেমন কোনো বিরতিই নেননি। লক্ষ করলাম, তাঁর দলের অন্য গায়কেরা পুরো সময় গাইলেও সব গানের সব অংশ গান না তিনি।

যতশত রীতিনীতি ও ‘টোয়েন্টি টু’

ছবি: ফাহমিদা আলম

পুরো সময়েই টেলর ও তাঁর ভক্তরা ইরাস ট্যুরের বিশেষ কিছু ‘রিচ্যুয়াল’ অনুসরণ করছিলেন। এই যেমন ‘ইউ বিলং উইথ মি’ গানের কোনো অংশে দুবার হাত তালি দেওয়া কিংবা ‘ব্ল্যাংক স্পেস’ গানের মধ্যে নিজের শহরের নাম চেঁচিয়ে বলা। টেলরের নানিকে নিয়ে লেখা গান ‘মারজরি’র ক্ষেত্রে ছিল ভিন্ন চিত্র। সবাই চুপ হয়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে তাঁকে সম্মান দেখাল। তবে ‘টোয়েন্টি টু’ গানের রিচ্যুয়ালের কথা না বললেই নয়। প্রতি কনসার্টেই টেলর তাঁর মাথায় পরা হ্যাটটা মঞ্চের সামনে থাকা কোনো এক ছোট্ট মেয়েকে পরিয়ে দেন নিজ হাতে। ডাবলিনেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে মঞ্চের খুব কাছে থাকায়, সেটা একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো আমাদের।

আরও পড়ুন

হাতে তাঁর অ্যাকুস্টিক গিটার

বিভিন্ন গানের সময়ই টেলরকে একেবারে সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে আমাদের ঠিক সামনেই রাখা ছিল এক মাইক্রোফোন স্ট্যান্ড। ছবি তোলার সময় বিরক্তিকর সেই স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এটা মঞ্চে এভাবে রেখে দেওয়ার মানেটা কী? একটু পরই সেই রহস্য উদ্‌ঘাটিত হলো। ৩ ঘণ্টা ১৫৪ মিনিটের বিশাল এক সেট লিস্টে থাকে অ্যাকুস্টিক ভার্সনও। এই সময় টেলর গিটার হাতে একা পারফর্ম করেন কিছু ‘সারপ্রাইজ সং’। টেলর এসে দাঁড়ালেন সেই বিরক্তিকর মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডের সামনে। মানে আমাদের ঠিক কয়েক হাত সামনে! ছানাবড়া চোখ নিয়েই দেখলাম তিনি ‘স্টেট অব গ্রেস’ গাইতে শুরু করেছেন। এত কাছ থেকে তাঁকে পারফর্ম করতে দেখে বিরক্তিকর মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডকে তখন আর বিরক্তিকর লাগল না।

ফোকলোর ও আয়ারল্যান্ড

সবার হাতভর্তি ছিল টেলরের গানের লিরিক, অ্যালবামের নামসংবলিত ব্রেসলেট।
ছবি: ফাহমিদা আলম

ইরাস ট্যুর এতগুলো শহরে হয়েছে যে নির্ভুলভাবে ‘স্ক্রিপ্ট’ অনুযায়ী পারফর্ম করে টেলর ও তাঁর দল। কোন গানের পর কতটুকু বিরতি নেওয়া হবে, কত সময় চুপ করে দর্শকের উৎফুল্ল চিৎকার শোনা হবে—সবটাই যেন মাপা। তবে আয়ারল্যান্ড নিয়ে বিশেষ কিছু কথা বলতে ভোলেননি টেলর। ফোকলোর অ্যালবামের গান করার একপর্যায়ে জানালেন, ‘ফোকলোর অ্যালবাম আয়ারল্যান্ডের সঙ্গেই যায় বেশি। আইরিশ উচ্চারণ এতই চমৎকার যে তারা সাধারণ কোনো গল্প করলেও সেটাকে দুর্দান্ত মনে হয়।’ আইরিশদের ‘অতুলনীয় গল্পকার’ বলেও প্রশংসা করলেন তিনি।

আরও পড়ুন

বাসা কিংবা বাস্তবতায় ফেরার পালা

একদম কাছ থেকে দেখতে পেলাম টেলর সুইফটকে।
ছবি: ফাহমিদা আলম

টেলর সুইফট যখন তাঁর দল নিয়ে কনসার্ট শেষ করলেন, তখন শুরু হলো ঝলমলে আতশবাজি। দর্শকেরা সেদিকে মন দিতেই টেলর চলে গেলেন ব্যাক স্টেজে। অন্যান্য কনসার্টে ‘ওয়ান মোর’ বলে ভক্তদের অনুরোধ শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে সেটা হলো না। হবেই–বা কেন? ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট গান শুনে সবার মন তখন আনন্দে পরিপূর্ণ। সবার মধ্যেই এক ঘোরলাগা অনুভূতি। শুধু গান উপভোগ করা নয়, পুরো অভিজ্ঞতাই যে সব কনসার্ট থেকে অনন্য! স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে চোখে পড়ল, বাইরে শত শত ভক্ত দাঁড়িয়ে। ঘোরলাগা সেই অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়েই বাড়ির পথে পা বাড়ালাম আমরা।

আরও পড়ুন