বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জিনিসের নাম বলতে বলা হলে তোমরা অনেকেই নিশ্চয়ই রিকশার কথা তুলবে। কিন্তু আদতে রিকশা কিন্তু নিখাদ দেশীয় জিনিস নয়। এর উদ্ভাবন প্রথম হয়েছিল জাপানে, ১৮৬৯ সালে।
তথ্যটা জেনে মন ভেঙে গেল কি? খুব ইচ্ছা করছে জিনিসটায় নিজেদের সিলমোহর বসাতে? রিকশার নিজস্বতা দিয়ে ব্যাপারটাকে খাঁটি বাংলাদেশি করে ফেলতে? তা আমরা অনেকাংশেই করে ফেলেছি। দেশে যে রিকশা দেখা যায়, তা আমাদেরই তৈরি। তা ছাড়া তথ্যসূত্র আর ইন্টারনেট না ঘাঁটলে আজকাল অনেকেই রিকশাকে বাংলাদেশি বস্তু ভেবে নিতে আপত্তি তোলে না বিশেষ। কিন্তু রিকশা কেবল দেশেই আটকে থাকেনি, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তো বটেই, এমনকি ইউরোপের নানা শহরে পাওয়া যায় হাতে টানা, প্যাডেল-সক্ষম কিংবা যন্ত্রচালিত রিকশার দেখা। যাত্রীরা দিব্যি তাতে হওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে আপন মনে। সেগুলোকে হয়তো ওই সব দেশের স্থানীয় বিলাসিতা বলেও ধরে নিচ্ছে!
ইয়াকিতাতে জাপান-অ্যানিমের গোড়ার কথাও ঠিক সেটাই। নানা দেশে নানা রুটি; ইংরেজ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ—সব দেশেরই আছে নিজস্ব ব্র্যান্ডের রুটি, অথচ জাপানের কোনো নিজস্ব রুটি নেই। আর সেই রুটি গড়তেই যত তোড়জোড়। নানা কারিগর বিভিন্ন সময় নানাভাবে কল্পনা করেছে জাপানিজ রুটি তৈরির কথা। এই গল্পের নায়ক ‘আজুমা কাজুমা’-ও সেই দলের একজন অগ্রদূত। মাত্র ৬ বছর বয়স থেকে শুরু হয় তার এই যাত্রা।
মূলত জাপানিরা বাংলাদেশিদের মতোই ভাতপাগল জাতি। রুটির বিশেষ স্থান নেই তাদের নিত্যযাপনে। আজুমাদের পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ছেলেটির দাদু ভাত-অন্তঃপ্রাণ। ওদিকে আজুমার বড় বোন আধুনিক। নিজে তো রুটি খেতে আগ্রহী বটেই, পরিবারের খাদ্যতালিকায়ও নিয়মিত রুটি চাই তার। স্বভাবতই তাই আজুমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিজের দলে এনে রুটির দাবি জোরদার করার চেষ্টা চালায় সে। আজুমা কাজুমার দাদু আবার নাতির দাবি ফেলতে পারে না একেবারেই, সেটাও ওকে দলে টানার অন্যতম কারণ।
যদিও কাজটা সহজ হলো না, কারণ কাজুমা নিজেও ভাতে অভ্যস্ত। বোন একপ্রকার জোর করেই ওকে ধরে নিয়ে গেল একটা বেকারিতে। সেখানে রুটি নির্মাতা ফ্রান্সফেরত কারিগর। রুটি নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল, কিন্তু জাপানের গ্রাম্য বাতাবরণে এসে স্বপ্ন অনেকাংশেই ভেস্তে গেছে। এখানের মানুষ রুটিতে মোটেই আগ্রহী নয়। তবে তার চেষ্টায় কোনো খাদ নেই। এই দোকানের রুটিই আজুমাকে জোর করে খাওয়াল বোন, আর তাতেই হলো চমৎকার। আজুমা এক ধাক্কায় হয়ে উঠল সুস্বাদু রুটির ভক্ত। ক্রমান্বয়ে তাদের বাড়িতেও প্রচলিত হলো রুটি। শুধু খেয়েই ক্ষান্ত দিল না আজুমা, তার ভেতর গড়ে উঠল রুটি তৈরির আগ্রহ। ফ্রান্সে প্রশিক্ষিত কারিগর থেকে সে পেল রুটি তৈরির প্রাথমিক শিক্ষা। আর আজুমার আগ্রহ উদ্বুদ্ধ করল ওই কারিগরকেও, সেও নতুন তাগিদ নিয়ে তৈরি হলো তার নিজস্ব রুটি উদ্ভাবন আর প্রচলনে। গ্রামের দোকানটি বন্ধ করে সে ভাগ্য অন্বেষণে হলো শহরমুখী।
মূলত এভাবেই শুরু হয় হাস্যরসাত্মক ও রুটিভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক ধারাবাহিক ‘ইয়াকিতাতে জাপান’। মাঙ্গাকা তাকাশি হাশিগুচির ২৪২ অধ্যায়ব্যাপী এই মাঙ্গার প্রকাশকাল ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। যা অ্যানিমে ধারাবাহিকের রূপ পায় ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত। ৬৯ পর্বব্যাপী এই যাত্রায় উঠে এসেছে আজুমার রুটি নির্মাণ ও তা দিয়ে বিশ্বজয়ের চমৎকার যাত্রাটুকু। এর পরতে পরতে ছড়ানো আছে প্রতিযোগিতা, হাসি, রহস্য, ষড়যন্ত্র, বন্ধুত্ব, শত্রুতা, দলবোধ, সহমর্মিতা আর বিশেষ সব অনুভূতির আবেশ।
শুরুর কয়েক পর্বের মধ্যেই কাহিনি চলে আসে প্রতিযোগিতার পর্যায়ে। তত দিন আজুমার জীবনে কেটে গেছে আরও ১০টি বছর। নিজের মতো করে ৫৫টি ভিন্নতর রুটি নির্মাণ করে ফেলেছে সে তত দিনে, যেগুলোকে সে ‘জাপান’ বলে ডাকে। যেমন জাপান ১, জাপান ২৪, জাপান ৫০ প্রভৃতি। এখানে বলে রাখা ভালো জাপানিজ ভাষায় ‘পান’ মানে হলো ‘রুটি’। সুতরাং জা-পান অর্থে সে মোটের ওপর জাপানের রুটি বোঝাতে চায়। নামকরণের এই ধারা পরে সিরিজের অন্য কিছু প্রতিযোগীর মধ্যেও সংক্রমিত হতে দেখা যায়।
১৬ বছর বয়সী আজুমা বোনের সক্রিয় সহযোগিতায় পৌঁছে পান্তাসিয়া গ্রুপের প্রতিযোগিতায়। সিরিজ অনুযায়ী তৎকালীন জাপানে যে কয়টি বড় রুটির নির্মাতা আছে, পান্তাসিয়া তার মধ্যে অন্যতম সেরা। সুতরাং এখানে চাকরি পেতে অনেকেই মরিয়া। এখানেই আজুমার পরিচয় হয় সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চরিত্রের সঙ্গে, যারা পরে তার প্রতিযোগী, বন্ধু এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায়। এদের মধ্যে কাওয়াচি, কুরয়ানাগি, সুকিনো, কাই প্রমুখ রয়েছে।
বয়সে নবীনতম হলেও আজুমার রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতি। সেই সঙ্গে তার রয়েছে উত্তপ্ত হাতের সক্ষমতা। সিরিজে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোলার-হ্যান্ড’। এ ধরনের উষ্ণতা রুটি নির্মাতাদের মধ্যে বিরল। যাদের হাতের উষ্ণতা এমন, তারা খুব সহজেই গুঁড়া ময়দা আনুষঙ্গিক উপকরণের সঙ্গে মিশিয়ে দলা বানিয়ে ফেলতে পারে। এসব দলা দিয়ে তৈরি রুটিও হয় সুস্বাদের উপযোগী।
নানান ঘটনাচক্র পাড়ি দিয়ে যখন প্রতিযোগিতা শেষ হয়, তখন দেখা যায় আজুমা ঠিক সুযোগ পেয়ে গেছে পান্তাসিয়ায় কাজ করার। আর মূল কাহিনি এর পর থেকেই শুরু হয়। আজুমার দলে যোগ দেয় কাওয়াচি আর সুকিনো। এই পর্যায়ে গল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘মাতসুশিরো কেন’-এর আগমন ঘটে। পান্তাসিয়ার মিনামি শাখার ম্যানেজার কেন, ফেঞ্চ রুটি তৈরির ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। ওই শাখারই আরেক কর্মী কিনোশিতা কাগেতোর সঙ্গেও পরিচয় হয় একই সময়ে। নানান আঙ্গিকে পুরো সিরিজ ধরে এরা হাসির খোড়াক জোগান দেয়।
পুরো সিরিজ ধরে রয়েছে একের পর এক প্রতিযোগিতা। যেখানে সহযোগী বদল হলেও আজুমা ছিল অগ্রদূত। বিবিধ রুটি গড়ে সে চমৎকৃত করেছে বিচারকদের; জয় করেছে দর্শকের ভালোবাসা, সহযোগী আর প্রতিযোগীদের শ্রদ্ধা। তবে লড়াইয়ের থেকে এসব প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মুখ্য হয়েছে রুটি খেয়ে বিচারকদের দেওয়া প্রতিক্রিয়া। গল্পে নানা সময় বিচারক হিসেবে দেখা যায় কুরয়ানাগি রুয়োকে। আর অতি অবশ্যই বেশ বড় একটা সময় বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আন্তর্জাতিক সার্কাস-ক্লাউন ‘বলনেজ’। আজুমা-কাওয়াচি-কাই কিংবা অন্য প্রতিযোগীদের সুস্বাদু রুটি খেয়ে এদের অঙ্গভঙ্গি হয় কুকুরসদৃশ। আবার চলে যায় স্বর্গে, কিংবা নিতে পারে পানিতে নিশ্বাস, সিলিংয়ে লটকে ঘুরতে থাকে চরকির মতো, চলে যায় মহাকাশে, হাজির হয় জঙ্গলে, ফিরে পায় হারানো মানুষের সঙ্গ! এসব প্রতিক্রিয়া দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে তোমাদের। আবার মাঝেমধ্যে চলে এসেছে অন্য কোনো পপ-কালচার দৃষ্টান্ত। দেখা গেছে অন্য কোনো অ্যানিমে ধারাবাহিকের পরিবর্তিত রূপ, যা দিয়েছে আরও হাসির খোরাক। তবে মাঝেমধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে দীর্ঘায়িত, সেসব ক্ষেত্রে তোমাদের কিছুটা বিরক্ত লাগাও অস্বাভাবিক নয়। আমি অবশ্য ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেব। কেননা এই দীর্ঘ কথনের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, ধৈর্য ধরে থাকলে সেসব পরিষ্কার হবে।
আগেই বলেছি, এই সিরিজে আছে গভীর ষড়যন্ত্র আর কুচক্রের জেরবার, যার কেন্দ্রে রয়েছে পান্তাসিয়া গ্রুপের উত্তরাধিকারপ্রাপ্তির লড়াই। সিরিজের সবচেয়ে কুচক্রী চরিত্রগুলোর একজন এবং পান্তাসিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রুটি নির্মাতা সংস্থা ‘সেন্ট পিয়েরে’-এর মালিক রয়েছে চক্রান্তের মূলে। নানান সময় এরা বাধার সৃষ্টি করে প্রতিযোগিতায়; জোর করে হারাতে তৎপর হয় আজুমা ও তার দলকে। এসব সামাল দিতে কখনোবা বেশ বেগ পেতে হয় ওদের। তবে আজুমার চরিত্র তাকে সাধারণত চাপ নিতে দেয় না। একেবারে সাদা মনের মানুষ আজুমা সহজেই সবাইকে বিশ্বাস করে, প্রতারিতও হয়, কিন্তু তার যোগ্যতা এবং পরিশ্রম বরাবর সহায় থাকে। মৃত্যুপথ থেকেও বেঁচে ফেরে সে, মজবুত করে বিজয়ী হওয়ার দাবি। পরাজয় তাকে হতাশ করে না, বরং আরও ভালো করার তাগিদ দেয়। এ ক্ষেত্রে কাওয়াচি কিছুটা ব্যতিক্রম। নানা সময় তাকে ভেঙে পড়তে দেখা যায়। আজুমার মতো ‘সোলার-হ্যান্ড’ না থাকায় তাকে পাড়ি দিতে হয় অন্য উপায়ে নিজেকে সক্ষম করার কঠিন পথ। প্রতিভার অভাব সে ঘোচায় বিদ্যা আর পরিশ্রম দিয়ে।
গল্পের হাস্যরস ধরে রাখার দায়িত্ব যে কয়টি চরিত্রের ওপর ন্যস্ত, তার ভেতর অন্যতম প্রধান কাওয়াচি। এ ছাড়া অবশ্যই কুরয়ানাগি, কেন, কাগেতো, বলনেজ—নানান সময়ে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। আবার মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে গেছে গল্পে ভেতরে থাকা কাল্পনিক চরিত্র ‘কিড’; সে যতবারই যে চরিত্রেই এসেছে, হাসিয়ে গেছে! তবে এদের হাসি জোগান দেওয়ার পদ্ধতি ভিন্ন। যেমন কাগেতো ছেলেটি মিনামি ব্রাঞ্চে কাজ করে কেবল সুকিনোর প্রেমে পড়ে। ওখানের সব কাজ তার একাই করতে হয় বেশির ভাগ সময়, বাকিরা গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই নিয়ে তার নানা সময় অভিযোগ আর রাগ করার ভঙ্গিটি বড় আমোদিত করে। ম্যানেজার মাতসুশিরোর মাঝেমধ্যে অন্য চরিত্রকে নকল করে কথা বলার ভঙ্গিটি তার হাসি জোগানোর অন্যতম উপায়। কাওয়াচি হাসায় তার অভ্যাস আর বাচনভঙ্গি দিয়ে। মাঝেমধ্যে কারও ক্ষতি করতে গিয়ে সে নিজেই গাড্ডায় পড়ে, কিংবা সবার স্বার্থে হয়ে ওঠে বলির পাঁঠা। ক্লাউন বলনেজ হাসায় তার নানান অঙ্গভঙ্গি দিয়ে, কারসাজি করে। আর কুরয়ানাগির রাগ নিদারুণ দেখে তোমাদের নিয়মিত হাসি পাবে।
সিরিজের বিভিন্ন সময়ে ফিরে আসতে দেখা যায় অতীত প্রতিদ্বন্দ্বীদের। যেমন কাওয়াচি, কাই—একাধিক প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছে আজুমার বিপক্ষে। মোকোয়য়ামা কিংবা সাচিহোকো চরিত্রগুলোও তাদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেছে লড়াইয়ের। এদের কাহিনিও তোমাদের স্পর্শ করবে। ইয়াকিতাতে জাপান সিরিজটি এই কারণেও বিশেষ, এখানে শুধু আজুমার বিখ্যাত হয়ে ওঠার লড়াই-ই নয়, বরং দেখানো হয়েছে আরও বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্রের ব্যক্তি লড়াইয়ের কাহিনি। কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে উঠে এসেছে তাদের অতীত ও বর্তমানের নানান দিক। দেখা গেছে তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি অভিমানের কারণ ও পরিণতি।
আশা করি, এতক্ষণে ‘ইয়াকিতাতে জাপান’-এর পক্ষ থেকে কিছুটা ওকালতি করতে পেরেছি তোমাদের কাছে। সত্যি বলতে, নিজের কাছে যে সিরিজ ভালো লাগে, তা–ই নিয়ে চলে আসি তোমাদের দরবারে। উদ্দেশ্য, ভালো লাগাটুকু তোমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া, সবাই মিলে একত্রে আরও ভালোবাসা তৈরি করা। আমি নিজে অন্তত চারবার সিরিজটি দেখেছি। যদি আরও কয়েকবার দেখতে বসি অনায়াসে দেখে ফেলতে পারব। এই কাহিনি সচরাচর পুরোনো হওয়ার নয়। আজুমা রুটি গড়ে বিশ্বজয়ের এক ফাঁকে কখন তোমাদের মন জয় করে নেবে টেরটিও পাবে না। চরিত্রগুলোর কর্মকাণ্ড তোমাদেরও বন্ধু বানিয়ে নেবে চলার পথে। যদি দেখে ভালো লাগে, তবে অন্য বন্ধুদেরও জানিয়ো এই সিরিজের কথা। আধুনিক অ্যানিমের ভিড়ে বিস্মৃতপ্রায় এই ধারাবাহিকও টিকে থাকুক, যথার্থ স্বীকৃতি পাক, এইটুকুই আশা।