‘দেখে যদি ভূতের আদল
ভয় পেয়ে দাও ক্ষান্ত,
ধরবে এসে ভূত বাবাজি
খপাৎ করে জ্যান্ত।
দিব্যি আছে তারাও জেনো
তোমার-আমার সঙ্গে,
ইউরোপ বা জাপান ঘুরে
হয়তোবা এই বঙ্গে!’
তা বাবা ভূতের গল্প শুনে কাবু হয়নি এমন শিশু-কিশোর তোমরা দেখে থাকতে পারো, কিন্তু আমার চোখে বড় একটা পড়েনি। ইহজগতে যে কয়টি সর্বজনীন জিনিস দেশ-কাল-পাত্রনির্বিশেষে নির্দ্বিধায় বেঁচেবর্তে রয়েছে ভূত তার মধ্যে অন্যতম আদি ও অকৃত্রিম। ভালো করে খুঁজে দেখলে হয়তো তোমাদের পরিবারেই এমন কাউকে পেয়ে যাবে যে নিজে কিংবা তার পরিচিত কেউ ভূতের কবলে পড়েছিল কোনো এক ঘোরতর কুক্ষণে! তবে তা যদি একান্তই না পেয়ে থাকো, তবে টুক করে বসে পড়তে পারো জাপানিজ অ্যানিমে মিয়েরুকো চান সঙ্গী করে।
অ্যানিমের প্রায় শুরুতেই দেখা মিলবে প্রধান চরিত্র মিকোর। বাপহারা মেয়েটার পরিবারে আছে মা আর ছোট এক ভাই। ভাইয়ের সঙ্গে তার বেশ স্বাভাবিক সম্পর্ক। খুনসুটি যেমন হয়, তেমন আবার রাতের অবসরে একসঙ্গে বসে টেলিভিশনও দেখে ওরা। তবে মিকোর সবচেয়ে কাছের মানুষ মা কিংবা ভাই নয়; বরং তার অতি প্রিয় বান্ধবী ‘হানা’। প্রতিদিন স্কুলে তারা একে অন্যের সঙ্গে সার্বক্ষণিক তো থাকেই, এমনকি বাড়ি ফেরার পথেও স্মার্টফোনে খবর রাখে পরস্পরের। দুজনে এক আত্মা এক প্রাণ।
বলা নেই কওয়া নেই, একদিন হঠাৎ করেই মিকো দেখতে শুরু করল তার চারপাশে থাকা ভূতদের। তারা সাধারণত ওকে দেখলেই এগিয়ে এসে কথা বলার চেষ্টা করে। এসব ভয়ালদর্শন ভূত দেখে তো মেয়েটার আক্কেলগুড়ুম! কিন্তু বহু কষ্টে সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। কারণ, ওর বদ্ধমূল ধারণা, একবার যদি তারা বুঝে ফেলে যে ও তাদের দেখতে পাচ্ছে, তাহলেই সর্বনাশ। সুতরাং মিকোর লড়াই শুরু হয়ে গেল স্নায়ুর বিরুদ্ধে; প্রচণ্ড ভয় পেয়েও এড়িয়ে যাওয়া, দেখেও না দেখা, আর সবকিছু বাঁচিয়ে নিজের বন্ধুকে নিরাপদ রাখার এক নিয়মিত সংগ্রাম জুড়ে বসল ওর নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞে। সে কি আদৌ পারবে বন্ধু, আত্মীয়দের কিংবা নিজেকে নিরাপদ রাখতে? কীভাবে সামাল দেবে ক্রমে বাড়তে থাকা ঝুঁকি? এসব নিয়েই সাজানো হয়েছে স্টুডিও পাসিওয়ানের ১২ পর্বের এই নাতিদীর্ঘ আয়োজন।
মিয়েরুকো চান অ্যানিমেটি তৈরি হয়েছে একই শিরোনামে রচিত মাঙ্গার ওপর। কাহিনিকার তোমোকো ইজুমির এই কাজ প্রথম প্রকাশিত হয় অনলাইন কমিকস হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তা উত্তর আমেরিকার প্রকাশনী ‘ইয়েন প্রেস’ লাইসেন্স করে এবং ভলিউম আকারে প্রকাশের কাজে হাত দেয়। মাঙ্গা সিরিজটি এখনো অনিয়মিতভাবে চলছে এবং তা ইংরেজিতেও প্রকাশিত হচ্ছে।
ফিরে আসা যাক অ্যানিমে প্রসঙ্গে। সিরিজটি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেও অন্যতম কেন্দ্র ছিল মিকো এবং হানার বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল। শ্রেণিকক্ষে যেমন দেখা গেছে ভূতের আনাগোনা, তেমন দেখা গেছে মাঠ, ওয়াশরুম, উদ্যান, করিডর কিংবা বিশ্রামকক্ষেও। এত আতঙ্কের ভিড়েও নিখুঁতভাবে রাখা আছে জাপানের কিশোর-কিশোরীদের স্কুল কার্যক্রমের নানা দিক। আর এখানেই মিয়েরুকো চান আরও অনেক অ্যানিমে থেকে আলাদা। এতে স্বাভাবিকতা আর অস্বাভাবিকতা পাশাপাশি অবস্থান করে। ভূতের কারখানায় অধিকাংশ ছেলেমেয়েই স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছে। কারণ, তাদের চোখে ভূত বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। কেবল দুজন সেখানে ভূত দেখতে পায়—মিকো আর সিরিজ শুরুর কিছু পরে দৃশ্যপটে আসা ‘ইউরিয়া’। অবশ্য ইউরিয়া মিকোর মতো অতটা স্পষ্টভাবে ভূত দেখে না। আর অতি ভয়ানক ভূতগুলো তার চোখে ঠিক ধরা পড়ে না। মিকো আর ইউরিয়ার এই পার্থক্যটুকু পুঁজি করে সৃষ্টি হয়েছে বহু হাসির মুহূর্ত। যেখানে মিকো হয়তো ভয় পেয়ে কিছু একটা করছে, আর ওদিকে ইউরিয়া সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছে। তার চোখে মিকো এক মহাশক্তিধর ওঝা, যে তুখোড় দক্ষতায় ভূত বিনাশ করতে ব্যস্ত!
আনন্দ এসেছে হানা আর মিকোর ছোট ভাই ইওস্কের কারণেও। ইওস্কে বারকয়েক তার বোনকে বিপদ থেকে দূরে রাখতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। সে পিছু নেয় মিকোর, ভাবে কোনো বদ ছেলের পাল্লায় পড়ে বোন বড় ঝামেলায় আছে। আর সেসব আঙ্গিকে উঠে আসে হাস্যরস। অন্যদিকে হানা বিরাট খাদক, দিনে ৮-১০ বার না খেলে তার চলে না। কিছুক্ষণ পরপরই তার খাবার খুঁজে ফেরার ব্যাপারটা দর্শককে নিঃসন্দেহে হাসাবে। এসব বাদেও ভুল করে ভয় পেয়ে যাওয়া, ভূতকে মানুষ কিংবা মানুষকে ভূত ভেবে নেওয়া, হানাকে ভূতের অস্তিত্ব বুঝতে না দেওয়ার জন্য ভিন্ন পথে ঘাবড়ে দেওয়ার চেষ্টা, এসব করে মিকো নিয়মিত প্রচণ্ড ভয়ের মাঝেও হাসির খোরাক জুগিয়েছে। হাসি এবং ভয়ের এই মেলবন্ধন সাহায্য করবে তোমাদের একঘেয়েমি কাটিয়ে দিতে।
সিরিজের ফাঁকে ফাঁকে খুব সচেতনভাবে কিছু কুর্নিশ জানানো হয়েছে কিংবদন্তি অ্যানিমে নির্মাতা হায়াও মিয়াজাকির বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রকে। যেমন একপর্যায়ে সিনেমা দেখার কথা উঠতেই চরিত্ররা বলেছে ‘মাই নিয়ারবাই তোরোরো’, ‘প্রিন্সেস ওবোরোগে’, ‘দ্য ডগ রিটার্নস’, ‘ডিমনড অ্যাওয়ে’ চলচ্চিত্রের নাম, যা যথাক্রমে মিয়াজাকির তৈরি মাই নেইবার তোতোরো, প্রিন্সেস মনোনোকে, দ্য ক্যাট রিটার্নস, স্পিরিটেড অ্যাওয়ে চলচ্চিত্রগুলোর কথাই স্মরণ করায়। এমনকি স্টুডিও ঘিব্লির সঙ্গে মিলিয়ে এসব সমার্থক চলচ্চিত্রের নির্মাতা বলা হয়েছে স্টুডিও মিব্লিকে। সুতরাং, এ বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকে না।
আরও বিশেষ দুটি চরিত্রের মধ্যে অন্যতম হলো, তান্ত্রিক গডমাদার আর মিকোর ক্লাসটিচার। তাদের সম্পর্কে আপাতত কিছুটা রহস্যই থাক, সবটা বলে দিলে মজা ফুরিয়ে যাবে।
ভূতদের রকমফের ঘিরে কিছু রহস্য জিইয়ে রাখা হয়েছে এখানে–সেখানে। দেখানো হয়েছে নানান প্রকার ভূত। তাদের কেউ অন্য ভূতকে খেয়ে ফেলছে, কেউবা অন্যকে পরাজিত করছে, কেউ আবার সাহায্য প্রার্থনা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে পথে পথে। আত্মীয়দের উপকারে আসতে প্রাণান্ত চেষ্টা করা ভূতেরও দেখা মেলে ঘটনাচক্রে। সব মিলে ভূতেদের সবাইকেই এক কাতারে ফেলা যাবে না। একটা জিনিসে অবশ্য তাদের মিল রয়েছে, সবাই বিদঘুটে দেখতে, দারুণ ভয় জাগানিয়া তাঁদের কণ্ঠ। সিরিজের দারুণ শব্দের কাজ প্রতিটি ভয়ের মুহূর্তকে করে তুলেছে জীবন্ত। এ ছাড়া বিশেষ করে প্রশংসা জানাতে হয় প্রতিটি দৃশ্যে মিষ্টি রঙের ছোঁয়া কিংবা তারই ঠিক পাশাপাশি একেবারে বিবর্ণ কিছু আতঙ্কের সহাবস্থানের ব্যাপারটাকে। সাদাকালো মাঙ্গার পাতা থেকে দৃশ্য ও চরিত্রগুলো রঙিন করার কাজটি স্টুডিওতে কর্মরত আঁকিয়েরা কী নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন, তা তোমরা দেখলেই বুঝবে।
প্রতিটি অ্যানিমের মতো এতেও শুরু এবং শেষে রয়েছে একটি করে গান। দুটি গানই গেয়েছেন সিরিজের শীর্ষ চরিত্র মিকোর কণ্ঠ দেওয়া শিল্পী সোরা আমামিয়া।
যেহেতু সিরিজটি এখনো বই আকারে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, তাই ধারণা করা যেতেই পারে, হয়তো এই ধারাবাহিকতা অ্যানিমের ক্ষেত্রেও অব্যাহত থাকবে। সেই লক্ষ্যেই সম্ভবত সিরিজটি একটু রহস্যময় আঙ্গিকে শেষ করা হয়েছে। সবকিছুর সমাধান হয়ে গেলেও রেখে গেছে কিছু চাঞ্চল্যকর ভবিষ্যতের আভাস। তবে ওসব নিয়ে তোমাদের এখন না ভাবলেও চলবে! তোমরা ভূতকে ভয় পাও বা পছন্দ করো, ভূত দেখে বিরক্ত হও কিংবা বিব্রত, কিলিয়ে ভূতের গুষ্টি উদ্ধার করতে চাও কিংবা পালানোর পথ খোঁজ—এই সিরিজ তোমাদের জন্য হতে পারে অন্যতম চমৎকার এক আবিষ্কার। সুতরাং দেখে ফেলো ঝটপট।