অদেখা এক মায়ের খোঁজে

আচ্ছা, তোমাদের প্রিয় গল্পকথার ধরন কোনটা? আমার কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার গল্প দারুণ লাগে। সেই আগ্রহেই খুঁজে পাওয়া ওয়ান পিস-এর মতো দারুণ অ্যানিমে। আবার জাদুমন্ত্রে গাঁথা ফ্যান্টাসি গল্পও বেশ ভালো লাগে। এমন গল্পের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণেই চোখে পড়েছিল ফেইরি টেল অ্যানিমে। অ্যাডভেঞ্চারও ফেইরি টেল–এ ছিল বৈকি! আর থাকবে না-ই বা কেন? এই সিরিজের মাঙ্গাকা হিরো মাশিমা যে এ ধরনের গল্প লিখতে সিদ্ধহস্ত, তা আগেই প্রমাণ করে ফেলেছিলেন তাঁর প্রথম প্রকাশিত ধারাবাহিক রেইভ-মাস্টার-এর পাতায় পাতায়। ফেইরি টেল দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি জিতে নিয়েছিলেন অগণিত ভক্তের মন। আমি অবশ্য ফেইরি টেল–এর নিয়মিত ভক্ত ছিলাম না কোনো কালেই; কিন্তু যত দূর দেখেছি, ভালোই লেগেছিল।

তোমরা হয়তো ভাবছ, বলছি ওয়ান পিস আর ফেইরি টেল-এর কথা, কিন্তু পোস্টার ভিন্ন অ্যানিমের কেন? তেমন বিশেষ কোনো কারণ নেই। মূলত অ্যাডভেঞ্চার গল্পধারাটি কীভাবে স্মৃতিকাতর করে তোলে, তা–ই বোঝানোর সামান্য চেষ্টা বলতে পারো। আর কারণ যদি কিছু খুঁজতেই চাও, তাহলে বলব, আজ যে সিরিজ সম্পর্কে তোমাদের জানাব, তা ‘ফেইরি টেল’ গল্পের লেখক হিরো মাশিমারই আরেকটি দারুণ সৃষ্টি।

শুরুতেই জানিয়ে রাখা ভালো যে ইডেনস জিরো সিরিজটি মূলত একটি স্পেস অ্যাডভেঞ্চার। অর্থাৎ মহাকাশ অভিযানের গল্প। এর আগে তোমাদের বলেছিলাম আস্ত্রা লস্ট ইন স্পেস অ্যানিমেটি নিয়ে। ওটাও মহাকাশযাত্রার গল্প ছিল, তবে ঘটনাক্রমের বিচারে ইডেনস জিরো একদমই ভিন্ন। মহাকাশের কথা শুনলেই মনে হতে পারে, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির প্রেমিক না হলে এ বস্তু হয়তো ভালো লাগবে না। অবশ্য, তোমাদের অন্তত এই অ্যানিমের ক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতা হবে না। বিজ্ঞানপ্রেমী না হলেও তোমরা নিছক অভিযানপ্রেম থেকেও উপভোগ করতে পারবে ইডেনস জিরো।

আমি লক্ষ করে দেখেছি, অনেক অ্যানিমেতেই প্রধান চরিত্রের মা-বাবার কোনো উপস্থিতি থাকে না। যদিও তারা বয়সে কিশোর, দেখা যায় যে তাদের মা-বাবা কিংবা অন্য কোনো অভিভাবকের সঙ্গে বসবাস করার প্রয়োজন পড়ে না। আবার অনেক সময় এমনও হয় যে মা-বাবা মৃত। কিংবা তারা আছে ভিনদেশে! কখনো আবার মা-বাবা থাকে, তবে তাদের উপস্থিতি কম। হয়তো পঁচিশ পর্ব পর মা একটু আওয়াজ দিল রান্নাঘর থেকে। কিংবা বাবা প্রথম দুই–তিন পর্বে দেখা দিয়ে আবার ফিরে এল আঠারো পর্ব তফাতে! এ ক্ষেত্রে ইডেনস জিরোর মূল চরিত্র শিকি একেবারেই ব্যতিক্রম নয়। তবে একটা বিশেষ আঙ্গিকে সে অন্যান্য চরিত্রের চেয়ে আলাদা। শিকি বেড়ে উঠেছে এক যন্ত্রমানব সমাজে। বহুকাল আগে তাকে মহাকাশ থেকে এখানে নিয়ে এসেছিল এক যন্ত্রমানব, যাকে ইতিহাস মনে রেখেছে ‘ডেমন কিং’ নামে। ভয়ানক পরাক্রমশালী সেই যন্ত্রমানব নিজের মহাকাশ অভিযানের মূল লক্ষ্য অপূর্ণ রেখেই শিকিকে নিয়ে ফিরেছিল গ্রানবেল রাজ্যের সেই পরিত্যক্ত শহরে, যেখানে মানুষের যাতায়াত থেমে গেছে বহুকাল আগেই। মানুষবিহীন অঞ্চলে শিকি বেড়ে উঠল যন্ত্রজাতির পরিচর্যায়। সে শিখল বন্ধুত্ব। পুরোটা সময় অবশ্য তার পিতৃতুল্য যন্ত্রমানব ডেমন কিং জিগি তার সঙ্গে রইল না। নিজের আদর্শ বজায় রাখতে জিগি যখন জীবন ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিল, তত দিনে সে তার সন্তানতুল্য শিকিকে শিখিয়ে দিয়েছে মানবিক মূল্যবোধ। আরও শিখিয়েছে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়। শিকি তার প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে নেয় মাধ্যাকর্ষণ বল বা গ্র্যাভিটি। পুরো মহাজগতেই এ ধরনের ক্ষমতার বিশেষ গুরুত্ব আছে। একে বলে ইথার গিয়ার।

আরও পড়ুন

শিকি স্বপ্ন দেখে, একদিন তার অনেক বন্ধু হবে। সে যাবে বিশ্বজগৎভ্রমণে। খুঁজে পাবে কিংবদন্তি এক মহাজাগতিক সত্তাকে, যাকে সবাই ‘মা’ বলে ডাকে। এই মা পূরণ করতে পারে অভিযাত্রীর যেকোনো ইচ্ছা। অসীম ক্ষমতা তার। কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি, মহাজগতের কোন কোনায় সে থাকে, তা–ও জানে না কেউ।

গ্রানবেল রাজ্যে দিনকাল সুখেই কাটছিল শিকির। একদিন সেখানে হাজির হলো নবীনা বি-কিউবার রেবেকা ব্লুগার্ডেন আর তার সঙ্গী হ্যাপি। বি-কিউব হলো, হালের ইউটিউবার বা টিকটকারদের মতো একপ্রকার ভিডিও নির্মাতা গোষ্ঠী। এদের তৈরি ভিডিও একধরনের ত্রিমাত্রিক কিউবের মধ্যে দেখা যায়। রেবেকার ইচ্ছা, গ্রানবেল রাজ্য নিয়ে একটা বি-কিউব ভিডিও সে সম্প্রচার করবে, যার ফলে বেড়ে যাবে তার জনপ্রিয়তা। শিকির সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল অচিরেই। জীবনে প্রথম মানুষের দেখা পেয়ে ছেলেটা আগ্রহী হয়ে উঠল বন্ধুত্ব পাতাতে। ওর সহজ-সরল স্বভাব, রেবেকা তাতে কিছুটা বিরক্ত তো হলোই, আবার আনন্দও পেল।

রেবেকা আসার সঙ্গে সঙ্গে হুট করে বদলে গেল কিছু ব্যাপার। গ্রানবেল রাজ্যের যন্ত্রমানবেরা হঠাৎ বেয়ারা হয়ে উঠল। বিদ্বেষ ও আক্রোশ, যা এত দিন তাদের ভেতর একেবারেই ছিল না, কোত্থেকে যেন আঁকড়ে ধরল তাদের। ফলে রেবেকা আর হ্যাপি পরদিন সকালে নিজেদের আবিষ্কার করল হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। একটু পরই আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে তাদের। পরিস্থিতি দেখে বাদ সাধল শিকি। কিন্তু, ওর পুরোনো বন্ধুরা সহসা যেন অচেনা হয়ে গেছে। শিকিকেও আঘাত করে বসল যন্ত্রের দল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে বাঁচতে হলে পালাতে হবে রাজ্য থেকে। নিজের শক্তি কাজে লাগিয়ে শিকি সে চেষ্টাই করল। রেবেকা আর হ্যাপিকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছাল রেবেকার মহাকাশযানের কাছে। তারপর ওতে চড়েই ছুটে চলল অন্য গ্রহের পথে।

ইডেনস জিরোর গল্পের শুরুটা এমনই। তবে ওপরে যা বললাম, তাতে প্রায় কিছুই বলা হলো না। সিরিজটা অতি সম্প্রতি দেখতে বসেছিলাম, তারপর দুই বসায় দেখে শেষ করেছি। ঘটনাক্রম এতটাই চমৎকার যে উঠতে পারিনি খুব বেশিবার। পেঁয়াজের খোসার মতো পরতে পরতে বেরিয়ে আসে কাহিনির নতুন আঙ্গিক। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। যেভাবে ভাবিইনি, তেমন কিছুই হঠাৎ করে চলে এসেছে প্রেক্ষাপটে। সত্যি বলতে, এত দিন বসে এত এত অ্যানিমে দেখে ফেলার পর এমন গল্প পেলে বেশ সতেজ লাগে। ওহ, আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো, হ্যাপি নামের একই রকম দেখতে একটি চরিত্র কিন্তু লেখকের এর আগের গল্প ‘ফেইরি টেল’–এ রয়েছে, রেবেকার মতো দেখতেও একটি চরিত্র রয়েছে ওতে, তবে ভিন্ন নামে। এ ছাড়া তোমরা ‘ফেইরি টেল’-এর প্রধান চরিত্র নাতসুকে এক-দুই সেকেন্ডের জন্য দেখতে পাবে ইডেনস জিরোতে, তবে তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই। এ ধরনের উপস্থিতিকে ইংরেজিতে বলে ক্যামিও (Cameo)। তোমরা যারা মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের চলচ্চিত্রগুলো দেখে অভ্যস্ত, তারা নিশ্চয়ই সিনেমা জগতের এই চর্চা সম্পর্কে জানো। ওখানকার প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই কমিকস আর্টিস স্ট্যান লি ক্যামিও হিসেবে এসেছেন।

আরও পড়ুন

ফিরে আসছি মূল কথায়। ইডেনস জিরো দেখে আমার মনে হয়েছে, এই গল্পে মাঙ্গাকা হিরো মাশিমা চেষ্টা করেছেন নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানানোর। একেবারে ফ্যান্টাসি–নির্ভর ধারা থেকে বেরিয়ে একটু সায়েন্স ফ্যান্টাসি ধাঁচের কিছু করার জন্য কাজ করেছেন তিনি। নিজের সবটুকু যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন আনকোরা এক জগতের রূপরেখা যাতে কল্পনা ও বিজ্ঞান হাতে হাত–ধরাধরি করে চলতে পারে। লেখক হিসেবে এ কাজ করা যে কত কঠিন, তা যাঁরা না করেছেন, তাঁরা জানেন না। অনেক সময় দেখা যায়, লেখকদের একধরনের সীমাবদ্ধতা চলে আসে, তাঁরা নিজেদের স্বচ্ছন্দের পরিবেশ বা গল্পধারা থেকে বেরিয়ে অন্যত্র যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখান না। হিরো মাশিমার এই চেষ্টাকে তাই তোমাদের ভালো লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস। আর তোমরা যদি তাঁর কোনো কাজ আগে না দেখে বা পড়ে থাকো, তাহলে এই অ্যানিমের মাধ্যমেই আবিষ্কার করে ফেলবে চমৎকার এক গল্পকারকে।

চরিত্রায়ণের দিক থেকেও পিছিয়ে নেই অ্যানিমেটি। প্রথমেই বলতে হয় শিকির কথা। একেবারে সোজা পথের মানুষ সে। যা সঠিক বলে মনে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে তা–ই করতে। মানুষের বন্ধু হতে চায় সে, তবে যদি কোনো মানুষ কোনো যন্ত্রের ক্ষতি করে, তাহলেও সে রুখে দাঁড়াবে, প্রয়োজনে লড়বে যন্ত্রদের পক্ষ হয়ে। এ ছাড়া মূল চরিত্রের একজন অবশ্যই রেবেকা। নিজেকে প্রমাণ করার অদ্ভুত এক তাগিদ তার মধ্যে আছে, কিন্তু সে জন্য বাঁকা পথ ধরতে সে রাজি নয়; বরং পরিশ্রম করেই জিতে নিতে চায় পুরস্কার। আর হয়তো সে জন্যই বি-কিউবার দুনিয়ায় সে একেবারেই জনপ্রিয় নয়। এখানে তার ঠিক বিপরীত হিসেবে আরেক বি-কিউবারকে দেখানো হয়েছে। মেয়েটির নাম লাবিলিয়া ক্রিস্টি। খ্যাতির জন্য যতটা নিচে নামা সম্ভব, এই মেয়ে তা নামতে পারে। প্রয়োজনে অপদস্থ করতে পারে সতীর্থদেরও। যদিও এই ধারাবাহিকে লাবিলিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসির জোগান দিতেও দেখা যায়। আছে জিগি, যে প্রথম পর্বে মারা গেলেও গল্পের তাগিদেই একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না কখনোই। তার মতো দূরদর্শী চরিত্র বোধ হয় এই গল্পে খুব কমই আছে। হ্যাপিও বেশ ভালো সহযোগী। ওয়াইজ স্টেইনার কখনো কখনো বড় সহায়ক, কখনো–বা ভীতু। আছে পিনো, সিস্টার, উইচ, হেরমিট, এলসি; যারা যন্ত্রমানব হলেও তাদের ভেতর আছে আবেগ আর মানবিকতা। এদের প্রত্যেকের শিকির সঙ্গে এসে জুড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা। এসব ঘটনা কখনো দুঃখ দেয়, কখনো–বা ভাবায়। আরও অসংখ্য চরিত্র আছে, যারা তোমাদের সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন সময়ে। দেখিয়ে দেবে সাম্প্রতিক পৃথিবীর নানান চিত্র যা চিরায়তকাল ধরে একইভাবে চলতে পারে মহাজগতের যেকোনো প্রতিষ্ঠিত সমাজে।

আরও পড়ুন

হিরো মাশিমা ‘ইডেনস জিরো’ গল্পটি শুরু করেছিলেন ২০১৮ সালে, আর লেখা শেষ করেছেন ২০২৪ সালে। মোট ২৯৩ অধ্যায়ের গল্পকথা ৩৩টি ভলিউমে প্রকাশ করেছে জাপানের বিখ্যাত প্রকাশনী কোদানশা। এযাবৎকালে দুটি অ্যানিমে সিজনে ২৫টি করে মোট ৫০টি পর্বে রূপান্তরিত হয়েছে দর্শকের জন্য। পুরো কাহিনি এখনো অ্যানিমে মাধ্যমে বলা বাকি, তবে তোমরা শুরুটা অবশ্যই করতে পারবে। জনপ্রিয় অনলাইন সার্ভিস নেটফ্লিক্সে প্রথম সিজনটি তোমরা পেয়ে যাবে অনায়াসেই। তবে দ্বিতীয় সিজনের জন্য খুঁজতে হবে ক্রাঞ্চিরোল স্ট্রিমিং সার্ভিস। এবার দেখার বিষয় হলো, তৃতীয় সিজন কোথায় মুক্তি পায়!

শেষে বলব, ওপরে যা যা বললাম, তা পড়ে সামান্যতম আগ্রহ জেগে থাকলে সিরিজটা একবার পরখ করে দেখো। অনেক জনপ্রিয় সিরিজের ভিড়ে এসব ভালো গল্প হারিয়ে যায়। তোমরা ইন্টারনেট খুললেই দেখবে ‘স্পাই এক্স ফ্যামিলি’, ‘নারুতো’, ‘জিজুৎসু কাইসেন’ ইত্যাদি অ্যানিমের জয়জয়কার, কিন্তু আরও অগণিত চমৎকার সব অ্যানিমে চুপচাপ বসে আছে তোমাদের জন্য। যেসব নিয়ে অত কথা হয় না, অত উল্লাস-হইচই হয় না। আমি নিয়মিত চেষ্টা করি সেসবের কয়েকটা হলেও অন্তত তোমাদের জন্য আবিষ্কার করতে। তা থেকে তোমরা যদি সামান্যতম আনন্দও পাও, তবেই আমার কাজ সার্থক। আরও একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি, অনেকটা ইচ্ছা করেই গল্পের মূল আকর্ষণীয় ঘটনাক্রমগুলো সম্পর্কে তোমাদের প্রায় কিছুই বলিনি। কারণ, যে আবিষ্কারের মজা আমি পেয়েছি, তোমরাও যেন তা থেকে বঞ্চিত না হও। দেখা যাক, তোমাদের ঠিক কতটা ভালো লাগে মহাজাগতিক মায়ের খোঁজে শিকির এই মহাকাশ অভিযান।

আরও পড়ুন