‘রাবিশ’! জর্জ হ্যারিসনের কণ্ঠে বিরক্তি নাকি হতাশা, তা ঠিক বোঝা গেল না। অনেকক্ষণ ধরেই জন লেননের একটি গান সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। কিন্তু হচ্ছে না। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আছেন পল ম্যাককার্টনি ও রিঙ্গো স্টার। যাঁর গান নিয়ে এত চেষ্টা, সেই লেনন অবশ্য তত দিনে প্রয়াত। লেননের স্ত্রী ইওকো ওনো ক্যাসেটে করে কয়েকটি অপ্রকাশিত, অসম্পূর্ণ ট্র্যাক দিয়ে গেছেন। তিন বন্ধু সেগুলো থেকে দুটো গান সম্পূর্ণ করতে পেরেছেন। বিপত্তি হলো ‘নাউ অ্যান্ড দেন’কে নিয়ে। ১৯৭৮ সালে গানটি লেখার পর ঘরে বসেই ডেমো সংস্করণ নির্মাণ করেছিলেন লেনন। বাজিয়েছিলেন পিয়ানোয়।
১৯৯৫ সালে এসে হ্যারিসনরা দেখলেন, পিয়ানোর সাউন্ড থেকে ভোকাল অংশটুকু আলাদা করতে পারছেন না। তা ছাড়া, ডেমো সংস্করণটির মানও তেমন ভালো নয়। হ্যারিসনের মতে, এই ট্র্যাক নিয়ে এগোনো আর সম্ভব নয়। ম্যাককার্টনি অবশ্য একমত নন। একমত হবেনই বা কী করে! হয়তো তাঁর মনে পড়ছিল ফেলে আসা সেই সব ঘোর লাগা দিনের কথা।
গল্পের শুরুটা শৈশবে। লেনন তখন স্কুলে পড়েন। হ্যারিসন তাঁর বন্ধু। দুজন মিলে ব্যান্ড গঠন করলেন। নাম রাখলেন ‘দ্য কোয়ারি ম্যান’। একপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন ম্যাককার্টনি আর রিঙ্গো। ব্যান্ডের নাম তত দিনে ‘দ্য বিটলস’। লিভারপুলের নানা প্রান্তে নামডাকও ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। সেখান থেকে অন্যান্য শহরে। এরপর পুরো ব্রিটেন। তারপর একটা–দুটো দেশ করে গোটা ইউরোপ। অতঃপর দেখা গেল, সমগ্র বিশ্বই বুঁদ হয়ে আছে বিটলসের উন্মাদনায়।
১৯৬৪ সালে ঘটল অভূতপূর্ব ঘটনা। আমেরিকায় গিয়ে টিভি শো করল ব্যান্ডটি। সেটি কজন দেখল জানো? ৭৪ মিলিয়ন শ্রোতা! তবু বাতাসে যবনিকার সুর। শোনা যাক লেখক শেখ রানার বয়ানে, ‘কোথায় যেন আবার সেই দলছুট হওয়ার টংকার বাজতে থাকে অন্তরে, অন্তর্গহিনে। ভাঙনের ঢেউ এসে লাগে উজানে।’ লেখা হয় বিটলসের এপিটাফ। সময়টা ১৯৭০।
পরের বছর কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের। অদ্ভুতভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে বিটলসও। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। বব ডিলান, লিওন রাসেল, আল্লা রাখা প্রমুখের পাশাপাশি লাইনআপে আরও ছিলেন রিঙ্গো স্টার ও জন লেনন।
বোধ হয় বিটলসদের সম্ভাব্য রি-ইউনিয়নের খাতিরে শেষ হয়ে যায় ৪০ হাজার টিকিট। অথচ ততক্ষণে পেরিয়েছে মাত্র ছয় ঘণ্টা! জন লেনন অবশ্য শেষ অবধি অংশ নিতে পারেননি।
চিত্রনাট্যের এরপরের অংশ এ বছরের ৩ নভেম্বর। জন লেননের সেই আধখানা গান শেষমেশ মুক্তি পেল। কাজ সমাপ্ত হয়েছিল গত বছর। কারিগরের ভূমিকায় ম্যাককার্টনি, রিঙ্গো ও মার্টিন। হ্যারিসন নেই। প্রয়াতের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন তিনিও। তবে গানটিতে ১৯৯৫ সালে রেকর্ড করা তাঁর রিদম গিটারের অংশটুকু ঠিকই আছে।
‘নাউ অ্যান্ড দেন’ সম্পূর্ণ করতে এআইয়েরও ভূমিকা রয়েছে। নির্মাতা পিটার জ্যাকসনের কোম্পানি তৈরি করেছে একটি বিশেষ সফটওয়্যার। লেননের গিটারের সাউন্ড কেমন ছিল, শেখানো হয়েছে এটিকে। দেওয়া হয়েছে আরও কিছু উপাত্ত। এর মাধ্যমে মিলেছে ২৮ বছর আগের সমস্যার সমাধান। পরিষ্কারভাবে শোনা গেছে লেননের কণ্ঠ।
ম্যাককার্টনি তাই আপ্লুত। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে আমরা সবাই আবার একসঙ্গে। পুরোনো দিনগুলো যেন ফিরে এসেছে আবার।’ আর এভাবেই বিটলসের বিউগল বেজে উঠল শেষবারের মতো।