‘দানবের সময় ভার্সিটিতে পড়তাম। ঘুরে বেড়াতাম শহরজুড়ে। একদম আপনাদের ভবঘুরে গানটার মতো। এর মধ্যে কেটে গেল দেড় যুগ। আমি তিনবার চাকরি বদলালাম। বাবা হলাম। শুরু করলাম ব্যবসাও। আর আপনারা একটা অ্যালবাম দিতে পারছেন না? বাবা হয়েছি ভালো কথা, অন্তত দাদু হওয়ার আগে একটা অ্যালবাম দিন!’
শ্রোতাদের এমন অনুযোগ, অভিযোগ ও অভিমানে ব্যান্ড ক্রিপটিক ফেইটের সদস্যরা ১৮ বছর ধরে বিপর্যস্ত। সর্বশেষ অ্যালবাম ‘দানব’ বেরিয়েছিল ২০০৬ সালে। মাঝখানে এসেছে কেবল কয়েকটা সিঙ্গেল আর নতুন অ্যালবামের আশ্বাস। অথচ ব্যান্ডটির যাত্রা শুরু সেই ১৯৯৩-এ। পরের দশকে অন্য দুই প্রখ্যাত ব্যান্ড আর্টসেল, ব্ল্যাকের সঙ্গে ক্রিপটিক ফেইটকে জুড়ে দিয়ে ডাকা হতো ‘এবিসি জেনারেশন’। এতটা শ্রোতাপ্রিয়তা পাওয়া সত্ত্বেও অ্যালবামের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন। ২০১৩ সালে চতুর্থ অ্যালবামের তোড়জোড় শুরু হলেও শেষমেশ প্রকাশ পেল এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বিলম্বের কারণ জানাতে গিয়ে ভোকালিস্ট ও বেজিস্ট শাকিব চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সবাই চাকরিজীবী; শখের বশে গান করি। তাই এতগুলো বছর লেগে গেল আরকি।’ ১১ বছর সময় নিলেও এর একটা ভালো দিক দেখছেন তিনি, ‘তখন শেষ করতে না পেরে ভালোই হয়েছে, তখনকার প্রযুক্তির চেয়ে এখনকার প্রযুক্তি আরও উন্নত। অ্যালবামটা ভালো হয়েছে।’
‘দানব’ যখন মুক্তি পেয়েছিল, তখনকার শ্রোতারা এখন বড় হয়ে গেছেন। আবার ‘নয় মাস’ অ্যালবাম দিয়ে অনেক নতুন শ্রোতার কাছে পৌঁছে গেছে ক্রিপটিক ফেইট। দুই শ্রেণির কাছ থেকেই দারুণ সাড়া পাচ্ছে হেভি মেটাল ব্যান্ডটি। শাকিব চৌধুরী কিশোর আলোকে জানান, ‘পুরোনো শ্রোতারা বলছে দে আর ব্যাক। আর নতুন শ্রোতারা বলছে এখন বুঝলাম কেন ওরা ক্রিপটিক ফেইট।’
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ‘নয় মাস’ শিরোনামের এই কনসেপ্ট অ্যালবামটিতে গান আছে ৯টি। ক্রিপটিক ফেইটের মতে, প্রতিটি গানের অভিব্যক্তি ও বক্তব্য আলাদা। ৯টি গানে তারা একধরনের ধারাবাহিকতা রাখার চেষ্টা করেছে। ২৫ মার্চের কালরাত, যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিভ্রান্তি, সংশয় কাটিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, আক্রমণ চালানোর মতো সংগ্রামের নানান দিক উঠে এসেছে গানগুলোয়। তবে জর্জ হ্যারিসনের মতো বন্ধুদের সহযোগিতা, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট নিয়ে গান থাকায় ‘নয় মাস’ হয়ে উঠেছে অনন্য।
শাকিব চৌধুরীর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তাঁর মামা, চাচারাও। পারিবারিক আড্ডাগুলোয় সংগ্রামের গল্প শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টিভি অনুষ্ঠান করার। পরিকল্পনা ছিল সেই আয়োজন চলবে টানা ৯ মাস ধরে। কিন্তু এই বিশাল পরিসরের কাজ তাঁর চাকরির ব্যস্ততায় অনেকটা অসম্ভব ছিল। তাই স্বপ্নপূরণের জন্য গানকেই বেছে নিলেন শাকিব। প্রস্তাব জানানোমাত্রই সায় দিলেন ব্যান্ডের বাকিরা। ‘বাকিরা’ বলতে গিটারিস্ট সরফরাজ, ফারহান সামাদ ও ড্রামার রাফা। রাফা অবশ্য গত অক্টোবরে ব্যান্ড থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর জায়গায় দায়িত্ব নিয়েছেন জেফরি অভিজিৎ ঘোষ।
অ্যালবামের প্রথম গান ‘ভোরের অপেক্ষা’র প্রথম দিকে শোনা যায় ৭ মার্চের ভাষণের অংশবিশেষ। সেই সময় বাজতে থাকা গিটারের রিফের মাত্রা ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকে। তৈরি করে পরাধীনতার আঁধার কাটিয়ে নতুন দিনের প্রতীক্ষার আবহ। পরের গান ‘কালবৈশাখী’তে সেই তীব্রতার দেখা মেলে প্রথম থেকেই। এ প্রসঙ্গে ক্রিপটিক ফেইটের ভাষ্য, ‘যখন ঝড়ে বাসা উড়ে যায়, তখন লুকাবে কোথায়? তখন সময় আসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আমি কি যুদ্ধের ঝড়ে উড়ে যাব, নাকি ঝড় হয়ে উড়িয়ে দেব হানাদার বাহিনীকে?’
অ্যালবামের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বেজবাবা সুমনের উপস্থিতি। ‘বিদায়ের গান’-এ শাকিবের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন তিনিও। অন্য গানগুলোর তুলনায় এই তৃতীয় ট্র্যাকটি একটু ব্যতিক্রম। এখানকার প্রেক্ষাপট ছেলেরা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে ফেরার সম্ভাবনাও অনিশ্চিত। ক্রিপটিক ফেইট এই প্রসঙ্গে দুই ধরনের সন্তানের গল্প শোনায়—শান্তশিষ্ট আর ডানপিটে। ডানপিটে ছেলের কথা চিন্তা করতে গিয়ে শাকিবের ভাবনায় আসে অদ্ভুত সেই ছেলেটির কথা। এই শিরোনামে বেজবাবা সুমনের গান বেশ জনপ্রিয়। বাকিটা শোনা যাক শাকিবের বয়ানেই, ‘সুমন ভাইকে বললাম, এই গানের সঙ্গে অদ্ভুত সেই ছেলেটির ব্যাপারটা যায়। আপনি গানটা গাইলে গর্ব বোধ করব। সুমন ভাই গেয়েছেন। আমরা খুবই খুশি। গানটা খুব ভালো হয়েছে।’
‘৯ মাস’ নিয়ে ভালো সাড়া পাচ্ছে ক্রিপটিক ফেইট। প্রকাশের আগে অবশ্য একধরনের শঙ্কায় ভুগছিলেন তাঁরা। তাঁদের মতে, বর্তমানে চারদিকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেউ কেউ ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। এমন সময়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই অ্যালবাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে কি না, দ্বিধা ছিল তা নিয়েই। কিন্তু সে রকমটা না ঘটায় তাঁদের কণ্ঠে এখন বাজছে স্বস্তির গান। ২০২৫-এর মধ্যে নতুন অ্যালবাম নিয়ে আসার প্রত্যাশা তাঁদের মধ্যে। গান করা নিয়ে ব্যান্ডটির দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার, ‘আমরা সংগীতপ্রেমীদের জন্য কী রেখে গেলাম, আদৌ কিছু রেখে গেলাম কি না, এসব নিয়ে কখনোই ভাবিনি। আর আমরা এটা মনে করি, এসব ভেবে আর যাহোক, মিউজিক হয় না।’
বোধ হয় এমন দর্শন ও সততার কারণেই অনুরাগীদের মধ্যে ক্রিপটিক ফেইটের এত খ্যাতি।