রহস্য ও রোমাঞ্চ। ছোট্ট দুটো শব্দ, অথচ কী অমোঘ তার আমন্ত্রণ! উপেক্ষা করা ভয়ানক কঠিন। অন্তত আমার মতো যারা রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পের ভক্ত রয়েছ, তারা নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকো নতুন কোনো চমৎকার গল্পের, যা তোমাদের মগজকে একটু খেলিয়ে নেবে। রহস্য গল্পের চমৎকার কারিগর স্যার আর্থার কোনান ডয়েল আর রহস্যের রানি আগাথা ক্রিস্টি তাঁদের কলমে নির্মাণ করেছিলেন শার্লক হোমস আর এরকুল পোয়ারোর মতো দারুণ সব চরিত্র, যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায়ও তৈরি হয়েছে কতশত রহস্য কাহিনি। ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী এমনকি হালের একেনবাবু পর্যন্ত। আমাদের দেশে অবশ্য রহস্যের চেয়ে রোমাঞ্চ ধারা নিয়ে আজকাল বেশি আয়োজন চলছে, তোমরা যা ‘থ্রিলার’ শিরোনামে হাতে পাচ্ছ।
এ তো গেল আমাদের রহস্যের কথা। খোঁজ নিলে জানতে পারবে যে রহস্য নির্মাণে জাপানিরাও মোটেই পিছিয়ে নেই। মাঙ্গা তথা অ্যানিমে জগতে অন্যতম সুদীর্ঘ গল্প ‘ডিটেকটিভ কোনান’ তো রয়েছেই, আছে টুকিটাকি আরও অনেক রহস্য গল্প। আমি গোয়েন্দা অ্যানিমে দেখা শুরু করেছিলাম ‘ডিটেকটিভ স্কুল কিউ’ দিয়ে। সেখানে চৌকস এক ছেলে বুদ্ধি খাটিয়ে অন্য বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে ভেদ করে জটিল সব রহস্য। আবার রহস্য কথায় অতিপ্রাকৃত ধাঁচের ছোঁয়া পাওয়া যায় অ্যানিমে ‘মাজিন তানতেই নউগামি নিউরো’-তে। প্রসঙ্গত, জাপানি ভাষায় ‘তানতেই’ শব্দটির অর্থ ‘গোয়েন্দা’।
এখানে যে কটি অ্যানিমের নাম উল্লেখ করলাম, তার প্রতিটিই চমৎকার। সুযোগ পেলে দেখতে পারো। তবে আজ এগুলোর কোনোটা নিয়েই বলব না। আজ বলব ‘রন কামোনোহাশিস ফরবিডেন ডিডাকশন’ অ্যানিমেটি নিয়ে।
অ্যানিমের নাম একেবারে প্রধান চরিত্রের নামে। রন কামোনোহাশি এমনই এক গোয়েন্দা, যার গোয়েন্দাগিরির ওপর আছে নিষেধাজ্ঞা! কিন্তু কেন? কী এমন হয়েছিল তার অতীতে, যার জন্য দুর্দান্ত প্রতিভাবান গোয়েন্দা হওয়ার পরও তাকে বরণ করতে হয়েছিল এমন ভাগ্য? আর বর্তমানে সে করছেই বা কী? এসব প্রশ্নের অনেকগুলোই অ্যানিমেটিতে ক্রমেই প্রকাশ্য। পেঁয়াজের খোসার মতো একটি একটি পরত খুলে বেরিয়ে আসে রনের হারানো ইতিহাস। সেখানে আছে সমাধানহীন কিছু রহস্য, যা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই খোদ গোয়েন্দার।
লেখিকা আকিরা আমানো তাঁর মেধা খাটিয়ে তৈরি করেছেন এমনই এক মেঘে ঢাকা চরিত্র। একজন তুখোড় গোয়েন্দার গুণাবলি রনের আছে, কিন্তু সে আবার অনেকাংশেই আলাদা। রহস্য ভালোবাসলেও সে ভয়ানক অলস। নিজের ঘরের পুরো মেঝেতেই তার বিছানা পাতা। সারা দিন শুয়ে থেকে সে কাটিয়ে দিতে পারে মাসের পর মাস। তবে রহস্যের কথা একবার কানে পৌঁছালে তাকে থামানো অসম্ভব। নাম ভাঁড়িয়ে অহেতুক ছদ্মবেশ গ্রহণ করা তার অভ্যাস। তবে প্রতিটি ছদ্মবেশের পেছনেই আছে কিছু কারণ। আর যে বিশেষত্ব রন কামোনোহাশিকে সবার থেকে আলাদা করে, তা হচ্ছে রহস্য সমাধান করে ফেলার পর তার প্রতিক্রিয়া। আসামিকে ধরে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সে হুকুম দেয় তাদের আত্মহত্যা করতে। তারাও কোনো অদ্ভুত কারণে সম্মোহিতের মতো সেই আদেশ পালন করতে তৎপর হয়! আর, বিপদটা সেখানেই।
রন কামোনোহাশির কাহিনি অবশ্য শুরু হয় ভিন্ন একটি চরিত্রের হাত ধরে। পুলিশ গোয়েন্দা তোতোমারু ইশকি ভীষণ দুশ্চিন্তায়; শহরের এক ধারাবাহিক খুনি পাঁচটি খুন করে ধরাছোঁয়ার বাইরে, অথচ তদন্ত থেকে তোতোমারুকে জোর করে দেওয়া হয়েছে বিশ্রাম। কারণ, তার বিভাগের প্রধান তার ওপর একেবারেই আস্থাশীল নয়। ফলে সবাই ঘটনাস্থলে ছুটলেও সে পড়ে আছে অফিসে। তোতোমারুর হতাশা দেখে তাকে অফিসের এক সিনিয়র সহকর্মী সন্ধান দেয় রন কামোনোহাশির। একপ্রকার নিজের চাকরি বাঁচাতেই তার পরামর্শ নিতে ছোটে তোতোমারু। যদি দক্ষ গোয়েন্দার পরামর্শে ধারাবাহিক খুনের রহস্যটা সমাধান করতে পারে, তবেই কেল্লা ফতে।
ঠিকানায় পৌঁছে আশাভঙ্গ হয় তোতোমারু। কারণ, তাকে সাহায্য করতে রাজি হয় না রন। সে নিজে তো ভয়ানক অলস বটেই, তার পোষা বিড়ালটা পর্যন্ত অলস। মানুষটার ঘরে কোনো আসবাব নেই বললেই চলে। একটু কথা বলতেই জানা যায়, তোতোমারুর সেই সিনিয়র সহকর্মী রনের পূর্বপরিচিত এবং এর আগেও তার কাছে লোক পাঠিয়েছে তাকে তদন্তের দুনিয়ায় টেনে আনতে। স্বভাবতই সাফল্য আসেনি। এমনকি রন শুনতেই চায় না রহস্য সম্পর্কে, কারণ শুনলেই রহস্য তাড়া না করে সে পারবে না।
হতাশ হয়ে ফিরেই যাচ্ছিল তোতোমারু, কিন্তু তার সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ জানিয়ে রন তার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে তোতোমারুর জোরাজুরিতে খুনের বিষয়টি জেনে ফেলে গোয়েন্দা, আর শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হয় সূত্র উদ্ধারে। রহস্য সমাধানের পরই রন নিশ্চিত হয় যে তোতোমারুর মতো একজনের অপেক্ষায়ই সে ছিল এত দিন। যে নিয়মিত রহস্যের জোগান দিতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সামলেও রাখতে পারবে। ফলে আরও রহস্যের খোঁজে তোতোমারুকে নিয়মিত জ্বালাতন করতে থাকে সে।
অ্যানিমেতে তোতোমারু আর রনের পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতার জায়গাটুকুই সবচেয়ে বিশেষ। তোতোমারু যেমন রনকে নিয়মিত নিয়ে যায় রহস্যের কাছে, রনও তেমনি নিজে রহস্যের অন্তিম বয়ান না দিয়ে তার কৃতিত্ব দিয়ে দেয় তোতোমারুকে। ফলে তাকে নিষিদ্ধ করা সংস্থাটি তার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে এসে হিমশিম খায়। এভাবেই আরও জড়ো হয় গল্পের বাকি চরিত্রেরা। এরা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে বিশেষ। তোতোমারুর বিভাগীয় প্রধান ‘আমামিয়া’ ভীষণ রগচটা, কিন্তু কাজে একনিষ্ঠ। গোয়েন্দা সংস্থার বিখ্যাত গোয়েন্দা ‘কাওয়াসেমি’ তুখোড়, কিন্তু বড্ড খুঁতখুঁতে। আছে দক্ষ অথচ তরল চরিত্রের অনুসন্ধানী ‘স্প্রিটজ’। আবার গল্পের চরিত্র ‘মোফু’ একজন নিউরোসার্জন, যে সীমিত সময়ের জন্য এলেও বোঝা যায় যে পরবর্তী সময়ে গল্পের ধাপে ধাপে তার আবার আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
যেকোনো রহস্য ধারাবাহিকের মতোই এই গল্পের চরিত্র অনেক। এদের মধ্যে অধিকাংশই এক পর্বের জন্য এসে হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার রয়ে গেছে গুরুত্বের কারণে। এরা মাঝেমধ্যে ফিরে এসেছে। মূল প্রেক্ষাপট কামোনোহাশিকে ঘিরে থাকলেও স্প্রিটজের ভূমিকা কাজে লেগেছে। আবার আমামিয়ার উপস্থিতি বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে একটি–দুটি ঘটনায়। মোফুর ছোট্ট উপস্থিতি কিছু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এ ছাড়া কয়েকটি অন্ধকার চরিত্র ক্ষণিকের জন্য এসে এমন টুকিটাকি আভাস দিয়ে গেছে, যার কারণে দ্বিতীয় সিজনের জন্য আগ্রহ তুঙ্গে চলে যায়।
গোয়েন্দা গল্প তো অনেকই হয়, তোমরা প্রশ্ন করতেই পারো, রন কামোনোহাশিতে এমন বিশেষ কী রয়েছে, যা অন্যান্য গোয়েন্দা গল্পে সচরাচর দেখা যায় না? এর উত্তরে বলতে পারি যে এই গল্পে খোদ গোয়েন্দাই একাধিকবার সন্দেহভাজনদের দলে নাম লিখিয়ে ফেলেছে। এমনকি তাকে হাতকড়া পরিয়ে বন্দীও করে রাখা হয় সন্দেহের বশে! ফলে কেউই যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, তা একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যাঁ, আঁতিপাঁতি করে খুঁজলে হয়তো তোমরা এমন দু–একটি গোয়েন্দা সিরিজ পেতে পারো, যাতে খোদ গোয়েন্দা আসামি হয়ে যায়, কিন্তু তার সংখ্যা অগণিত নয়। এ ছাড়া বাড়তি বিশেষত্ব হিসেবে অবশ্যই রয়েছে রনের অতীত ও তার বিরোধী বাহিনীর কর্মকাণ্ড।
গল্পের বৃত্তান্ত তো অনেক হলো, এবার লেখককে নিয়ে বলা যাক! আকিরা আমানো ২০০২ সালে নবীন মাঙ্গাকা হিসেবে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হন। ফলে তাঁর নির্বাচিত গল্পটি ছেপে বেরোয় এক কিশোর পত্রিকায়। সেখানেই শুরু। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় তাঁর আরেকটি সিরিজ কাতেকেও হিটম্যান রিবর্ন দিয়ে। এই গল্প ২০০৪ সাল নাগাদ প্রকাশের মুখ দেখে এবং ধারাবাহিক সাপ্তাহিক শোনেন জাম্প পত্রিকায় ছাপা হয় ২০১২ সাল পর্যন্ত। এই গল্পে বিখ্যাত এক মাফিয়া দলের ভবিষ্যৎ দলপতি নির্বাচিত হয় এক সাধারণ কিশোর। আর তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের মাফিয়া বাহিনী। তাদের অন্য বাহিনীর সঙ্গে লড়াইকে ঘিরে ওই ধারাবাহিকের কাহিনি আবর্তিত হয়। সিরিজটি শুরু করে যে কেউ পিছিয়ে যাবে, তার কারণ প্রথম প্রায় ২০টি পর্বে বিশেষ কিছুই ঘটে না, কিন্তু ২৫-২৬টি পর্ব পেরিয়ে গেলে যে দুর্দান্ত কাহিনি শুরু হয়, তা টেনে নিয়ে চলে ১৫০-২০০ পর্বের একেবারে সমাপ্তি পর্যন্ত। আমি যখন দেখছিলাম, তখন সিরিজটির অ্যানিমে শেষ হয়েছে, কিন্তু কাহিনি ফুরায়নি। ফলে পড়তে হয়েছিল মাঙ্গা। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, অমন সুন্দর করে কাহিনি শেষ করার জন্য লেখক একটা বাহবা পেতেই পারেন। আজ রন কামোনোহাশি সিরিজটি নিয়ে লিখছি বটে, কিন্তু তোমরা যারা আরও চমৎকার কাহিনির স্বাদ পেতে চাও, তারা অবশ্যই হিটম্যান রিবর্ন মাঙ্গাটা পড়ে দেখতে পারো।
লেখিকার পূর্ববর্তী গল্প নিয়ে এত কিছু বলার কারণ একটাই, রন কামোনোহাশির শুরুটা আমার হিটম্যান সিরিজ থেকে ভালো লেগেছে। ফলে এটুকু আস্থা রাখতে দ্বিধা নেই যে পরবর্তীতে গল্প আরও ঘোড়েল আর গতিশীল হবে। অন্তত প্রথম সিজনে যেসব সূত্র হাতে পাওয়া গেছে, তাতে এ বিশ্বাস হওয়া যথেষ্টই স্বাভাবিক।
অনেক ভালো ভালো কথা বললাম, এবার একটু কঠোর হওয়া প্রয়োজন, নাহলে তোমরা বলবে, কেবল প্রশংসাই করে গেলাম! সিরিজটি যে দারুণ, তাতে সন্দেহ নেই, তবে এর রহস্যের জটিলতায় কিছু কমতি আছে। কোনো কোনো রহস্যের সমাধান হয়েছে এক পর্বে, কোনোটা দুই বা তিন পর্বে। তবে সব কটা গল্প মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিশেষ নয়। দু-একটি তোমাদের একেবারে সাধারণ মনে হবে গুরুত্বের বিচারে। একেবারে মূল রহস্যটি অবশ্য ভালো। যা হচ্ছে, গোয়েন্দার অতীত ও একটি আবছায়া সংস্থার তাকে ঘিরে আগ্রহ বা সতর্কতার জায়গাটি। এ ছাড়া আরও একটি-দুটি গল্প দারুণ লাগতে বাধ্য, কিন্তু বাকিগুলো মোটামুটি। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তোমাদের মনে রাখতে হবে যে সিরিজটির মূল সক্ষমতার জায়গা হচ্ছে চরিত্রগুলো। মূলত এদের পেছনে তুমি যদি সময় দাও, তাহলে এরাও তোমাকে হতাশ করবে না। কিছু কিছু চরিত্রের রূপান্তর, উপস্থিতি, এমনকি মৃত্যুও তোমাদের ঘিরে রাখবে। তা ছাড়া আগেই বলেছি, লেখিকার মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার কাহিনি আরও জমে ওঠে। সুতরাং, ধৈর্য ধরলে পুরস্কার পাবে।
তোমরা যারা অ্যানিমের গান শুনতে পছন্দ করো, তারা অবশ্যই উপভোগ করবে প্রতি পর্বের শেষ থাকা গানটি। গানটির নাম ‘লিপসিঙ্ক’, যা পরিবেশন করেছে জাপানিজ ব্যান্ড ‘হকরক্যব’।
সবশেষে ফিরে আসি রন কামোনোহাশির বিড়ালের প্রসঙ্গে। এমন অলস প্রাণী আমি কস্মিনকালেও দেখিনি। তোমরা যারা বিড়াল সম্পর্কে টুকিটাকি ধারণা রাখো, তারা নিশ্চয়ই জানবে, এ এমনই এক প্রাণী, যে কিনা দিনের মধ্যে ১৫-১৬ ঘণ্টা ঘুমায়, আর প্রায় ঘণ্টা বিশেক চোখ বুজে থাকতে পারলে সুখী বোধ করে। তবে আমি যতগুলো পর্ব দেখেছি, তার মধ্যে সাধারণত রনের বিড়ালটিকে চিতপটাং হয়েই থাকতে দেখা গেছে। একবার মনে হয় ভুল করে লেজ নেড়ে ফেলেছিল। আর বাকিটা সময় তার কোনো নড়াচড়া লক্ষ করিনি। তাই প্রথম সিজনের শেষে মেনে নিয়েছি যে ওই প্রাণী আমার চেয়েও অলস! তা তোমরা যদি ওর থেকে একটু বেশি নড়েচড়ে উঠতে পারো, তাহলে আশা করি এই গোয়েন্দা সিরিজও অনায়াস দেখে ফেলতে পারবে। দেখা শেষ হলে কেমন লাগল, জানাতে ভুলো না কিন্তু!