হ্যাঁ, তোমাদেরই করছি প্রশ্নটা। শরীরচর্চার মহিমা সম্পর্কে কি জানা আছে তোমাদের? ব্যায়াম করলে যে স্বাস্থ্যের উপকার হয়, তা নিশ্চয়ই মানো। কিন্তু ছক কষে নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চার অনুশীলন করে কেউ সুপারহিরো হয়ে গেছে, এমনটা কখনো শুনেছ কি? না শুনে থাকলে পড়ে দেখো বাকি বৃত্তান্ত! কারণ, আজ বলব তেমনই এক মানুষের কথা।
সাইতামা। নামটা জাপানিজ মাঙ্গা, তথা অ্যানিমে–জগতে আজ বড্ড সুপরিচিত। মহাশক্তিধর এই কল্পনাগরিককে তুলনা করা হয় জাপানিজ গল্পজগতের খ্যাতিমান সব শক্তিধরের সঙ্গে। অনেকের বিচারে সেই সব শক্তিধরের কেবল একটি ঘুষিতে পরাজিত করার ক্ষমতা আছে ভদ্রলোকের। আর এ ক্ষমতা সে অর্জন করেছে শুধু শরীরচর্চার এই রুটিন অনুসরণ করে—দৈনিক ১০০টি বৈঠক, ১০০টি পুশআপ, ১০০টি সিটআপ এবং ১০ কিলোমিটার দৌড়!
আক্ষরিকভাবেই মাত্র একটি ঘুষিতে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারার এই ক্ষমতাকে মর্যাদা দিয়ে ধারাবাহিকটির নাম রাখা হয়েছে ওয়ান পাঞ্চম্যান। গল্পের সূত্রপাত হয় যখন চাকরির সন্ধানে ক্লান্ত সাইতামা পথ দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পায় এক বিপদগ্রস্ত ছেলেকে। ছেলেটি যথার্থ বেয়াদব। তার দুঃসাহস এতটাই, সে এক দানবের শরীরে আঁকিবুঁকি কেটেছে অমোচনীয় কালি দিয়ে। তাই দানবটি ছেলেটিকে খুঁজে পেতেই আক্রমণ করে বসে। সাইতামা তখনো সাধারণ এক বেকার, এক ঘুষিতে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার ক্ষমতা অর্জন করেনি। তবে কর্তব্যের খাতিরে একপ্রকার প্রাণ হাতে নিয়েই রক্ষা করে ছেলেটিকে। করে ফেলে দানবটির বিনাশ। কাজটি করে সে এতটাই নির্ভার আর আনন্দ বোধ করে যে চাকরির সন্ধান ছেড়ে প্রস্তুত হয় নিজেকে গড়েপিটে শক্তিমান করে তুলতে। ফলে টানা তিন বছর দৈনিক চলে তার শরীরচর্চার অব্যর্থ রুটিন।
অতঃপর দানবদের পরাজিত করার মতো শক্তি অর্জিত হলো। সাইতামার শহরে দানব আর দুশমনেরও কোনো অভাব নেই। আকাশ, মাটি, পাতাল সর্বত্রই তাদের আনাগোনা। তারা আচমকা হাজির হয়ে মেতে ওঠে ধ্বংসযজ্ঞে! তাই শহরকে বিপদের ভিত্তিতে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাইতামা থাকে জেড (Z) অংশে। মূলত ওই স্থানই সবচেয়ে কুখ্যাত। কিন্তু সাইতামার সমস্যাটাও বেশ অদ্ভুত। সে একটি ঘুষি কষলেই প্রতিপক্ষ কুপোকাত! ঘুষিটি যদি কিঞ্চিৎ জোরে হয়, তবে একেবারে অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায় বদমাশদের। তাই হিরোগিরি করে যে আনন্দের স্পর্শ সে পেতে চেয়েছিল, তা একেবারেই ভেস্তে যায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন লড়াইয়ে মজা কই? ভেবে দেখো, তুমি যদি একটি কম্পিউটার গেম খেলতে শুরু করে একবার মাউস ক্লিক করলেই খেলা শেষ হয়ে যায়, তবে কেমন লাগবে? যথার্থ আনন্দ কি পাবে? বোধ হয় না। বরং একটু একটু করে যে বাধাগুলো পার করা যায়, তা-ই বেশি আনন্দ দেয়; সেসব স্মৃতি মনে থাকে দীর্ঘকাল।
ফলে সাইতামা সহজ জয় পেতে পেতে হারিয়ে ফেলল জয়ের আনন্দ। তা ছাড়া তার তেমন কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। লড়াইয়ে এত দ্রুত জিতে যায় যে কেউ জানেও না বদমাশকে হারানোর কৃতিত্ব সাইতামার। হয়তো তার কীর্তির প্রশংসা অন্য কেউ লুফে নিয়ে যায় ঘটনাচক্রে। সেসব সাইতামা জানেও না, ঘেঁটে দেখতেও যায় না। শুধু বিরক্ত হয় তুমুল কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাদ না নিতে পেরে।
এক দিন গল্পের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জেনোসের আগমন ঘটে তার জীবনে। জেনোস যন্ত্রমানব, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে সাইবর্গ। কেবল মগজ ছাড়া তার ভেতর জৈবিক আর কিছুই বলতে গেলে নেই। যান্ত্রিক হৃদয়ে শুধু আছে প্রতিশোধের আগুন। তার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিল এক পাগল সাইবর্গ। তাই জেনোস খুঁজে ফিরছে সেই অজ্ঞাত সাইবর্গকে। তার বিনাশ নিশ্চিত করেই ওর শান্তি হবে।
জেনোস সেই অনুসন্ধানের একপর্যায়ে প্রায় নিহত হতে বসে এক দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িয়ে। কিন্তু ঘটনাস্থল দিয়ে যাচ্ছিল সাইতামা। সে প্রায় বিনা চেষ্টায় দানবটিকে নাশ করে। দৃশ্যটা গেঁথে যায় জেনোসের মনে। ও বুঝতে পারে, লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই লোকের সাগরেদ হয়ে তার থেকে নিজের শক্তি বাড়ানোর তালিম নিতে হবে। তাই জোঁকের মতো সে সেঁটে যায় সাইতামার সঙ্গে। যতই প্রত্যাখ্যান পায়, হাল ছাড়ে না কিছুতেই। একপর্যায়ে নিমরাজি হয়ে সাইতামা শিষ্য হিসেবে মেনে নেয় জেনোসকে। সিরিজের বাকিটা সময় সাধারণত তারা কাছাকাছিই থাকে।
এতক্ষণের বকবক শুনে কি মনে হচ্ছে এ এক মহাগম্ভীর, মারমার-কাটকাট অ্যানিমে? তেমনটা মনে হলে বলতে হবে, তোমাদের অনুমান অর্ধেক সত্য, আর বাকিটা ভুল। ওয়ান পাঞ্চ ম্যানের লেখক ‘ওয়ান’ মূলত গল্পে ধরতে চেয়েছেন এমন এক সুপারহিরোকে, যার শক্তিকেন্দ্রিক কোনো দুর্বলতা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। যদি কিছুমাত্র ঘাটতি থেকে থাকে, তা আছে সামাজিক জীবনে। ফলে মূলধারার সুপারহিরোদের সক্ষমতা কিংবা অক্ষমতাকে বহু আঙ্গিককে সময়ে সময়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে। সাইতামাকে এমন করে রূপ দেওয়া হয়েছে যে তার শক্তি সম্পর্কে সে একই সঙ্গে অবগত আবার উদাসীন। সে আমজনতার মতো মূল্যহ্রাসের গন্ধে গন্ধে বাজারে হানা দিতে প্রস্তুত, মশার ভনভনানি তাকে স্বাভাবিকভাবেই উত্ত্যক্ত করে, উদ্দেশ্যমূলক নিন্দা তারও গায়ে লাগে। কিন্তু সেই সব নিন্দা তুড়ি মেরে উড়িয়েও দিতে পারে। খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা তার আছে, অথচ প্রাপ্ত প্রশংসা বিলিয়ে দিতেও কিছুমাত্র বাধে না। কোনো নির্দিষ্ট সূত্রে তাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। গল্পের অন্য সুপারহিরোদের যখন বিপদে জেরবার দশা, মহাপ্রলয় সমান হুমকি ছোড়া বিদঘুটে দানবের খপ্পরে পড়ে যখন শহর প্রায় ধ্বংসের মুখে, সাইতামা তখন সেসব লড়াইয়ে না গিয়েও দিব্যি পরচুলা মাথায় চাপিয়ে চলে যেতে পারে বিনোদনের সন্ধানে। হিরোদের সুন্দর আর সুপুরুষ হতে হবে? উঁহু, সাইতামার সেই ধার না ধারলেও চলে। স্বাস্থ্য আর শক্তি চর্চা করতে করতে তার মাথার সব চুল ঝরে গেছে। সুতরাং পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত টেকো হিরোদের দঙ্গলে সে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র।
সিরিজটি মূলত শুরু হয় ২০০৯ সাল নাগাদ, একটি ওয়েব কমিকস হিসেবে। লেখক ‘ওয়ান’-এর সাদামাটা আঁকায় মূলত চমৎকার রঙের কল্যাণেই তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০১২ সাল নাগাদ সিরিজটির অন্যতম ভক্ত, বিশিষ্ট মাঙ্গা আঁকিয়ে, ইউস্কে মুরাতা, নিজের চিত্রকর্মে গল্পটিকে ধরার প্রস্তাব দেন ওয়ানকে। এর আগে সুবিশাল ক্রীড়াভিত্তিক মাঙ্গা সিরিজ ‘আইশিল্ড ২১’ আঁকার জন্য যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন মুরাতা। তাই তাঁর আঁকায় নিজের গল্প দেখতে আপত্তি করেননি ওয়ান। ইউস্কে মুরাতা যথেষ্ট সময় নিয়ে শুরু করেন কাজ। প্রতিটি পর্ব তিনি মুক্তি দিতেন যথেষ্ট যত্ন নিয়ে, যা প্রকাশিত হতো ইয়ং জাম্প ওয়েবকমিকস সাইটে। এর কাছাকাছি সময়েই ওয়ানের আরেকটি কাজ, মব সাইকো ১০০, সাপ্তাহিক শওনেন সানডে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতে শুরু করে। ফলে ওয়ান পাঞ্চম্যান–এর গল্প আরও অনিয়মিত হয়ে পড়ে তাঁর কলমে। মুরাতাও গল্প বাড়ানোর পরিবর্তে গুরুত্ব দেন ছবিতে তা আরও নিখুঁত আর জীবন্ত করার কাজে। ফলে পাতা জোড়া নয়নাভিরাম ছবির সংখ্যা বাড়ে, চরিত্রেরা হয়ে ওঠে দুর্দান্ত। পরবর্তী সময়ে ইউস্কে মুরাতা আর ওয়ানের সক্রিয় তত্ত্বাবধানে শুরু হয় সিরিজটি অ্যানিমেতে রূপান্তরের গুরুকাজ। ম্যাডহাউস স্টুডিওর নবীন ও অভিজ্ঞ একঝাঁক বাছাই করা অ্যানিমেটরকে জড়ো করে তৈরি দলটি হৃদয় দিয়ে করেন প্রথম সিজন তৈরির কাজ। যার প্রতিটি অ্যাকশন সিকোয়েন্স নিঃসন্দেহে তোমাদের দেবে এক একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। আর তুলির কাজ বিবেচনা করলে ইউস্কে মুরাতার আঁকায় ওয়ান পাঞ্চম্যান মাঙ্গাটি অন্তত আমার দেখা অন্যতম সেরা কাজ। যারা অ্যানিমে দেখবে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে সুযোগ হলে মাঙ্গাটাও সংগ্রহ করে দেখো, তৃপ্তি পাবে।
সেভাবে দেখলে সুপারহিরোদের নিয়ে প্রচুর সিরিজ রয়েছে। এমনকি বর্তমান সময়েও একাধিক অ্যানিমে রয়েছে। যার মধ্যে বকু নো হিরো একাডেমিয়ার কথা বোধ করি তোমরা অনেকেই জানো। তাহলে এতে বিশেষ কী রয়েছে? এই সিরিজে সুপারহিরোদের শ্রেণিবিভাগ অনেক যত্ন করে করা হয়েছে। যারা প্রতিষ্ঠিত সুপারহিরো হতে আগ্রহী, তাদের দিতে হয় বিশেষ পরীক্ষা; যেখানে লিখিত ও ব্যবহারিক দুই পদ্ধতিতে তাদের সামগ্রিক মান নির্ণয় করা হয়। তারপর স্থান দেওয়া হয় একটি দলে, সেখানে তাদের অবস্থানটি সংখ্যার মাধ্যমে চিহ্নিত করা থাকে। পরবর্তী সময়ে নিয়মিত কাজের বিবেচনায় তাদের ক্রম বা দল বদলায়। যে চারটি দলে তাদের ভাগ করা হয়, তা হলো S, A, B, C। এখানে S দলভুক্ত হিরোরা সবচেয়ে দক্ষ, এদের সংখ্যাও সীমিত। আর সর্বনিম্ন দক্ষতা হলো C দলে থাকা হিরোদের। নিচু দলের হিরোদের করতে হয় কম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, আর উচ্চতর দল পায় ভয়ংকর সব লড়াইয়ের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিরও রয়েছে নির্দিষ্ট বিভাজন। কোন ঝুঁকির মাত্রা কত, তা বোঝা যায় সেসব দিয়েই। ব্যাপারগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে অ্যানিমেতে। এখন শুনে মহাজটিল মনে হলেও দেখবে সব একেবারে সরল।
এখন পর্যন্ত দুটি সিজন মুক্তি পেয়েছে এই অ্যানিমে ধারাবাহিকের, যার প্রথমটি অনবদ্য। দ্বিতীয়টিও ভালো; তবে এক অর্থে বলা যায় অসমাপ্ত। এর স্বাভাবিক কারণ হলো, মাঙ্গার গল্প এখনো চলমান। তবে আশার কথা এই যে সবকিছু ঠিক থাকলে তৃতীয় সিজনটি সম্ভবত আগামী বছর নাগাদ মুক্তি পেতে পারে। করোনার প্রকোপ না থাকলে তা গত বছরের আগস্টেই মুক্তি পেয়ে যেত! যদি আমার পরামর্শ চাও, বলব, ওই অপেক্ষায় থেকো না। জলদি বসে পড়ো অ্যানিমেটা দেখতে। এর বহু দৃশ্য অগণিতবার দেখলেও পুরোনো হবে না। অ্যাকশন অ্যানিমেশনের এমন তুখোড় বাস্তবায়ন খুব কমই আছে। হিরো থেকে ভিলেন অনেকের ক্ষমতাই তোমাদের চমকে দেবে। আর এত লড়াইয়ের মাঝেও আনন্দে ঘাটতি হবে না কোনো। নিয়মিতই পেয়ে যাবে হাসির খোরাক। সাইতামার ঘুষিটি সংগত কারণেই কিছুটা অনিয়মিত, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড তোমাদের আগাগোড়া বিনোদিত করবে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তোমাদের ব্যস্ত রাখবে একঝাঁক বিচিত্র হিরো, ভিলেন আর চরিত্রের দল। আর যদি দুটি সিজন দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা শূন্যতা বোধ হয়, তাহলে গল্পকার ওয়ানের মব সাইকো ১০০ মাঙ্গার ওপর তৈরি অ্যানিমেটিও দেখে ফেলতে পারো। ওটাও দারুণ। তবে সেই সম্পর্কে এখনই বিস্তারিত বলতে পারছি না, তা আরেক দিনের জন্য তোলা রইল।