মহাশূন্যের গোলকধাঁধায়

মহাকাশে অসীম শূন্যতা, যার আদি-অন্ত খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সেই নিরাকার নিয়ে আমাদের আগ্রহের অন্ত নেই। কতশত বিজ্ঞানী দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তার অনুসন্ধান। কিন্তু যতটুকু তাঁরা জেনেছেন, বুঝেছেন, অজানা রয়ে গেছে তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। ধরো, আজ থেকে আরও অনেক যুগ পর সেই সব অনুসন্ধানে তৈরি হয়ে গেল গ্রহান্তরে যাতায়াতের কিছু ব্যবস্থা। আলোকবর্ষ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে চলাচল অনেকাংশেই বাস্তব। ঠিক এমন এক পরিস্থিতিতেও তুমি হারিয়ে গেলে মহাশূন্যে! ফিরে আসার কোনো উপায় আপাতদৃষ্টে নেই, নেই বিন্দুমাত্র আশা। শুধু আছে তোমার মতোই কয়েকজন মানুষ, যারা ঠিক একইভাবে দিশাহারা, আতঙ্কগ্রস্ত। কেমন হবে সেই অভিযান? কেমন হবে সেই অভিজ্ঞতা? জানতে চাইলে দেখে ফেলতে হবে সায়েন্স ফিকশন অ্যানিমে আস্ত্রা লস্ট ইন স্পেস ওরফে কানাতা নো আস্ত্রা

মাত্র ১২ পর্বের এই অ্যানিমের গল্প লিখেছেন কেন্তা শিনোহারা। এর আগে ‘স্কেট ড্যান্স’ শিরোনামে তাঁর আরও একটি গল্প বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রূপান্তরিত হয় ৭৭ পর্বের ধারাবাহিকে। তবে তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত হলেও কাহিনির গভীরতার বিচারে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই আস্ত্রা লস্ট ইন স্পেস

সাল ২০৬৩। ঘটনার শুরু হয় কিছু শিক্ষার্থীর শিক্ষাসফর আয়োজনের সূত্র ধরে। স্কুল থেকে তাদের পাঠানো হবে ম্যাকপা নামের একটি গ্রহে। সেখানে পাঁচ দিন নিজেদের মতো করে টিকে থাকতে হবে। বাইরে থেকে কোনো সাহায্য ওরা পাবে না। দলটির সঙ্গে থাকে ১০ বছরের ছোট্ট মেয়ে ফুনিসিয়া রাফায়েলি। বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে সবাইকে মিলে খেয়াল রাখতে হবে মেয়েটির এবং নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকেও। মোটামুটি সবই চলছিল পরিকল্পনামতো। নির্দিষ্ট দিনে মহাকাশযানে চাপিয়ে ওদের নিয়ে আসা হলো গ্রহটিতে। উপযুক্ত নির্দেশনা দিয়ে বিদায় নিল মহাকাশযানটি। কিন্তু সবকিছু গড়বড় করে দিতে সহসাই ধূমকেতুর মতো হাজির হলো একটি ওর্মহোল। ওদের অনায়াসে গিলে নিয়ে উগড়ে দিল এক অচেনা গ্রহপথে। চারদিকে নিঃসীম শূন্যতার বুকে ওদের দৃষ্টি কাড়ল একটি পরিত্যক্ত মহাকাশযান। বহু কষ্টে তাতেই আশ্রয় নিল ওরা। কিন্তু এখান থেকে ফিরতি পথ পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। ওদের সঙ্গে খাবার ও পানির মজুত আছে মাত্র ২০ দিনের, যা কোনো হিসাবেই পর্যাপ্ত নয়। নেই পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায়। এ যেন ওদের নির্বিচার হত্যার এক অমোঘ ষড়যন্ত্র। এর থেকে বাঁচার উপায় কি আদৌ আছে? জানা নেই কারোরই।

আগামীর অনেকটাই বাস্তব চিত্রায়ন হয়েছে গল্পে। ভবিষ্যৎ সমাজের নানা খুঁটিনাটি ধরা পড়ে অ্যানিমেটির বিভিন্ন ধাপে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার যে রূপরেখা এতে তৈরি হয়েছে, তার সঙ্গে তোমরা মিল খুঁজে পাবে কল্পনার। তবে সাধারণের বাইরে গিয়েও অনেক কিছুই এতে আছে। সেসব প্রসঙ্গে আলোকপাত করার আগে চোখ রাখতে হবে চরিত্রগুলোর দিকে। আস্ত্রার অভিযাত্রী ৯ জনের একটা দল। এদের একেকজন একেক রকম। যেমন আছে সাহসী নির্ভীক কানাতা, তেমনি আছে নিখুঁত স্মৃতির অধিকারী মেয়ে এরিয়েস। আছে খুদে চিকিৎসক কিতোরি আর তার অতিভক্ত ছোট বোন ফুনিসিয়া। মাঝেমধ্যে ফুনিসিয়া বড়দের মতো করে কথা বলে তার হাতে পরা পাপেটের মাধ্যমে। এই সত্তার নাম সে দিয়েছে ‘বিগো’। এ ছাড়া প্রতিভাধর জীববিজ্ঞানী চার্স, মুখচোরা ইউনহা, নির্মাণে দক্ষ লুকা কিংবা মহাকাশযান চালনায় পটু জ্যাক। আর অতি অবশ্যই আছে রাগী সহযাত্রী উলগার। লেখক খুব যত্ন করে চরিত্রগুলোর রূপায়ন করেছেন। নির্মাণ করেছেন তাদের অতীত। এদের পরস্পরকে ক্রমেই গ্রহণ করা কিংবা বন্ধু হয়ে ওঠার পরিস্থিতিগুলো গল্পের অন্যতম সেরা দিক। আবার নানা আঙ্গিকে বিরোধও তৈরি হয়েছে তাদের, দেখা গেছে রহস্যের ঝিলিক। গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে সমাধান হয় এদের ঘিরে থাকা রহস্যগুলোর।

আদতে সায়েন্স ফিকশন হলেও গল্পে চালকের আসনে অনেকাংশেই বসে আছে রহস্য। শুরু থেকে প্রায় শেষ পর্যন্ত নানা স্তরে আছে এর আনাগোনা। যেমন আস্ত্রায় ওঠার কিছুক্ষণ পরই চালক জ্যাকের নজর পড়ে সদ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কমিউনিকেশন মডিউলটির দিকে। অর্থাৎ ওদের মধ্যে কেউ একজন চাইছে না, ওরা ফিরে যাক। কিন্তু কেন? ইউনহার মুখচোরা স্বভাবের পেছনে লুকিয়ে আছে কোন কারণ? কেন উলগার কাউকে ভরসা করতে পারে না, বরং সবার থেকে দূরত্ব রাখতে আগ্রহী? এমন আরও অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যায় রহস্যের মোড়কে গল্পকে ঘিরে রাখতে।

অভিযানের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গ্রহে পা রাখতে হয় ওদের। এই সব গ্রহের প্রকৃতি ও পরিবেশ গঠনে দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন কেন্তা শিনোহারা। প্রতিটি গ্রহ নতুন কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে দেখা দিয়েছে দৃশ্যপটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভিলাভার্সের ছোট–বড় হতে পারা গাছ কিংবা উড়ন্ত দানবের কথা কিংবা সুম্মুরের ছত্রাকজীবী উদ্ভিদের চরিত্র অথবা এক নারী প্রজাতিবেষ্টিত জগতের কথা। আছে এমন গ্রহ, যার অর্ধেকটা চিরন্তন দিন এবং বাকিটা চিরন্তন রাত ধারণ করে চলে। এই সব গ্রহ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় দলটাকে। এ ছাড়া মহাকাশযানকে সচল রাখতেও নানা সময় ওদের পড়তে হয়েছে গাড্ডায়। সেসব সামাল দিতে লড়তে হয়েছে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে।

গল্পের অস্থিরতা প্রকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে এর চমৎকার শব্দের কাজ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বেশ গুছিয়ে কাজ করা হয়েছে। কখনো নৈঃশব্দ্যের ভিড়ে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ, কখনো তীক্ষ্ণ শব্দের বাণ নিক্ষেপ করে মগ্ন রাখা হয়েছে দর্শককে। পক্ষান্তরে সব কটি কণ্ঠ চরিত্রের সঙ্গে মানানসই মনে না হলেও অধিকাংশই উৎরে গেছে। এ ছাড়া অতি অবশ্যই আছে জাপানি পপ তারকা নোনকের কণ্ঠে চমৎকার গান ‘স্টার*ফ্রস্ট’, যা দিয়ে শুরু হয় ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্ব। আর পর্বগুলো সমাপ্ত হয়েছে আরেক জাপানি তারকা আজুনা রিকোর গান ‘গ্লো অ্যাট দ্য ভেলোসিটি অব লাইট’ দিয়ে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য একটি গানও রয়েছে শিল্পী সাওরি হায়ামির কণ্ঠে। ‘স্টার অব হোপ’ শিরোনামের এই গান কাহিনির একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আয়োজিত হয় এবং সম্ভবত এটাই সিরিজের সেরা গান।

নিয়মিতভাবে টুকটাক কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে উঠে এসেছে গভীর ষড়যন্ত্রের আভাস। সব কটি ছেঁড়া সুতা জোড়া হয়েছে সযত্নে। আপাতদৃষ্টে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও কোনো কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। আর এটাই আস্ত্রা লস্ট ইন স্পেস গল্পকথার সেরা সম্পদ।

তবে আর দেরি কেন? রহস্যময় এই মহাকাশ অভিযানে যোগ দাও তোমরাও। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে নিতে যখন গোলকধাঁধার শেষ সীমানায় পৌঁছে যাবে, তখন হয়তো আমার মতো তোমাদেরও মনে হবে যে এটুকু তৃপ্তিই ঠিকঠাক। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল না, কমও নয়। যাত্রাটা সংক্ষিপ্ত হলেও এর রেশ থাকবে বহুকাল—এটুকু কথা দিতে পারি।