আমি যেভাবে সওয়ার হলাম মহীনের ঘোড়ায়
পশ্চিমবঙ্গের কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তাপস বাপী দাস। তাঁকে বলা হতো ‘মহীনের আদি ঘোড়া’। গত ২৫ জুন মারা যান তিনি। কিংবদন্তি এই শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন জনপ্রিয় লেখক নাবিল মুহতাসিম।
বাংলা কিংবদন্তি ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র শেষ জীবিত সদস্য তাপস বাপী দাস কর্কট রোগের সঙ্গে লড়াই শেষে বিদায় নিয়েছেন। মহীনের আর কোনো ঘোড়া চরবে না কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে।
নাকি চরবে? আগে বলি, কম দিন থেকে কি চলছে মহীনের ঘোড়ার জয়রথ? সত্তরের দশকে যখন আমরা ভাবতেও পারি না বাংলা গান অমন হতে পারে, তখন ওই লিরিকস, ওই সুর, ওই ভাব, ওই আধুনিকতা নিয়ে এক ধাক্কায় কতটা যে এগিয়ে দিয়েছিল তারা গানের জগৎটাকে, চিন্তা করলে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে।
কিন্তু নতুন বাঙালি প্রজন্ম কি মহীনের ঘোড়াগুলি শোনে?
আমার নিজের কাহিনি বলি। শুরুটা সেই ২০০৬ সালে। বলিউডি ‘গ্যাংস্টার’ মুভিতে জেমসের গাওয়া ‘না জানে কোয়ি’–জ্বরে উপমহাদেশ কাঁপছে। টিভিতে গানটা শুনতে শুনতে ভাইয়া মন্তব্য করল, ‘গানটা আসলে পশ্চিমবঙ্গের একটা বাংলা গান থেকে করা।’
জীবনেও এত অদ্ভুত কথা শুনিনি আমার ওই ১২-১৩ বছর বয়স পর্যন্ত। সারা জীবন তো দেখলাম হিন্দি থেকে বাংলা গান কপি হয়। তার উল্টোটা যে হয়, হতে পারে, কে ভেবেছিল? ব্যান্ডটার নামও বলল ভাইয়া—মহীনের ঘোড়াগুলি। না, মহীনের ঘোড়াগুলির ভক্ত তখনই হইনি। তখন আমি ফুয়াদ, সুমন, স্টোয়িক ব্লিস, তপুতে আসক্ত।
কলেজে উঠলাম। ভাইয়াই আবার পরিচয় করাল মহীনের ঘোড়াগুলির সঙ্গে।
‘এ কী যে কাণ্ড, এ কী যে কাণ্ড! এ কী কাণ্ড, এ ব্রহ্মাণ্ড শূন্য লাগে! তুমি ছাড়া শূন্য লাগে।’
‘রাবেয়া কি রোখসানা, ঠিক তো মনে পড়ে না...অস্থির এ ভাবনা শুধু করে আনাগোনা।’
মাত্র এই দুটি গান আমার মগজে স্থান করে নিতে পারল সে দফা। মনে তো নয়ই।
মনের ভেতরে তখন চলছে—
‘Yesterday, all my troubles seemed so far away...’
বা
‘Bright are the stars that shine, dark is the sky...i know this love of mine will never die...’
কিংবা
‘waiting, waiting, waiting for the sun...’
অথবা
‘And if a double-decker bus, crashes into us...to die by your side is such a heavenly way to die...’
বিটলসকে জিউসের ওপরে স্থান দিই তখন। দ্য স্মিথসের গান শুনলে দুনিয়াটা তুচ্ছ মনে হয় (এখনো হয়) আর জিম মরিসন নিয়ে অবসেসড। চুলই রেখেছিলাম অমন কাঁধ পর্যন্ত। নাজিম ভাই (লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন) জিম মরিসনকে নিয়ে একটা বই অনুবাদের ঘোষণা দেওয়ার পর বইটা কবে আসবে জানতে প্রতি মাসেই ওনাকে আমাদের বাড়ির ল্যান্ডফোন থেকে কল দিয়ে বিরক্ত করি।
এই জগতে মহীনের ঘোড়াগুলি প্রবেশ করতে পারল না খুব একটা। কী জানি, তখনো হয়তো আমি নিতান্ত কিশোর। তা ছাড়া ঢাকায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত বোধ হয় মফস্সলের ছেলেদের বয়স বাড়লেও মানসিক বিকাশ হয় না, শিশুই থেকে যায়।
ঢাকায় নতুন পরিবেশ, নতুন লোকজন, মনের ভেতর নতুন নতুন ভাব—এসবের সামনে চোয়াল ঝুলিয়ে হাঁ করে দাঁড়ানো আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমুল বেগে ছুটে আসা মহীনের ঘোড়াগুলির খুরের নিচে পিষ্ট হলাম।
এ রকম কিছু কক্ষনো শুনিনি আমি, কোনো বঙ্গসন্তান শোনেনি—
‘ভালো লাগে বুনুয়েল পিকাসো দান্তে; বিটলস, ডিলান আর বেঠোফেন শুনতে; রবিশঙ্কর আর আলী আকবর শুনে ভালো লাগে ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে।’
দারুণ। অ্যাস্থেটিক। কিন্তু পরের লাইনেই এ কী!
‘যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে–বন্দরে, ফসল ফলায় ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে। তখন ভালো লাগে না, লাগে না কোনো কিছু। সুদিন, কাছে এসো। ভালোবাসি একসাথে সবকিছু!’
বলে কী? মাথা ঘুরে ওঠে বোঁ করে। মেটালের রণচণ্ডীমূর্তি নয়, কিন্তু তার চেয়ে কোনোভাবেই কম শক্তিধর নয় এ লিরিক। এ যেন বিদ্যাসাগরী চটি পায়ে, খদ্দরের পাঞ্জাবি পরনে বায়ান্ন সালে রাইফেলের নলের মুখে দাঁড়ানো যুবক। কী সুললিত, কিন্তু কী অমিত শক্তিধর! বাঙালি তো এ রকমই। ছয় ফুট শরীর নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাবড়ে বেড়ানো হাফউইট গোঁয়ারগোবিন্দ তো আমরা নই। আমরা কাব্যিক আবার প্রতিবাদীও। এই গানের মতোই।
আবার—
‘রানওয়েজুড়ে পড়ে আছে শুধু কেউ নেই, শূন্যতা। আকাশে তখন থমকিয়ে আছে মেঘ। বেদনাবিধুর রাডারের অলসতা। শূন্য ডানায় বায়বিত গতিবেগ।’
মোবাইল ভর্তি করে ফেললাম মহীনের ঘোড়াগুলির গান ডাউনলোড করে। সারা দিন শুনি সেগুলো। শুধু অরিজিনাল গান নয়, তাদের সম্পাদিত অ্যালবামে অন্য প্রবল প্রতিভাধর শিল্পীদের গানও চিনলাম—
‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি দেখা যায় তোমাদের বাড়ি। তার নীল দেয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারি।...সেথা একলা তুমি গান গেয়ে ঘুরেফিরে, তোমার এলোচুল ওই বাতাসে শুধু ওড়ে...সেই বাড়ির নেই ঠিকানা, শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি।’ (দিব্য মুখোপাধ্যায়)
এমন সাইকেডেলিক, এমন প্রবল বিষণ্ন, এমন তীব্র রোমান্টিক গান গোটা পৃথিবীতেই আছে কয়টা। কিংবা যে গান এখন সবাই চেনে—
‘আর কীই–বা দিতে পারি! পুরোনো মিছিলে পুরোনো ট্রামেদের সারি। ফুটপাথঘেঁষা বেলুনগাড়ি, সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা, ওরাই আমার থতমত এ শহরে রডোডেনড্রন। তোমায় দিলাম, তোমায় দিলাম, তোমায় দিলাম।’ (গড়ের মাঠ)
কিংবা গড়ের মাঠেরই—
‘ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি, খিদের থেকেও স্পষ্ট। কাজের মধ্যে অকাজ খালি! মনের মধ্যে কষ্ট। স্বপ্ন হয়ে যখন তখন আঁকড়ে আমায় ধরো, তাই তো বলি আমায় বরং ঘেন্না করো, ঘেন্না করো।’
এমন গান কে কবে গেয়েছে আর!
আর্ট, আর্টের জন্ম দেয়। সাধারণ পৃথিবীর মাঝে অসাধারণ চিনতে শেখার গুরু আমার একজনই—ভাইয়া নিয়াজ মেহেদী (লেখক)। ওর একটা অসাধারণ উপন্যাসের নাম ‘ধাঁধার থেকেও জটিল’। হ্যাঁ, ওই গান থেকেই। তবে মহীনের ঘোড়াগুলি আমার কলমে শক্তি জোগাচ্ছে ভাইয়ারও আগে থেকে। আমার লেখায় মহীনের ঘোড়াগুলি বারবার হাজির হচ্ছে তো হচ্ছেই।
‘বাজিকর’ উপন্যাসের ঘটনা শুরু ইউক্রেনের দোনেৎস্কের এক ভগ্ন এয়ারপোর্টে। কাহিনি শেষও ওখানেই। লেখার সময় অন রিপিট শুনতাম ‘রানওয়েজুড়ে পড়ে আছে শুধু কেউ নেই শূন্যতা।’
‘বাজি’তে ভারত আর বাংলাদেশের বাজিকর যখন মুখোমুখি লড়াইয়ে, তখন রবীন্দ্র–নজরুলের সঙ্গে মহীনের ঘোড়াগুলির কথা ভেবে, কী করে আমাদের জাতির সম্পদগুলো কাঁটাতার দিয়ে ভাগ হলো, ভেবে চোখে পানি আসে দুজনেরই (ভারতীয় বাজিকর অভিজিৎ বাঙালি)। আমার ছোটগল্পের নাম হয় ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ (জীবনানন্দ x মহীনের ঘোড়াগুলি), ‘যে গেছে বনমাঝে’ (‘চৈত্রের কাফন’ নামের গান থেকে) ইত্যাদি ইত্যাদি।
মহীনের ঘোড়াগুলি নিয়মিত শুনছি। না শুনে উপায় নেই। এ এমন এক জাদু, যেটা দুদিন না শুনলে জীবনটা পানসে হয়ে যায়। মনে হয়, কী যেন নেই।
বাপীদা নেই, মহীনের অরিজিনাল আর কোনো ঘোড়াই বেঁচে নেই, কিন্তু মহীনের ঘোড়াগুলি কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে ঠিকই ঘাস খেতে থাকবে। উপায় কী? আমাদের অন্তরে ওই সিন্ধুঘোটকের ছাপ চিরস্থায়ীভাবে বসে গেছে যে!