গল্পটা এক আজব রাজপুত্রের, কিংবা একজন হতভাগ্য রাজারও বলতে পারো। অথবা এ এক রানির গল্প! কিংবা এমন কিছু মানুষের গল্প, যারা জড়িয়ে গেছে ভাগ্যের পাশা খেলায়।
অনেক অনেক দিন আগের কথা, বোশ্যে নামে ছিল এক রাজ্য। রাজার নামেই রাখা রাজ্যের নাম। বিরাট পরাক্রমশালী রাজা। জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। রাজাদের ক্ষমতার তালিকায় সে একেবারে শীর্ষে! কিন্তু দিন সবার সমান যায় না। বার্ধক্যের আঘাতে শয্যা নিল রাজা। নেমে এল ভয়ানক দুর্দিন।
রাজার দুটি সন্তান। হিসাবমতো বড়জনকেই করা হবে পরবর্তী রাজা। অথচ ছেলেটি রাজা হওয়ার যোগ্য নয়। তার শারীরিক অক্ষমতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পথে। বড় রাজকুমার বোজ্জি যেমন কানে শুনতে পারে না, তেমনি বলতেও পারে না কিছু। রাজ্যের প্রজাদের কাছে সে হাসির পাত্র। শারীরিক শক্তির ছিটেফোঁটাও তার দেহে নেই। কেউ আঘাত করলে পাল্টা আঘাত করতে সে জানে না, বরং আঘাত এড়িয়ে যেতে সে ওস্তাদ। কিন্তু তা তো রাজার ধর্ম হতে পারে না! রাজা হতে হবে বীর, লড়াকু। লড়াই বোজ্জির কম্মো নয়। অপর দিকে ছোট কুমার দাইদা লড়াইয়ে জগৎ–সেরা না হলেও যথেষ্ট পাকা। রাজা হওয়ার শতভাগ ইচ্ছা আছে তার মনে। রাজ্যের বর্তমান রানিও চায় তার ছেলে দাইদা রাজা হোক। বোজ্জিকে রাজা করার ক্ষেত্রে আছে তার ঘোরতর আপত্তি। অন্যদিকে রাজার প্রধান চার যোদ্ধাদের একেকজন একেক দলে। সুতরাং সিদ্ধান্তে আসা কঠিন।
মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তে রাজা ঘোষণা দিয়ে গেলেন, বোজ্জিই হবে পরবর্তী রাজা। কিন্তু ভাগ্যের ছিল অন্য হিসাব!
গল্পটা একটু চেনা চেনা লাগছে কি? সৎমা ও ভাই, অসহায় রাজা, রাজতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র—এসব উপাদান দেখে তা ভাবা অন্যায় কিছু নয়। তবে এই সিদ্ধান্ত ধরে বসে থাকলে বড্ড ভুল হবে।
বলছিলাম ও-সামা র্যাঙ্কিং অথবা র্যাঙ্কিং অব কিংস–এর কথা। গতানুগতিক প্রেক্ষাপটে একটি ব্যতিক্রম বিশেষ কাহিনি। ২৩ পর্বের আয়োজনে প্রথম সিজনটি দর্শকদের সামনে ধারাবাহিক এসেছিল ২০২১-২২ সালে। উইট স্টুডিওর নির্মিত এই অ্যানিমের অ্যানিমেশনের কথা বলতে গেলে অবশ্য একটু বিরতি নিতে হয়। কারণ, গতানুগতিক জাপানি অ্যানিমের থেকে বেশ ভিন্ন ধাঁচের এই সিরিজের তুলির আঁচড়। মাঙ্গাকা, সোউস্কে তোকার আঁকা এতটাই ভিন্ন যে শুরুতেই তা আগ্রহে একটু রাশ টানতে পারে। তবে এ কথাও খাঁটি সত্যি যে এ ধরনের রূপকথা ধাঁচের গল্পের জন্য শিল্পীর ছবিগুলো একেবারে খাপসই। অ্যানিমেতে অবধারিতভাবে জুড়ে গেছে রং আর শব্দ। সুতরাং কাহিনি উপভোগের মাধ্যম হয়েছে সহজতর।
আগেই বলেছি, গল্পটা রূপকথার, রহস্যের ভাঁজ আরেকটু খুলে দিলে দর্শক হিসেবে তোমাদের আনন্দে কিছুটা ভাগ বসানো হবে। তাই সেটুকু এড়িয়ে যাচ্ছি সাবধানে। তবে চরিত্রগুলোর গঠনের দিকে কিছুটা আলো ফেলা যায়। জাপানের অধিকাংশ কিশোর উপযোগী মাঙ্গায় সাধারণত যে ধারা লক্ষ করা যায়, তা হলো ভালো ও মন্দের একটা স্পষ্ট তফাত। বেশ মোটাদাগে আলাদা করে দেওয়া হয় গল্পের নায়ক ও তার শত্রুকে। নানা ঘটন-অঘটন শেষে নায়ক গিয়ে শত্রুকে পরাজিত করলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে পাঠক। সেই মাঙ্গা থেকেই যখন অ্যানিমে প্রস্তুত হয়, তখন মূল উপাদানে বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না। ও-সামা র্যাঙ্কিং এদিক থেকে বিশেষ। এতে প্রায় কোনো চরিত্রই স্পষ্ট ভালো বা মন্দ নয়। হ্যাঁ, নিরেট ভালো বলতে চাইলে রাজকুমার বোজ্জিকে তা বলা যেতে পারে। তবে বাদবাকি সবাই অনেকটা ধূসর বর্ণের। গল্পের শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্ব পর্যন্ত তাদের বদল চোখে পড়ে। যাকে প্রথম দেখায় ভালো মনে হবে না, সে–ও হয়তো কোনো বিশেষ কারণে বিপথে যেতে বাধ্য হয়েছে। আর প্রতিটি কারণ উদ্ধারের সময় যে চমকের অনুভূতি পাওয়া যায়, তাই দর্শকের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে ওঠে।
বেশ কিছু দুর্দান্ত সহায়ক চরিত্র রয়েছে গল্পটিতে। বিশেষ করে বলা যায়, রানিমা, অর্থাৎ বোজ্জির সৎমায়ের কথা। সময়–সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় হাজির হয়েছেন যথাস্থানে। রাজার চার বিশেষ যোদ্ধা, যার মধ্যে দরোশির কথা না বললেই নয়। রাজসেবা করতে গিয়ে যে পরিমাণ আত্মনিবেদন সে করেছে, তা সবার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বাকিরাও যথেষ্টই বহুমাত্রিক। কাহিনির বিভিন্ন সময় তাদের কাজগুলোই গল্পের মোক্ষম খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে তৈরি করেছে গল্পের ভিত্তি।
বোজ্জির সবচেয়ে বড় সহায় কাগে; আক্ষরিকভাবেই জাপানিজ ভাষায় নামটির অর্থ—ছায়া। পুরো গল্পে ছায়াসঙ্গীর মতো সে থেকেছে রাজকুমারের সঙ্গে। বিপদে যেমন পাশে থেকেছে, হতাশা থেকে তুলে আনতে সাহায্য করেছে নানা সময়ে। দুটো ভিন্ন প্রজাতির জাতক হয়েও কী সুন্দর পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠা যায়, তা গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছে বোজ্জি আর কাগের মধ্য দিয়ে।
ভুলে গেলে চলবে না মিরাঞ্জোর কথাও। চরিত্রটির আগমন, পরিবর্তন, ইতিহাস ও সবশেষে রূপান্তর একটু একটু করে দর্শকের মনে সৃষ্টি করে চাহিদা।
কাহিনিতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় রহস্য। দেখা যায়, রাজা বোশ্যের উত্থানের গল্প, আপিসের ভক্তির যুক্তি, বেবিনের সিদ্ধান্তের কার্যকারণ, দোমাসের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে ওঠার লড়াই। এর কোনোটাই কিন্তু গৌণ নয়, গল্পের জন্য প্রতিটি উপাদানই সমান জরুরি। এসবের বাইরেও আছে আরও একটি ছোট গল্প, সেটুকুও ভ্রাতৃপ্রেম আর সংগ্রামের কথা তুলে ধরে নির্মম ইতিহাসের ভিড়ে।
এ গল্পে মন্দ লাগার মতো বিশেষ জায়গা নেই। অনেক আদর করে বলা হয়েছে প্রতিটি অধ্যায়। অ্যানিমের শেষ দিকে এসে কিছু জিনিস একটু দীর্ঘায়িত হলেও সমাপ্তির আবেশ তা ভুলিয়ে দেয়।
অ্যানিমের আবেদন বাড়িয়েছে এর মনোগ্রাহী শব্দের কাজ। গল্পের সঙ্গে মিল রেখে নানা সুর এতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যথাসময়ে। প্রতি পর্বের একেবারে শেষে গিয়ে বেজে ওঠে দুর্দান্ত গান। সংগীতশিল্পী ইয়ামার ভার্সেস দ্য নাইট অ্যালবামের ওজ (Oz.) গানটি রাখা হয়েছে এখানে। গল্পের মূল আবেগটুকু নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে এতে।
এককথায় বললে, ও-সামা র্যাঙ্কিং বা র্যাঙ্কিং অব কিংস অ্যানিমেটি দর্শকের মনে দীর্ঘদিন ছাপ ফেলে যাওয়ার মতো সব উপাদান নিয়ে তৈরি একটি বিশেষ আয়োজন। পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে দেখার পর মনে কোনো প্রকার আক্ষেপ থাকে না। নানা উৎকণ্ঠা আর আবেগের দোলাচলে রাখার পর শেষ পরিচ্ছেদে গিয়ে কিছু অনন্য ভালো লাগা উপহার দিয়ে যায় গল্পের মায়াজাল। সেভাবে বিচার করলে একে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা যায়। সিরিজটির ভক্ত বনে যাওয়ার পর থেকেই আমিও আছি নতুন ভক্তদের অপেক্ষায়। তোমরাও ঝটপট সিরিজটি দেখে যোগ দিতে পারো দলে। এসব অপেক্ষায় সঙ্গী যত বাড়ে, আনন্দ তত বেশি। সেই আনন্দের স্বাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত কোরো না কিন্তু!