রাজীব আশরাফের প্রয়াণ: ‘হোক কলরব’ যেভাবে গান হয়ে উঠেছিল

রাত আড়াইটা। রীতিমতো ‘তক্ষক ডাকা নিশুতি’। মাত্রই অফিসের কাজ শেষ হয়েছে। ক্লান্তি ভর করলেও হুট করে কী যেন হলো তাঁর। কাগজ–কলম নিয়ে বসে পড়লেন। লিখতে থাকলেন শব্দের পর শব্দ। সেগুলো অর্থহীন লাগতে পারে। হিজিবিজি মনে হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। তবে তিনি যে আনন্দধারায় ভাসছেন, তা স্পষ্ট।

লেখা শেষে হানা দিলেন বন্ধু সামীর-মিতুনের বাসায়। পড়তে দিলেন তাঁদের। উচ্ছ্বসিত হলেন দুজনই। মিতুনের উৎসাহ তো আরও বেশি। বললেন—

‘অর্ণবকে এক্ষুনি শোনানো উচিত।’

‘এত রাতে!’

‘আলবত।’

তখন ল্যান্ডফোনের দিন। আধো ঘুম আধো জাগরণে রিসিভার কানে তুললেন অর্ণব।

—হ্যালো, কে?

—আরে আমি! তোমার বন্ধু তো দুর্দান্ত একটা লেখা লিখসে!

—তাই নাকি? কী রকম?

—‘হোক কলরব ফুলগুলো সব
    লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান
    অসম্ভবে কখন কবে
    মেঘের সাথে মিল হলো ক্যান…’

—দারুণ তো! দাঁড়াও দাঁড়াও। খাতা নিয়ে আসি। লিখে রাখা দরকার। পুরোটা আবার বইলো।

তত দিনে অর্ণবের প্রথম অ্যালবাম ‘চাই না ভাবিস’ মুক্তি পেয়েছে। শ্রোতাদের কাছে দিন দিন সমাদৃত হচ্ছেন তিনি। দ্বিতীয় অ্যালবামও বের করলেন দ্রুতই। ‘হোক কলরব’কে রাখলেন টাইটেল ট্র্যাক হিসেবে। লিরিক বুকে শোভা পেল গীতিকারের নাম—রাজীব আশরাফ। ‘হোক কলরব’সহ অ্যালবামের অন্যান্য গান অর্জন করল তুমুল জনপ্রিয়তা।

গানটি রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে গিয়েছিলেন রাজীব আশরাফ। সেখানে দেখা কবি তওফীক রিয়াজের সঙ্গে। প্রশংসায় ভাসালেন তিনি। জানালেন মুগ্ধতার কথা। করলেন ভবিষ্যদ্বাণীও, ‘তুই কী চমৎকার লিখেছিস! দেখিস, একদিন বোম হয়ে ফাটবে।’ ধন্যবাদ জানালেও ঠিক বিশ্বাস করলেন না রাজীব। ভাবলেন, এটা তো কেবল একটা শিশুতোষ ছড়া।

তাঁর ভুল ভাঙল ১০ বছর পর। দেয়ালে তখন ঝুলছে ২০১৪ সালের ক্যালেন্ডার। সংগীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী ফোন দিয়ে বললেন, তিনি রাজীবের ফোন নম্বর কয়েকজন সাংবাদিককে দিয়েছেন। মানুষজন তাঁকে খুঁজছেন। রাজীব কিছুই বুঝতে পারলেন না। পরামর্শ পেলেন ফেসবুকে যাওয়ার।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সচল করার পর হতভম্ব হয়ে পড়লেন তিনি। গর্বও অনুভব করলেন অবশ্য। দেখতে পেলেন, সমগ্র কলকাতা ক্ষোভে উন্মাতাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিযোগ আমলে নেয়নি। এর ফলে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা আহত। চলছে অন্যায় গ্রেপ্তার। আন্দোলন এখন তাই আরও তীব্র। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন আপামর জনতাও। আর সবাইকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে ‘হোক কলরব’। রাজীবের সৃষ্টি এই শব্দদ্বয় হয়ে উঠেছে সংগ্রামের স্লোগান।

রাজীব পরবর্তী সময়ে আরও গান লিখেছেন। বানিয়েছেন নাটক, বিজ্ঞাপন, তথ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র; করেছেন অভিনয়ও। কিন্তু সবটাই এখন অতীত। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন এত দিন। ১ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে পাড়ি জমালেন পরপারে। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৮ বছর।

‘প্রকৃত জল খুঁজে বেড়াই
জলজ বৃক্ষের মতো
শয়নকক্ষে জড়িয়ে থাকা ওতপ্রোত’

বিদায়, জলজ বৃক্ষ! প্রকৃত জলের অনুসন্ধান এবার কি তাহলে থেমেই গেল?

(মাছরাঙা টিভিতে প্রচারিত রাজীব আশরাফের এক সাক্ষাৎকার অবলম্বনে)