১৯৯৫ থেকে ২০০৫—বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হালের জনপ্রিয় অনেকগুলো ব্যান্ড যাত্রা শুরু করে এ সময়। অর্থহীন, ক্রিপ্টিক ফেইট, আর্টসেল, নেমেসিস, শিরোনামহীন, আর্বোভাইরাসের মতো ব্যান্ডগুলোর আত্মপ্রকাশে শোরগোল পড়ে যায় ব্যান্ড সংগীত অঙ্গনে। তবে শুরুর দিকে অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে এসব ব্যান্ডকে। বাংলাদেশে তখনো ব্যান্ড সংগীত নতুন। নতুন গান প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় জানান দেওয়া ছাড়া ব্যান্ডগুলোর কাজ ছিল শ্রোতা তৈরি করা। নিজস্ব অ্যালবাম বের করার আগে অনেকগুলো ব্যান্ড এক হয়ে বের করত ‘মিক্সড অ্যালবাম’। একটা অ্যালবামের মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যান্ডের নাম দেখে স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হতেন শ্রোতারা। পাশাপাশি নতুন ব্যান্ডগুলোর জন্যও এটা ছিল দারুণ এক সুযোগ। পুরো একটা অ্যালবাম বানানোর ঝক্কিতে না গিয়ে মিক্সড অ্যালবামে একটা বা দুটো গান দিয়েই শ্রোতাদের সামনে আসত নতুন ব্যান্ডগুলো। ‘ছাড়পত্র’ এমনই একটি বহুল আলোচিত মিক্সড অ্যালবাম। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘জি সিরিজ’-এর ব্যানারে ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় এই অ্যালবাম। অনেকের মতে, ‘ছাড়পত্র’ বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। অ্যালবামটিতে ছিল অর্থহীন, ব্ল্যাক, ক্রিপ্টিক ফেইট, মেটাল মেইজের মতো ব্যান্ডের গান। তবে এই অ্যালবামটি আরও একটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্টসেল তাদের প্রথম গান প্রকাশ করেছিল ‘ছাড়পত্র’-তেই।
আর্টসেলের শুরু অবশ্য আরও আগে থেকেই। নব্বই দশকের শেষ দিকে এরশাদ জামান আর লিংকন ছিলেন ‘তান্ত্রিক’ নামের একটি ব্যান্ডে। ভোকালে লিংকন আর গিটারে এরশাদ। কিছুদিন পর ‘তান্ত্রিক’ ছেড়ে দিলেন বেজিস্ট আর ড্রামার। লিংকন আর এরশাদ খুঁজছিলেন নতুন কাউকে। ঘটনাক্রমে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হয় সাজু আর সেজানের। সাজু ড্রামস বাজাতেন, সেজান বেজ। ‘তান্ত্রিক’ বাদ দিয়ে চারজন মিলে সিদ্ধান্ত নেন নতুন একটা ব্যান্ড করার। জন্ম হয় ‘আর্টসেল’–এর।
বেশ কয়েকটি লাইভ অনুষ্ঠানে দারুণ পারফর্ম করায় সে সময় অনেকেরই চোখে পড়ে যায় ব্যান্ডটি। সুযোগ আসে ‘ছাড়পত্র’ অ্যালবামটিতে গান করার। যেহেতু অনেকগুলো ব্যান্ডের গান থাকবে অ্যালবামটিতে, আর্টসেলের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, এমন একটা গান করবেন, যেটা ছাপিয়ে যাবে বাকি সবাইকে। সেই চিন্তা থেকেই তাঁরা তৈরি করেন নিজেদের প্রথম গান ‘অদেখা স্বর্গ’। অ্যালবামটি বের হওয়ার পর গানটি সবার মধ্যে এতই সাড়া ফেলে যে শ্রোতা থেকে শুরু করে মিউজিশিয়ান, সবার মুখে ছিল একটাই প্রশ্ন, আর্টসেল কারা? একটা নতুন ব্যান্ড কীভাবে এত ভালো গান করল!
‘অদেখা স্বর্গ’ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর নিজেদের অ্যালবাম প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় আর্টসেল। ছাড়পত্রের ঠিক পরের বছর, ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় আর্টসেলের প্রথম অ্যালবাম, ‘অন্যসময়’।
‘অন্যসময়’ দিয়ে ব্যান্ড মিউজিকে হইচই ফেলে দেয় আর্টসেল। ভিন্নধর্মী লিরিকের সঙ্গে পরিণত সাউন্ড আর ব্যান্ডের প্রত্যেক সদস্যের অনন্য বাজনা—সব মিলিয়ে আর্টসেল রাতারাতি পরিণত হয় বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ডে। বিশেষ করে ‘অন্যসময়’, ‘পথচলা’, ‘অবশ অনুভূতির দেয়াল’, ‘ভুল জন্ম’ গানগুলো চলে আসে মানুষের মুখে মুখে।
চার বছরের মাথায়, ২০০৬ সালে আর্টসেল প্রকাশ করে দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘অনিকেত প্রান্তর’। আবারও সবকিছু ওলট–পালট করে দেয় প্রগ্রেসিভ মেটাল ঘরানার ব্যান্ডটি। সারা দেশে তুমুল আলোড়ন তোলা অ্যালবামটির শেষ গান ‘অনিকেত প্রান্তর’ সাড়া ফেলে সবার মনে। ১৬ মিনিট ৩২ সেকেন্ডের গানটিকে অনেকেই বিবেচনা করেন বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান হিসেবে।
ব্যতিক্রধর্মী লিরিকের সঙ্গে মেলোডিয়াস ইনস্ট্রুমেন্টাল—হোক সেটা গিটারের সলো কিংবা ড্রামস, দুইয়ে মিলে আর্টসেলের প্রতিটা গানই যেন শ্রোতাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।
দ্বিতীয় অ্যালবামের পর আর্টসেলের কাছে সবার প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। ‘অনিকেত প্রান্তর’ মুক্তির পর থেকেই তৃতীয় অ্যালবামের জন্য প্রতীক্ষা শুরু হয়ে যায় ভক্তদের। কিন্তু নানা কারণে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল পরবর্তী অ্যালবামের কাজ। গিটারিস্ট এরশাদের সঙ্গে ব্যান্ডের বাকিদের মনোমালিন্য দেখা দেয়। আবার ড্রামার সাজু আর বেজিস্ট সেজান চলে যান দেশের বাইরে। সব মিলিয়ে একপ্রকার থেমেই যায় ব্যান্ডটির কার্যক্রম। তবে এতে ব্যান্ডটির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। নতুন অ্যালবাম নিয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও দুই অ্যালবাম আর কয়েকটি মিক্সড অ্যালবামের গান দিয়েই আর্টসেল পরিণত হয় কিংবদন্তিতে, সেই সঙ্গে তাঁদের তৃতীয় অ্যালবাম পরিণত হয় মিথে।
নতুন অ্যালবাম বের না হওয়ার পরও আর্টসেলকে নিয়ে শ্রোতাদের আগ্রহ সব সময়ই আকাশচুম্বি। এর অন্যতম কারণ ব্যান্ডটির গান। বরাবরই সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল ব্যান্ডটি। যেসব গান অ্যালবাম বের হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয় হয়নি, সেগুলো পরিচিতি পেয়েছে আরও বেশ কয়েক বছর পর। শুধু মিউজিকে নয়, আর্টসেল সব সময় চেয়েছে, লিরিকের মধ্যে শ্রোতাদের জন্য চিন্তার খোরাক দিতে। ‘শহীদ সরণি’র লিরিকের জন্য ব্যান্ডটি আশ্রয় নিয়েছে জাতীয় পত্রিকার খোলা কলামের, ‘অনিকেত প্রান্তর’ গান হওয়ার আগে ছিল আর্টসেলের গীতিকার রুম্মানের ১৬ পৃষ্ঠার একটি লেখা। এ জন্যই প্রায় ১৬ বছর অ্যালবাম বের না করেও হারিয়ে যায়নি আর্টসেল, টিকে ছিল সগৌরব।
তবে তৃতীয় অ্যালবাম নিয়ে একটা আক্ষেপ ছিলই শ্রোতাদের। সবার ভালোবাসায় ধীরে ধীরে জটিলতা কাটিয়ে উঠেছে আর্টসেল। কয়েক বছর আগে ব্যান্ডটিতে গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন কাজী ফয়সাল আহমেদ। দীর্ঘদিন পর পুরো লাইনআপ পেয়ে আর দেরি করেনি ব্যান্ডটি, কাজ শুরু হয় নতুন অ্যালবামের। তারই সুবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি আর্টসেল ‘গান’ অ্যাপে প্রকাশ করে নিজেদের তৃতীয় অ্যালবাম ‘অতৃতীয়।’ ৯ মার্চ থেকে গানটি বিশ্বব্যাপী শোনা যাচ্ছে ইউটিউব, স্পটিফাইসহ সব মিউজিক প্ল্যাটফর্মে।