যার হাত ধরে শুরু মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স
স্ট্যান লি-জ্যাক কার্বি জুটি যদি হন মার্ভেল কমিকসের স্থপতি, তবে সন্দেহাতীতভাবেই মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের স্থপতি হবেন কেভিন ফাইগি। আয়রন ম্যান থেকে শুরু করে দ্য মার্ভেলস; মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সকে প্রতিটি পদক্ষেপে বটবৃক্ষের মতো আগলে রেখেছেন যে লোকটা, তাঁর নাম কেভিন ফাইগি। ইউনিভার্সের প্রতিটি আইডিয়া, প্রতিটি গল্প, প্রতিটি চরিত্র দর্শকের সামনে আসে তাঁরই নেতৃত্বে।
কমিকসের পাতা থেকে বড় পর্দার চরিত্রগুলোর রূপান্তর যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবে ততটা সহজ নয়। ষাট-সত্তরের দশকে রচিত কমিকস পর্দায় তুলে আনা শুধু কষ্টকর নয়, দুঃসাধ্য ব্যাপারও বটে। ষাটের দশকে যে কমিকসের গল্প তৎকালীন সমাজের জন্য সমসাময়িক ছিল, আধুনিক সময়ে হয়তো তার কোনো ভিত্তিই নেই। অনেক বিখ্যাত পরিচালকও বই কিংবা কমিকসের গল্প বড় পর্দায় তুলে আনতে হিমশিম খেয়েছেন। বিখ্যাত বইও নিমেষেই মুছে গেছে মানুষের মন থেকে। ফাইগির মূল কৃতিত্ব এখানেই। মার্ভেলের সেরা কমিকস, সেরা স্টোরিলাইন স্পর্শ না করেই পুরো পৃথিবীকে আকৃষ্ট করতে পেরেছেন তিনি।
অথচ ছোটবেলায় কাগজের কমিকসের খুব একটা ভক্ত ছিলেন না ফাইগি। বরং তাঁর টান ছিল বড় পর্দার প্রতি। মুভি তৈরির নেশা তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কলেজ পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অব সিনেম্যাটিক আর্টসে। মুভির পর্দায় যাঁদের কাজ দেখে বড় হয়েছেন; সেই জর্জ লুকাস, রন হাওয়ার্ডরা পড়াশোনা করে গেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরপর পাঁচবার ব্যর্থ হওয়ার পর ষষ্ঠবারের চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ফাইগি। বড় কিছু করার স্বপ্ন সেখান থেকেই।
প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে হলিউডে প্রবেশ করেছিলেন ফাইগি। পরিচালকদের পানি এনে দেওয়া, ক্যামেরা সেট করা, গাড়ি পার্ক করাই ছিল তাঁর কাজ। সেখান থেকে তাঁর প্রথম বড় সুযোগটা আসে ২০০০ সালে এক্স-মেন মুভিতে। মার্ভেলের কাছ থেকে স্বত্ব কিনে মিউট্যান্টদের নিয়ে প্রথমবারের মতো লাইভ-অ্যাকশন মুভির প্রস্তুতি নিচ্ছিল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফক্স। কমিকসের বড় ভক্ত না হলেও কমিক বুক সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ছিল না ফাইগির। মার্ভেলের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বেশ ভালোই জানতেন। মার্ভেলজ্ঞান দেখে তাঁকে মুভির সহযোগী প্রযোজক হিসেবে যুক্ত করেন লরেন শুলার। উলভারিনের বিখ্যাত হেয়ারস্টাইলের আইডিয়াও এসেছে ফাইগির মাথা থেকেই।
এক্স-মেন-এর সাফল্য রাতারাতি বদলে দেয় কেভিন ফাইগির ভাগ্য। পরের প্রতিটি মার্ভেল প্রজেক্টে ডাক আসতে থাকে তাঁর। স্যাম রাইমির স্পাইডার-ম্যান, অ্যাং লির হাল্ক, এক্স-মেন-এর সিকুয়েল কিংবা ফ্যান্টাস্টিক ফোর; মার্ভেলের প্রতিটি প্রজেক্টেই পরামর্শদাতা হিসেবে ডাক পান তিনি। প্রোডাকশন হাউজ যতই ভিন্ন হোক না কেন, মার্ভেলের মুভি তৈরি হলেই ডাক পড়ত ফাইগির।
অবশেষে ২০০৫ সালে এসে মার্ভেল ঠিক করে, অন্য প্রোডাকশন হাউজের কাছে স্বত্ব বিক্রি কিংবা তাদের সঙ্গে চুক্তি করে নয়, বরং নিজেদের চরিত্র নিয়ে নিজেরাই তৈরি করবে মুভি। স্পাইডার-ম্যান, এক্স-মেন, ফ্যান্টাস্টিক ফোরের মতো প্রথম সারির চরিত্রদের বিক্রি করে মার্ভেলের শেষ ভরসা ছিল দ্বিতীয় সারির তারকারা। আর এই দ্বিতীয় সারির সুপারহিরোদের নিয়ে তৈরি করা ইউনিভার্স সামলাতে প্রয়োজন ছিল একজন দক্ষ নাবিকের। সেই নাবিক আর কেউ নন—কেভিন ফাইগি।
মার্ভেল স্টুডিওজের দায়িত্ব নেওয়ার পর কেভিন ফাইগির সামনে দায়িত্ব ছিল দুটি। এক. যত দ্রুত সম্ভব মুভি মুক্তি দেওয়া। দুই. বক্স অফিসে হিট মুভি মুক্তি দেওয়া। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি ব্যাপার খুব ভালোভাবেই রপ্ত করতে পেরেছিলেন ফাইগি। কমিক বুকের পাতা থেকে তুলে আনলেই যে সুপারহিরো মুভি রাতারাতি হিট হয়ে যাবে, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং চরিত্রকে বাস্তবের সঙ্গে যতটা সংযুক্ত করা যাবে, দর্শক তত বেশি আকর্ষিত হবে। আর সুপারহিরো কিংবা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্ররা যত বেশি পর্দায় উপস্থিত হবেন, তত বেশি দর্শকদের আগ্রহ টিকে থাকবে। এক্স-মেন সিরিজ থেকে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছিলেন, পছন্দের চরিত্রকে বড় পর্দায় দেখতে কতটা ব্যাকুল হয়ে থাকেন দর্শকেরা। ২০০৮ সালের আয়রন ম্যান মুভি দিয়ে চেকলিস্টের প্রতিটি বিষয়েই টিকচিহ্ন দিতে পেরেছিলেন ফাইগি। রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের অভিনয় আর জন ফ্যাভরোর পরিচালনায় মার্ভেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বপ্নের মতো। প্রথম মুভিতেই সুপারহিরো ইউনিভার্স তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা সত্যিতে পরিণত হয়েছে বছর চারেক পরেই।
কেভিন ফাইগির ব্যাপারে অবশ্য অভিযোগ কম নেই। পরিচালকদের স্বাধীনভাবে গল্প বলার স্বাধীনতা দেন না, গল্পে হস্তক্ষেপ করেন। এমনকি গল্পে নির্দিষ্ট প্লট পয়েন্ট স্পর্শ করতে হবে, এমন শর্তও জুড়ে দেন। স্বাধীন পরিচালকদের জন্য শর্তগুলো হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়ার মতো হলেও ইউনিভার্স তৈরির জন্য এটা খুব প্রয়োজন। তাই বলে যে তরুণ পরিচালকেরা তাঁর অধীন নিজেদের মেলে ধরতে পারেন না, তা কিন্তু নয়। জেমস গান, টাাইকা ওয়াইটিটি, জন ওয়াটস, রায়ান কুগলারের মতো তরুণ পরিচালকেরা নিজেদের মেলে ধরেছেন ফাইগির অধীনেই। অ্যাভেঞ্জার্স তৈরির আগে কজনই–বা চিনত রুসো ব্রাদার্সদের?
২০২০ সালে ডিজনি প্লাসের আগমনের পর থেকে ফাইগি ডালপালা মেলেছেন ছোট পর্দাতেও। যদিও এর আগে ২০১৪ সালে কথা উঠেছিল মার্ভেল টেলিভিশনের সঙ্গে মার্ভেল স্টুডিওজকে এক করে ফেলার। এজেন্ট কার্টার, এজেন্টস অব শিল্ড-এর মতো কয়েকটি টিভি সিরিজও তৈরি হয়েছিল সে সময়। কিন্তু সে সময় ফাইগির ইচ্ছা ছিল মার্ভেলের ডালপালা বড় পর্দাতেই সীমাবদ্ধ থাকুক। যে কারণে সে সময় কোম্পানির নেতৃবৃন্দের তোপের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবে বক্স অফিসের সাফল্য দিয়ে বরাবরই তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফাইগিও নিজের পদচারণা শুরু করেছেন ছোট পর্দায়। বেশ কয়েকটি সিরিজ দিয়ে মার্ভেলের যাত্রা শুরু হয়েছে ডিজনি প্লাসে।
তবে এত সব কনটেন্টের ভিড়ে ফাইগিও যেন কিছুটা নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছেন। শুরুতে যেভাবে প্রতিটি কনটেন্টকে আতশি কাচের নিচে ফেলে দেখতেন, হাজারো কনটেন্টের ভিড়ে সেটা অনেকটাই কমে এসেছে। দর্শক–সন্তুষ্টিও কমে আসছে ক্রমাগত। কিন্তু ফাইগি এ নিয়ে চিন্তিত নন, মার্ভেলকে শূন্য থেকে শিখরে তুলতে পেরেছেন যিনি, তিনি ধরেও রাখতে পারবেন। মুভিপ্রেমী হিসেবে এর চেয়ে বড় খুশির সংবাদ কীই–বা হতে পারে?