বাসার সবচেয়ে ছোট সদস্য আলিনা। বয়স মাত্র ৬। এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে বেড়ায় সারা দিন। আর যেকোনো গান কানে এলেই সেই গানের সঙ্গে একা একা কণ্ঠ মেলায় সে। বাসার বাকিরা খেয়াল না করলেও বাবা সাইফ শরিফ একদিন মনোযোগ দিয়ে আলিনার কণ্ঠ শুনে টের পেলেন, না শিখেই খুব সুন্দর হারমোনাইজ করছে। পরিবারের বাকি তিনজনকে ডেকে ব্যাপারটা জানালেন তিনি। আলিনার মা ইশরা, বড় বোন ঈদ ও মেজ বোন সারওয়া যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল। সেদিনই যাত্রা শুরু করল ফ্যামিলি ব্যান্ড ‘এসেইস’।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা এটা। এসেইস ব্যান্ডের শুরুর দিনের গল্পটা এমন হলেও স্বপ্নটা অনেক আগেই দেখেছিলেন সাইফ-ইশরা দম্পতি। এক আড্ডায় সেই গল্প জানতে চেয়েছিলাম তাঁদের কাছে। সাইফ-ইশরা শোনালেন তাঁদের গল্প।
শুরুর গল্প
সাইফের বেড়ে ওঠা ঢাকার পুরানা পল্টনে। ছোটবেলায় সারা দিন শুধু পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ক্লাস নাইনে ওঠার পর হঠাৎ মিউজিকের প্রতি আগ্রহ জন্মাল তাঁর। সাইফের বাবা বিদেশে গেলেন। মিউজিকে ছেলের আগ্রহ দেখে বিদেশ থেকে নিয়ে এলেন বিশাল এক কি–বোর্ড। কি–বোর্ড আর গান শেখায় পুরোপুরি মজে গেলেন সাইফ। বুয়েটে ঢোকার পর শুরু হলো সাইফের ব্যান্ড মিউজিক জার্নি।
বুয়েটে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে ব্যান্ড তৈরি করেছিলেন সাইফ। গ্র্যাজুয়েশনের পর সেই ব্যান্ড আর টেকেনি। ব্যান্ডের সবাই ছিলেন খুব ভালো ছাত্র, একে একে সবাই বিদেশে চলে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ব্যান্ড ভাঙার দুঃখ থেকেই পারিবারিক ব্যান্ডের স্বপ্ন দেখা। তত দিনে ইশরার সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন সাইফ। ইশরা তখন পড়াশোনা করছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। বুয়েট ও মেডিকেলের পাট চুকিয়ে ২০০৭ সালে দুজন মিলে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। সংসার বাঁধেন সিডনিতে।
অস্ট্রেলিয়া গিয়েও গান ছাড়েননি সাইফ। সুযোগ পেলেই কয়েকজন বাংলাদেশি মিউজিশিয়ানের সঙ্গে গান করতেন বিভিন্ন জায়গায়। সব জায়গায়ই সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন ইশরা। সাইফের প্র্যাকটিস বা শোতে ড্রামারকে বলে বলে ড্রামসের কিছু বিষয় জেনে নিতেন ইশরা। সাইফ খেয়াল করলেন, ড্রামসে খুব আগ্রহ ইশরার। সাইফের হাত ধরে শুরু হলো ইশরার ড্রামস শেখা। খুব দ্রুত ড্রামস বাজানো শিখে ফেললেন। একসময় অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মিউজিক শোতে বাজানো শুরু করলেন এই দম্পতি। কি–বোর্ডে সাইফ আর ড্রামসে ইশরা, ব্যান্ডের বাকিরা তখনো পরিবারের বাইরের লোকজন।
মানুষের কাছে জীবন ও জীবিকা প্রায় এক। তবে আমি মনে করি, জীবন মানে জীবিকা না। আমার কাছে দুটি একদমই আলাদা। জীবিকার জন্য আমি বেছে নিয়েছি করপোরেট জীবন আর বেঁচে থাকার জন্য আমি বেছে নিয়েছি পরিবার ও গানের জীবন।সাইফ শরিফ, এসেইস ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা
২০১৭ সাল। অস্ট্রেলিয়ায় অনেকটা বছর পার করে ফেলেছেন তাঁরা। মাঝখানে দেশে এলেও আবার ফিরে গেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তবে সিডনিতে না, কর্মস্থলের সূত্রে তাঁরা তখন গোলকোস্টে। তত দিনে কোলজুড়ে এসেছে তিন কন্যা। বড় মেয়ে ঈদের বয়স যখন ৯, মেজ মেয়ে সারওয়া তখন মাত্র ৬ বছরে পা দিয়েছে। বাবা–মায়ের গানের প্রতি দুজনের খুব আগ্রহ। দুই মেয়েকে গিটার ক্লাসে ভর্তি করে দিলেন সাইফ।
পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার এক শোতে পারফর্ম করার সুযোগ পেলেন সাইফ, ইশরা ও তাঁদের দল। সব প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে গিটারিস্ট জানালেন, ব্যক্তিগত কারণে শোতে থাকতে পারবেন না তিনি। আকাশ ভেঙে পড়ল সাইফের মাথায়। ঈদ ও সারওয়া তখনো গিটার শিখছে। ভেবেচিন্তে বড় মেয়ে ঈদকে সে শোতে গিটার বাজাতে অনুরোধ করলেন সাইফ। প্রথমে একটু ভয় পেলেও বাবার অনুরোধে রাজি হয়ে গেল ঈদ। ১০ বছর বয়সী ঈদ ফাটিয়ে দিল প্রথম শোতেই। পেল সবার প্রশংসা। সেদিনের পর থেকে মা-বাবা ও বড় মেয়ে, তিনজন মিলেই শুরু হলো নতুন যাত্রা। মাঝেমধ্যেই শো করতেন তিনজন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এসেইস ব্যান্ডের যাত্রা তখনো শুরু হয়নি।
করোনাকালের ঠিক শুরুর দিকে মা–বাবা ও ঈদের সঙ্গে যোগ দেয় মেজ মেয়ে সারওয়া। পুরো পৃথিবী তখন ঘরবন্দী। ঘরে বসেই চারজন মিলে প্র্যাকটিস করে। সে সময়ই ছোট্ট আলিনার হারমোনাইজের প্রতিভা আবিষ্কার করেন সাইফ। ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় ব্যান্ডের নাম ঠিক করে ফেলল সবাই মিলে। পাঁচজনের নামের আদ্যক্ষর সাজিয়ে ব্যান্ডের নাম দেওয়া হলো ‘এসেইস’(ASEIS)। আলিনার এ (A), সারওয়ার এস (S), ঈদের ই (E), ইশরার আই (I) ও সাইফের এস (S)—সবটা মিলেই এসেইস।
করোনাকালে সব থমকে যাওয়ায় চার মাস আগে বাংলাদেশে ফিরেছে পুরো পরিবার। সাইফ-ইশরা আর অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চান না। বাচ্চারাও চাচ্ছে পরিবারের সঙ্গে দেশেই থাকতে সামনের দিনগুলো। অস্ট্রেলিয়ায় সব ফেলে এলেও প্রায় ২০০ কেজি মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট সঙ্গে করে দেশে এসেছে ‘এসেইস’ পরিবার।
দেশে ফিরে যেন গানের প্রতি অন্য রকম স্পৃহা খুঁজে পেয়েছে পুরো পরিবার। খিলক্ষেতের বাসার স্টুডিওতে প্রতিদিন চলছে প্র্যাকটিস। এসেইসের ফেসবুক পেজে প্রায়ই প্র্যাকটিস সেশনের বিভিন্ন ভিডিও দেখা যায়। প্রশংসাও কুড়িয়েছে সেসব ভিডিও।
তিন বোন ও ‘ভাইয়া’
ব্যান্ডের ভোকাল ঈদ ই সাইফ পড়ছে ক্লাস সেভেনে। গিটারিস্ট সারওয়া বিনতে সাইফ পড়ছে ক্লাস ফাইভে। দুজনেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্রিজবেন স্কুল অব ডিসটেন্স এডুকেশন। বাড়িতে বসেই চলে তাদের ক্লাস ও পড়াশোনা। ব্যান্ডের ভোকাল হারমনি ছোট্ট আলিনা বিনতে সাইফ এখনো স্কুলে না গেলেও বাবা–মায়ের সঙ্গে বাড়িতেই পড়াশোনা করছে। সাইফ ও ইশরাও ফিরেছেন পড়াশোনায়। উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন দুজনই।
সাইফ নিজেকে ব্যান্ডের লিডার দাবি করলেও লিডারের দায়িত্ব আসলে পালন করে এসেইসের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য আলিনা। সব দিকে নজর রাখতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া লেগে যায় বড় বোন ঈদের সঙ্গে। আলিনা কখনো কখনো গানের মধ্যেই বলে ফেলে, ‘ঈদ তোমারটা হচ্ছে না। এভাবে গাচ্ছ কেন?’ ঈদ রেগে যাওয়ার আগেই সারওয়া এসে থামায় দুজনকে।
দেশে ফেরার পর এই পরিবারে যুক্ত হয়েছে নতুন এক সদস্য। চার মাস বয়সী কুকুর, যার নাম ‘ভাইয়া’। ঈদ, সারওয়া ও আলিনার কোনো ভাই নেই বলে এই নাম দেওয়া। খুব অল্প সময়েই ভাইয়াকে সবাই আপন করে নিয়েছে। পরিবারের একটা অংশ হয়ে গেছে কুকুরটি। প্র্যাকটিস থেকে শুরু করে সারাক্ষণ বাচ্চাদের সঙ্গেই থাকে ভাইয়া।
তিন কন্যার প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজ। মেটালিকাও আছে পছন্দের তালিকায়। এসেইস পরিবারের সবাই একটু লাউড আর আপবিটের গান শুনতে বেশি পছন্দ করে। সেটারই প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় তাদের গানের ভিডিওগুলোতে।
গান নিয়ে ভবিষ্যতে কী করতে চায় তিন কন্যা? এমন প্রশ্নের জবাবের আলিনা জানায়, কি–বোর্ডটা খুব ভালোভাবে শিখে ফেলতে চায় সে। অন্যদিকে সারওয়ার প্ল্যান দারুণ সব সলো তৈরি করা। মিউজিককেই ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায় ঈদ। ঈদ, সারওয়া ও আলিনা—তিনজনই চায় গান নিয়ে পড়াশোনা করতে, গান নিয়ে এগিয়ে যেতে। বাবার চাওয়া, ওরা যেন ওদের মনের কথা শোনে। ওদের যেটা করতে ইচ্ছা হয়, সেটাই করবে।
নিজেদের গান
ব্যান্ড শুরুর মাত্র এক বছরেই নিজেদের একটি গান তৈরি করে ফেলেছে এসেইস। মা এবং তিন মেয়ে মিলে বাবার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে তৈরি করেছিল গানটি। পরবর্তী সময়ে মূল কথার কয়েকটি শব্দ পাল্টে রেকর্ড করা হয় গানটি। ‘জন্মদিন’ নামের এই গান প্রকাশ পেয়েছে এসেইসের ফেসবুক পেজে।
গানটির লাইভ পারফরম্যান্স ভিডিও দেখে নাও এখানে:
এসেইসের চারটি মৌলিক গানের কাজ চলছে। খুব দ্রুতই আসছে প্রথম অ্যালবাম।
মাত্র এক বছরের মধ্যেই এতটা এগিয়ে গেছে ফ্যামিলি ব্যান্ড এসেইস। দিন দিন যে তারা কতটা এগিয়ে যাবে, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই। তাই আড্ডার শেষপর্যায়ে সাইফকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গান যেহেতু আপনার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তবে গান ও এই ব্যান্ডকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন না কেন?’ সাইফের উত্তর, ‘মানুষের কাছে জীবন ও জীবিকা প্রায় এক। তবে আমি মনে করি, জীবন মানে জীবিকা না। আমার কাছে দুটি একদমই আলাদা। জীবিকার জন্য আমি বেছে নিয়েছি করপোরেট জীবন আর বেঁচে থাকার জন্য আমি বেছে নিয়েছি পরিবার ও গানের জীবন।’
এসেইস ব্যান্ডের আরও গান শুনতে পারবে তাদের ইউটিউব চ্যানেলে।