শঙ্কু-ফেলুদা না, তারিণীখুড়োও না, আরও একজন

সত্যজিৎ রায়

ফেলুদা, শঙ্কু আর তাড়িণীখুড়োর পাশাপাশি আরেকটা চরিত্র তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। নিশ্চিত, তোমরা তার নাম জানো না। জানবে কী করে, স্রষ্টা নিজেই তো তার কোনো নাম দেননি। তার বিচরণক্ষেত্রও ছিল আলাদা। অন্য তিনজনের গল্পগুলো বলা হয়েছে কথা আর শব্দে, আর ইনারটা রেখা আর ছবিতে। হ্যাঁ ‘বাটুল দ্য গ্রেট’, হাবলুর মতো একটা কমিক চরিত্র তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। তবে খুব বেশি না, তাকে নিয়ে চারটা মাত্র কমিকস্ট্রিপ এঁকেছিলেন তিনি।

এই কমিক স্ট্রিপের নেপথ্য গল্পটা বলি শোনো। ছাপার খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১৯৭০ সালে মাসিক থেকে দ্বিমাসিক হয়ে যায় সন্দেশ, পাতাও কমে যায়। তবে সব খারাপেরই কিছু ভালো দিক থাকে, এ ক্ষেত্রেও-বা হবে না কেন? ম্যাগাজিনের কাগজের আকার বেড়ে যায়। প্রচ্ছদেও বেশি জায়গা পাওয়া যায়। এই জায়গাকেই কাজে লাগানোর কথা ভাবলেন সত্যজিৎ। আর তার থেকেই জন্ম নিল কমিকস্ট্রিপের আইডিয়া।

অনেক আগে থেকেই অবশ্য কমিকস্ট্রিপের ভক্ত সত্যজিৎ। তোমরা শুনে হয়তো অবাক হবে, আমাদের এখানে ‘টিনটিন’-এর প্রথম দিককার ভক্তদের একজন ছিলেন সত্যজিৎ। একাধিক ফেলুদাকাহিনিতে তোপশেকে ‘টিনটিন’ পড়তে দেখা গেছে এমন এক সময়ে, যখন ‘টিনটিন’-এর নামই শোনেনি আমবাঙালি। মনে রেখো, আমি ষাট দশকের কথা বলছি, আজকের মোবাইল, ইন্টারনেট কিছুই তখন ছিল না। শুধু ‘টিনটিন’ না, সব ধরনের কমিকসেরই ভক্ত ছিলেন সত্যজিৎ। সন্দেশ–এই তো বের হয়েছে অনেক ধরনের বিদেশি কমিকস্ট্রিপ, যেগুলোর অধিকাংশের বাংলা লেটারিংও সত্যজিতের করা।

এহেন কমিকসভক্ত এই মাধ্যমে কাজ করবেন না, তা কি হয়! দ্বিমাসিক সন্দেশ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হলো অবশ্য দীপক চক্রবর্তীর কমিকস। পরের সংখ্যা থেকেই কলম ধরলেন সত্যজিৎ, এঁকে ফেললেন জীবনের প্রথম কমিকস।

সত্যজিতের কমিকসের অনামা কেন্দ্রীয় চরিত্রটি, যাকে বলে ছাপোষা বাঙালিবাবু, ঠিক তা-ই। কোঁচা করে পরা ধুতি, হাতের ছড়ি আর চুলের ভাঁজে তার বাঙালিয়ানা স্পষ্ট। চার পর্বের একটাতেও কোনো সংলাপ নেই, নেই কোনো বর্ণনাত্মক বাবলও, যা কিছু বলার সব ছবি দিয়েই বলেছেন সত্যজিৎ। নিজেই তো এই মাধ্যমটার বাংলা নাম দিয়েছিলেন ‘ছবিতে গল্প’, এগুলো তাঁর সেই নামটাকেই সার্থক করে তুলেছে। আর ধ্রুপদি ছোটগল্পের মতোই প্রতিটা পর্বের শেষ ছবিতে আছে একটা চমক।

স্ট্রিপগুলোয় আরও অনেক সূক্ষ্ম মজার কাজ আছে, যেমন একটার প্রতি বিশেষভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রখ্যাত ইলাস্ট্রেটর দেবাশীষ দেব। বড় সাইজের সন্দেশকে ঋতু অনুযায়ী ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। সত্যজিৎও তাঁর চারখানা স্ট্রিপের কাহিনিকে ঠিক ওই ঋতুগুলোতেই ঘটিয়েছেন।

যেমন প্রথমটা ছাপা হয় বর্ষা সংখ্যায়, গল্পের কেন্দ্রেও ছিল তুমুল বৃষ্টি। পরেই ছিল শারদীয় সংখ্যা, শরতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পূজার বাজি, সত্যজিতের দ্বিতীয় স্ট্রিপটার বিষয়ও ছিল বাজি। তৃতীয়টি ছিল হেমন্ত সংখ্যা, অর্থাৎ নভেম্বর আর ডিসেম্বর, পরীক্ষা শেষের নির্ভেজাল ছুটির কাল, এই সংখ্যাতেই ঘটে চিড়িয়াখানা যাওয়ার ঘটনা। শেষ স্ট্রিপটা বেরোয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। কলকাতায় এই সময় সার্কাসের আসর বসে—এই পর্বেই জানা গেল আমাদের নায়কটি আসলে ভারত সার্কাসের একজন ট্রাপিজ। তত দিনে আমরা আরও জেনে গেছি, তার তিনটি ছেলেমেয়ে।

বড় সাইজের সন্দেশ আরও তিন বছর চললেও এই চার পর্ব করার পরে কেন যেন আর সিরিজটি করেননি সত্যজিৎ রায়। হতে পারে ছোটদের বোঝার জন্য হয়তো বিষয়গুলো একটু বেশি ভারী হয়ে যাচ্ছিল। তবে কাজটা চালিয়ে গেলে বাংলা কমিক সাহিত্য স্মরণীয় একটা চরিত্র পেত। আফসোস করে আর কী হবে, যে চারটা করে গেছেন, সেগুলোই বরং দেখো।

ঋণ স্বীকার: দেবাশীষ দেবের রং তুলির সত্যজিৎ