সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যকে আমি কি ঠিকভাবে চিনতাম? তোমরা হয়তো তাকে চিনতে। ও ছিল তোমাদের মতো। তোমাদের মতোই সে কিশোর আলো পড়ত, কিশোর আলোর মাসিক সভাগুলোতে আসত। এরপর কীভাবে কীভাবে যেন একদিন কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবকও হয়ে উঠল মেয়েটি।
প্রথম আলো কার্যালয়ের সপ্তম তলায় কিশোর আলোর আড্ডাঘরেই ওকে প্রথম দেখেছিলাম মনে হয়। পাটকাঠির মতো লিকলিকে, নবম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি কিশোর আলোতে এসে শুধু মুখ গুঁজে বসে থাকত না, এর টেবিলে উঁকি দিত, ওর সঙ্গে গল্প করত। আরও তার ছিল বিচিত্র কীর্তিবৃত্তি! বিভিন্ন টেবিলে টেবিলে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই একদিন সারাহ এসে দাঁড়িয়েছিল আমার টেবিলে। তবে সত্যি বলতে, তখন এই ‘পিচ্চি’ মেয়েকে আমি সেভাবে পাত্তা দিইনি।
কিন্তু তোমরা তো ওকে প্রথম থেকেই পাত্তা দিতে, তাই না? তোমাদের সঙ্গে তার ভাব যে বেশি ছিল—এ তো নিজের চোখেই দেখেছি। তোমরা কি জানতে, তোমাদের এই বন্ধু, ২০ বছর বয়সী এই মেয়ে একদিন এমন কাজ করে ফেলবে, যা কখনো ‘বড়’রাও পারেনি।
এখন তো সবাই–ই জানে সারাহর কীর্তি সম্পর্কে। খুব ছোটবেলায়ই টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামের জটিল একটি রোগে আক্রান্ত হয় সে। এ রোগ হলে মানুষের শরীরে জন্ম নেয় অজস্র টিউমার, যা সারাহ আমৃত্যু বহন করেছে। ছিল তীব্র খিঁচুনি আর মাথাব্যথাও।
তোমাদের সঙ্গে দেখা হলেই ফুলের মতো ফুটে উঠত যে মেয়েটি, সে যে ১৯ বছর ধরে এমন একটা ভয়াবহ রোগ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা কি তোমরা বুঝতে পেরেছিলে? আমি অন্তত বুঝিনি।
১০ জানুয়ারি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সারাহর মস্তিষ্কের টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় বিএসএমএমইউর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। সেখানে তাকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে। রোগশয্যায় থেকেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যকে দান করার ইচ্ছা মা শবনম সুলতানাকে জানিয়েছিল সারাহ। পরে যখন তার মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটল (ব্রেন ডেথ), তখনো তার দেহের মৃত্যু ঘটেনি, সে সময় সারাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ওর দুটি কিডনি ও দুটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হলো চারজন ব্যক্তির দেহে। বাংলাদেশে সারাহ হলো প্রথম মানুষ, যে জীবিত থাকতেই তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যকে দিয়ে গেল।
যে সারাহ চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াত, আমাকে ‘ভাইয়া, ভাইয়া’ বলে ডাকত, সে এত মহৎ একটা ঘটনা ঘটাতে পারল! সারাহ তো সান্তা ক্লজ হতে চাইত। সান্তা ক্লজরা সবাইকে বিস্মিত করে তাদের হাসিখুশি মুখ দেখতে চায়। তোমাদের বন্ধু সারাহও অবশেষে তেমন কিছুই করল।
সারাহকে প্রথম কবে দেখেছিলাম, বলা কঠিন। তবে অনেক ছেলেমেয়ের ভেতরে এই মেয়ে ছিল একটু আলাদা। এ কারণেই বোধ হয় সে আমার নজরে এসেছিল। না, একটু ভুল হলো। সারাহকে চিনেছিলাম ওর আঁকা ছবি দেখে, সেটা আজ থেকে চার–পাঁচ বছর আগের কথা।
তোমাদের ‘গুড্ডুবুড়া’, কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হকের একটি ‘অদ্ভুত’ প্রতিকৃতি একদিন ভেসে উঠল আমার ফেসবুক পেজে। প্রতিকৃতির নিচে লেখা আছে আঁকিয়ের নাম—সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য। আনিস ভাইয়ের ছবি আরও অনেকেই এঁকেছেন, বড় বড় শিল্পীও এঁকেছেন। তবে সারাহর আঁকা ছবির বিশেষত্ব হলো, আনিসুল হকের প্রতিকৃতিটি আঁকলেও সে তাঁর চোখ আঁকেনি। তাতে কিন্তু চোখহীন আনিসুল হক, মানে তোমাদের গুড্ডুবুড়াকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না।
সারাহর আঁকা আনিসুল হকের ছবিটি দেখে সেদিন আমি বেশ মজাই পেয়েছিলাম। আর খানিকটা বোকা বনে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে এই এমন করেও কারও প্রতিকৃতি আঁকা যায়! এই রকমভাবে ছবি আঁকার কথা তো আগে মাথায়ই আসেনি। আসলে বড়দের মাথায় কত কিছুই যে আসে না!
বিষয়টা মাথায় ঢুকিয়ে দিল সেদিনের সেই ‘স্কুল গোয়িং’ মেয়ে। এর কিছুকাল বাদে একদিন দেখি, আমার অফিসের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাকে দেখে একটু মুচকি হাসি দিলাম। আর তাতেই আশকারা পেয়ে টেবিলের ওপরে থাকা আহমদ ছফার ওঙ্কার উপন্যাসটি উল্টেপাল্টে দেখতে থাকল সে।
আহমদ ছফাকে তোমরা চেনো তো? তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক। পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ নামে খুব সুন্দর একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস আছে তাঁর। এখানে তিনি লিখেছেন, গাছ, ফুল আর পাখির সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনের কথা। ইতিহাসের সত্যাসত্য নিয়ে অনেক প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন। মূলত বড়দের জন্যই লিখতেন। তো নবম শ্রেণিপড়ুয়া সারাহকে আহমদ ছফার বই নাড়াচাড়া করতে দেখে বেশ অবাকই হলাম। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারলাম, এই মেয়ে একটু অন্য রকম, আর দশজনের মতো নয়।
পরে সারাহর সঙ্গে আমার শুরু হলো টুকটাক কথাবার্তা। আসলে তখনো ওকে ‘ছোট’ ভেবেই কথা বলতে লাগলাম:
‘তোমার নাম কী?’
‘সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য।’
‘বাহ্! সুন্দর নাম তো, ঐশ্বর্য নামটি কে রেখেছেন?’
‘আমার আম্মু। আর সারাহ নামটা রেখেছেন আমার নানু।’
যেন সে জানতই এরপরই তাকে আমি জিজ্ঞাসা করব, সারাহ নামটি কার রাখা। তাই আগেভাগেই বলে দিল। এ সময়ই জানলাম, ওর নানা বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক সানাউল্লাহ নূরী। সোনার হরিণ চাই নামে ছোটদের জন্য খুব সুন্দর একটি বই লিখেছিলেন তিনি।
তবে সারাহকে ‘ছোট’ ভেবে আর বেশিক্ষণ কথা চালানো গেল না, ‘ছোট’ হয়েও সে যে বড়—এটি আমাকে একলহমায় বুঝিয়ে দিল মেয়েটি। দু–একটা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর উল্টো আমাকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল এবার, ‘আপনি জহির রায়হান পড়েছেন? বরফ গলা নদী আপনার কেমন লাগে?’
সেদিন সারাহর প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই। তবে বুঝেছিলাম, এই মেয়ে দারুণ পড়ুয়া।
‘তুমি’ থেকে খুব দ্রুতই সারাহকে ‘তুই’ বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। প্রথম আলো অফিসে কিশোর আলোর আড্ডায় এলেই সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াত। নানান বিষয়ে টুকরা টুকরা কথা হতো আমাদের, কোথা থেকে নতুন একটা গাছ এনেছে সে, চকলেটের বদলে গাছ নিয়ে সান্তা ক্লজ যদি কারও বাসায় হাজির হয়, তাহলে কেমন হবে—এসব আকাশ–পাতাল গল্প।
সারাহ যে সান্তা ক্লজ হতে চাইত, এখন তো তোমরা সেটি জানোই। হ্যাঁ, সান্তা ক্লজের মতোই সে সবাইকে চমকে দিতে ভালোবাসত। যেমন আমাকে একবার চমকে দিয়েছিল আমার প্রতিকৃতি এঁকে দিয়ে।
তখন ওর মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে হবে করছে। এমন সময় একদিন দেখি আমার টেবিলের সামনে ঘুরঘুর করছে। তাকে বললাম, ‘কী রে, তুই এখন এখানে কেন? লেখাপড়া কেমন চলছে?’
আমার অনেকগুলো প্রশ্নের কোনোই উত্তর না দিয়ে আচমকা আদেশ কলল মেয়েটি, ‘আপনার ফেসবুকের ইনবক্সটা চেক করেন তো ভাইয়া।’
অগত্যা ফেসবুক খুলে ইনবক্স হাতড়ে আমি অবাক, আমার ছবি এঁকে সেটি আমার ইনবক্সে দিয়ে রেখেছে সারাহ! আঁকা ছবিটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম—আমাকে হুবহু আঁকলেও আমার চোখ আঁকেনি সে, চোখহীন আমি, কিন্তু আমাকে ঠিকঠাকই চেনা যায়।
তাকে বললাম, ‘কারও ছবি আঁকলে তুই তার চোখ আঁকিস না কেন?’
‘এটাই আমার স্টাইল। আনিস স্যার (কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক) আমাকে বলেছেন, তুমি এভাবেই আঁকতে থাকো, এভাবে আঁকতে আঁকতেই তোমার একটা স্টাইল দাঁড়াবে।’—বড় মানুষের মতো বেশ ডাটের সঙ্গে কথাগুলো বলল সারাহ।
ওর আঁকা ছবির কিন্তু একটা ‘স্টাইল’ দাঁড়িয়েছিল। ওর রেখার টান, রঙের ব্যবহার—এসব দেখলেই বোঝা যেত এটা সারাহর ছবি। পরে দেখেছি, চোখসহও অনেক ছবি এঁকেছে সে। সেসব ছবিতেও আছে সারার নিজস্ব ‘ট্রেডমার্ক’।
করোনা মহামারির সময় ঘরবন্দী হয়ে পড়ল সবাই। একে অপরের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। সংগত কারণেই সারাহর সঙ্গে দেখা হয়নি দীর্ঘদিন। পরে যখন দেখা হলো, তখন সে হলি ক্রস কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। আগের মতো ঘন ঘন আর কিশোর আলোতে না এলেও আসে মাঝেমধ্যে—হুট করেই আসে, আবার হুট করেই চলে যায়।
শেষবার সারাহ প্রথম আলো অফিসে এসেছিল সম্ভবত গতবছর অক্টোবরে। ওকে দেখলাম, চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা মলিন। আমাকে দেখে শুকনো একটা হাসি দিল। বিনিময়ে আমিও হাসলাম। তবে ব্যস্ত থাকায় ওর সঙ্গে তখন আর কথা হয়নি।
সেদিন বুঝতেও পারিনি, ওর সঙ্গে আমার এটিই শেষ দেখা।
এরপর তো সারাহ ইতিহাস হয়ে গেল, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা হয়ে গেল। মরে গিয়েও সে মরেনি, বরং কিশোর আলোর সারাহ এখন বেঁচে আছে চিরকালের খাতায়।
সারাহ আঁকিয়ে হতে চেয়েছিল। সে জন্য উচ্চমাধ্যমিক পাস দিয়ে ভর্তি হয়েছিল ইউডাতে, চারুকলা বিভাগে। আঁকিয়ে সে এমনিতেই ছিল, আরও বড় আঁকিয়ে হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। তবে সারা নামের মেয়েটি যে তার চেয়েও আরও বড় কিছু হবে!
শেষমেশ তাই সারাহ যেন মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সান্তা ক্লজই হয়ে গেল। সান্তা ক্লজ হয়ে চকলেটের বদলে গাছ নিয়ে সবার বাড়ি বাড়ি যেতে চেয়েছিল সারাহ। বেঁচে থাকতেই নিজের কিডনি ও কর্নিয়া অন্যকে দান করে সে কি আসলে যথার্থ ‘সান্তা ক্লজ’ হয়ে ওঠেনি? সান্তা ক্লজের মতো মানুষকে চমকে দিয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটায়নি?
কোনো ভরা জ্যোৎস্নারাতে, গোটা আকাশ যখন তারায় তারায় মাখামাখি, হয়তো তখন সেই আকাশে তাকালে একটি তারাকে খুব চেনা মনে হবে তোমাদের—তারাটির নাম সারাহ, তোমাদের–আমাদের সারাহ।