অন্যান্য মাসের মতো ছিল না জানুয়ারি মাসের সভা। ২১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৮১তম কিআড্ডাটা ছিল বিশেষ। কারণ, সভাজুড়ে ছিল শোকের ছায়া, সভাজুড়ে ছিল ‘সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য’।
মৃত্যুর আগে সারাহ তাঁর সাহসিকতার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। দেশে প্রথমবারের মতো ‘ব্রেন ডেড’ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর দান করা কিডনি অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া সারাহর মধ্য দিয়ে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন গোটা চারেক মানুষ।
কিডনি প্রতিস্থাপনের এই অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান দুলাল। এবারের কিআড্ডার মূল অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি।
সভায় হাবিবুর রহমান সারাহর সঙ্গে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা সবার সামনে তুলে ধরেন, শোনান এক বীরের গল্প। ছয় মাস আগে বিএসএমএমইউতে সারাহর সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি ২০ বছর বয়সী ছোট্ট এই মেয়েটি এমন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেবেন। সারাহর ব্যাপারে আরও বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের মাধ্যমে আরও আটটি প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। প্রতিবছর অনেক রোগী বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে মারা যান। আমরা গত ৩০ বছর ধরে ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছি। সাধারণত রোগী কিংবা তাঁদের আত্মীয়স্বজনেরা রাজি হন না এ রকম ক্যাডাভারিক ট্রান্সপ্ল্যান্টের কথা শুনলে। কিন্তু সারাহর শেষ ইচ্ছেই ছিল নিজের সব অঙ্গ দান করা। তাঁর মা শবনম সুলতানা দৃঢ় মনে এককথায় রাজি হন মেয়ের ইচ্ছে পূরণে। সারাহর এমন সাহসিকতার কারণে আমরা এই যুদ্ধে সফল হতে পেরেছি। তাঁর নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সারাহকে হারিয়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যও যে আমরা তাঁর মতো একজন পেয়েছি, যাঁর হাত ধরে এগিয়ে যাবে এই সামাজিক আন্দোলন। সারাহ কেবল দিয়েই গেলেন আমাদের। আমরা এখন যা-ই করি, তাঁর জন্য সবই তুচ্ছ।’
হাবিবুর রহমান আরও জানান, সারাহকে স্মরণ করে ছয়টি উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্যোগগুলো হলো হাসপাতালটির ক্যাডাভেরিক সেলের নাম পরিবর্তন করে ‘সারাহ ইসলাম ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট সেল’ নামকরণ, সারাহর মা শবনম সুলতানাকে আজীবন বিনা মূল্যে চিকিৎসা প্রদান, বিএসএমএমইউর গুরুত্বপূর্ণ সব অনুষ্ঠানে শবনম সুলতানাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ, ‘সারাহ কর্নার’ ও নামফলক স্থাপন, পরবর্তী সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সারাহ ইসলামের নামে একটি পুরস্কার প্রদান এবং সরকার কর্তৃক মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার প্রদানের জন্য বিএসএমএমইউর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রস্তাব প্রদান।
সারাহর সঙ্গে কাজ করা নতুন-পুরোনো স্বেচ্ছাসেবকেরা জানান সারাহকে নিয়ে নানা স্মৃতি। সারাহর প্রথম কিআতে আসা, প্রথম কাজ করা, শেষদিনগুলো—সবই উঠে আসে তাঁদের কথায়।
সভার শেষ পর্যায়ে যুক্ত হন কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক। সভায় আসার আগে সারাহর কবর জিয়ারত শেষে সারাহর বাসায় যান তিনি। ঘুরে দেখেন সারাহর গুছানো পরিপাটি প্রিয় ঘর, পাতা উল্টে দেখেন সারাহর প্রিয় বইগুলো, ছুঁয়ে দেখেন সারাহর আঁকাগুলো। সেখানে এক কোণে পড়ে আছে তাঁর রংতুলি, অন্য দিকে প্রিয় অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছগুলো যেন অপেক্ষা করছে সারাহর বাড়ি ফেরার।
সারাহর মায়ের শক্তিকে সভায় উপস্থিত সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেন আনিসুল হক। তিনি সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্যের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার গল্প শোনান এবং সবাইকে সারাহর অনুপ্রেরণায় এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
কিশোর আলো পরিবারের সঙ্গে সারাহর কাটানো স্মৃতি নিয়ে তৈরি ভিডিও চিত্র দেখানোর মাধ্যমে শেষ হয় শোকাবহ এই কিআড্ডা। তখনো সভাকক্ষের স্ক্রিনে ভাসছে সারাহর হাসিমুখ, আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ীর।