আমাদের ছোটবেলায় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস ছিল আমময়। কাঁচামিঠা নামের এক প্রকারের আমের গাছ ছিল। সত্যি সত্যি কাঁচা অবস্থাতেই মিষ্টি ছিল সেই সব আম। পাড়ায় একটা কাঁচামিঠা আমের গাছ থাকা মানে ছোটরা সেই গাছে ঢিল ছুড়তেই থাকবে। শুধু কি কাঁচামিঠা আম, টক আমের গাছগুলোতেও চলত ঢিল ছোড়া। ছোটবেলায় আম কাটার জন্য চাকু বানাতাম আমরা। রেললাইনের পাশে যখন থাকতাম, তখন এক টুকরা লোহা নিয়ে রেখে দিতাম রেললাইনে। ট্রেন গেলে সেটা চ্যাপ্টা হয়ে চাকুর আকার নিত। চাকু বানানোর জন্য কামারের কাছেও যেতাম কখনো কখনো। কালবৈশাখী এলে সবাই আমগাছের নিচে ছুটতই। আমগাছের নিচে ঝড়ে ঝরে পড়া আম যে কুড়াতে পারবে, তার। গাছের মালিকের আপত্তি করার কিছু নেই। কাজেই আমাদের শৈশবে এই গানটা একদম সত্য ছিল:
ঝড় এলো এলো ঝড়
আম পড় আম পড়
কাঁচা আম ডাসা আম
টক আর মিষ্টি!
এই যা, এলো বুঝি বৃষ্টি।
আরেকটা ছড়া আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ছিল, জসীমউদ্দীনের লেখা:
ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের শাখায় উঠি
রঙিন করি মুখ।
তোমরা যারা বিভূতিভূষণের লেখা আম আঁটির ভেঁপু বা পথের পাঁচালী পড়েছ, কিংবা সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী দেখেছ, তারা জানো, অপু আর দুর্গা ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে যায়। এ ঘটনা আমাদের ছোটবেলায় খুবই সত্য ছিল। আমরা সবাই এটা করেছি। ঝড় এলেই ছুটে গেছি আমগাছতলায়।
আমাদের সময়ে গ্রীষ্মের ছুটিকে বলা হতো আম-কাঁঠালের ছুটি। গরমকালের ছুটিতে আমরা শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামে দাদার বাড়ি বা নানার বাড়ি চলে যেতাম। সবার আগে পাকত লিচু। এরপর আম। কত বিচিত্র যে ছিল তখনকার আম। এখন যেমন রাজশাহীর আম—ল্যাংড়া, হিমসাগর, ক্ষীরশাপাতি ইত্যাদির সুনাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের সময়ে গ্রামগুলোতে রাজত্ব করত দেশি আম। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একটা ছিল সিঁদুরে আমের গাছ, যার রং ছিল উজ্জ্বল হলুদ, বোঁটার দিকটা আবার টকটকে সিঁদুরের মতো লাল। এর বাইরে একেকটা গাছের একেকটা নাম ছিল, যেমন একটা আমের নাম ছিল মালদহের আম। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই পারে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ। সেখানকার বিখ্যাত আমের একটা কীভাবে যেন আমাদের গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চলে এসেছিল। নিশ্চয়ই আঁটি থেকে গাছ হয়েছিল। দারুণ ছিল সেই আমটা। জাম পাকত একটু দেরিতে। আমরা জামগাছের ডালে উঠে বসে থাকতাম। পাকা জামের দাগে ভয়াবহ রূপ পেত আমাদের শার্ট আর গেঞ্জি। এরপর পাকতে শুরু করত কাঁঠাল। আম-কাঁঠালের গন্ধে প্রতিটা বাড়ি ম–ম করত। বড় বড় নীল মাছি আসত সেই গন্ধের টানে।
আমের আঁটি দিয়ে আমরা ভেঁপু বানাতাম। আম খেয়ে আঁটিটা ছুড়ে মারলেই হলো। উঠানের এক কোণ ভাগাড়ে সেই আঁটি থেকে বর্ষাকালে চারা গজাত। সেই চারা তুলে ফেলে আঁটিটা নিয়ে গাছের গায়ে বা দেয়ালে ঘষতে হতো। ওপরের বাকলটা সরিয়ে ভেতরের সবুজ অংশটার একপাশ ঘষে ক্ষয় করলেই বানানো হয়ে গেল ভেঁপু।
কাঁঠালের বিচি ছিল তিন বেলার আহার। শুধু ভেজে বা পুড়িয়ে খাওয়া হচ্ছে। তরকারিতে ভাজি করে খাওয়া হচ্ছে। কাঁঠালের বিচি ভর্তা করা হচ্ছে। মাছের ঝোল মাংসের ঝোল সবকিছুর সঙ্গেই দেওয়া হচ্ছে কাঁঠালের বিচি। কত আর কাঁঠালের বিচি খাওয়া যায়!
এখন আমাদের কালের সেই সব দেশি আম রাজত্ব হারিয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে করে ভালো জাতের আমের চারা উৎপাদন করছেন। চাষিরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আমবাগান করছেন, লিচুবাগান করছেন। এখন সারা দেশেই বিখ্যাত আমগুলো পাওয়া যায়। ল্যাংড়া থেকে ফজলি আম, নতুন আবিষ্কার আম্রপালি কিংবা রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম। দিনাজপুরের বিখ্যাত আম ছিল সূর্যপুরী, এখনো আছে অবশ্য।
আমের ইতিহাস কিন্তু প্রাচীন। প্রায় ছয় হাজার বছর আগেও এই অঞ্চলে নাকি আম ছিল। আমের কথা আছে পুরাণে, আমের কথা আছে কালিদাসে, গৌতম বুদ্ধ আমবাগানের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, বৈশালীর আম্রপালি ছুটে এসেছিলেন তাঁর কাছে, আমের প্রশংসা করেছিলেন আলেকজান্ডার, বাদশাহ আকবর এক লাখ গাছের আমবাগান করেছিলেন—কথার তো শেষ নেই। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে আমের বনে ঘ্রাণে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা; আর বাংলার স্বাধীনতা পলাশীর আম্রকাননে অস্ত গিয়ে উদিত হয়েছিল মুজিবনগরে, মেহেরপুরের আমবাগানে।
মাহবুব সিদ্দিকীর লেখা বই আম-এ একটা চমৎকার রস-গল্প আছে। রসাল নামের ফলটি নিয়ে। ‘বীরবল শাহি ভোজ খাচ্ছেন। বাদশাহ আকবর বললেন, বীরবল, আরও খাও। বীরবল বললেন, মাফ করুন, পেটে আর এক কণাও জায়গা নেই। তারপর এল পাকা পাকা নধরকান্তি আম। বীরবল হাত বাড়ালেন। পেট বরাবর চালিয়ে দিলেন কয়েকটা আম। বাদশাহ বললেন, এ কী বীরবল! তুমি যে বললে পেটে কোনো জায়গাই নেই। বীরবল জবাব দিলেন, রাস্তায় ভিড়। কারও পা ফেলার জায়গা নেই। এ সময় আপনি যদি রাস্তায় যান, লোকেরা সরে যাবে। আপনার পথ ঠিকই হয়ে যাবে। তেমনই ফলের রাজা হলো আম। রাজা এসেছে, পেটে আর সব খাদ্য সরে গেছে। জায়গা হয়ে গেছে।’
রাজা-বাদশাহদের কথা থাকুক, আমার নিজের কাছে আম মানেই শৈশবের রঙিন দিনগুলোর সানন্দ প্রত্যাবর্তন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন—
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
আমের আচার থেকে আমসত্ত্ব, আম-ডাল থেকে ম্যাঙ্গো স্টিকি রাইস, আম দিয়ে দুধভাত থেকে ম্যাঙ্গো লাচ্ছি। আম-দুধ মিলে যায়, আঁটি যায় ভাগাড়ে। কখনো কখনো আমও যায়, ছালাও যায়।
আমাদের অর্থনীতিতে আমের স্থান অতি উচ্চ। বাংলাদেশের আমের বাজার নাকি ১৪ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশে সৃজনশীল বইয়ের বাজার ৪০০ কোটি টাকার মতো, তার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে, জ্ঞানের চেয়ে আম বড়!
আম নিয়ে পুরান ঢাকার কৌতুক দুটো বলে নিই।
১. ক্রেতা বললেন, কী মিয়া, তোমার আম সত্যিই ল্যাংড়া তো? বিক্রেতা বললেন, ছাহেব, এইটাও কওন লাগব, ল্যাংড়া না হইলে কি মাথায় কইরা ঝাঁকায় তুইলা আনতে হয়?
২. ক্রেতা বললেন, কী মিয়া, তোমার আম তো ছোট? বিক্রেতা বললেন, খালি আমার আমের বাইরের চেহারা দেখবেন? আমার আমের আঁটি বড়!
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, এই কৌতুকের বিলেতি রূপ হলো, ‘কী সাহেব, আপনি নাকি রোজ দেরি করে অফিস আসেন?’ ‘আপনি কি শুধু আমার আসাটা দেখবেন। যাওয়াটা দেখবেন না? আমি রোজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে যাই।’
আমাদের শিশুশিক্ষা শুরু হয় আম দিয়ে। ছোটবেলায় প্রথম শব্দ আমরা পড়ি আ আর ম। আম। আর আমাদের প্রথম ছবি আঁকতে হয় আমের। কখনো কখনো আমাদের জীবনের শেষ ইচ্ছা হয় আম খাওয়ার। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হবে। তিনি নিজে শেভ করে আম কেটে খেলেন। তারপর হেঁটে গেলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। শেরেবাংলা ফজলুল হক কত ডজন আম খেয়েছিলেন এক বৈঠকে, তা নিয়ে কথা এখনো শেষ হয়নি। ‘আমগাছ জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’ (মাহবুব সিদ্দিকী)
কাঁঠাল হলো আমাদের জাতীয় ফল। তবে একজন ক্রিকেটার কাঁঠাল নিয়েও একটা মজার কথা বলেছেন—যে দেশে জাতীয় ফল খেতে হাতে তেল মাখাতে হয়, সে দেশে তেলের ব্যবহার তো সব ক্ষেত্রেই দরকার হবে। কাঁঠাল নিয়ে আরেকটা কৌতুক প্রচলিত আছে।
একজন কাবুলিওয়ালা বাংলাদেশে এসে কাঁঠাল খেতে আরম্ভ করলেন। আঠা তার গোঁফে লেগে গেল। তিনি গোঁফ কেটে ফেলতে বাধ্য হলেন। এরপর একজনকে দেখলেন, তারও গোঁফ নেই। তখন তিনি আগন্তুককে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, তোম ভি কাঁঠাল খায়া হামভি কাঁঠাল খায়া। তুমিও কাঁঠাল খেয়েছ, তাই তোমার গোঁফ নেই, আমিও কাঁঠাল খেয়েছি, তাই আমার গোঁফ নেই।
কাঁঠাল নাকি এ দেশে এনেছে পর্তুগিজরা, লিচু এসেছে চীন থেকে। বাংলা কাঁঠাল শব্দটা এসেছে কাঁটা থেকে, আগে এটাকে কাঁটাল বলা হতো। জাম নাকি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচুচোর’ কবিতাটা ছোটবেলায় আমাদের আবৃত্তি করতে হতো। অনেকে আবৃত্তি করতে গিয়ে ‘পড়েছি সরাত জোরে’ বলে নিজেই পড়ে যেত। আমরা হেসে উঠতাম।
গ্রীষ্মের ফল হিসেবে আম, জাম, কাঁঠাল আর লিচুর খ্যাতিই বেশি। তবে পেয়ারা আনারস নানা ফলও তো দেখছি বাজারে ভরা।
গ্রীষ্মকালটা এলেই ফলে ভরা কাল। তবে ভালো আম আর কাঁঠাল পাওয়া যাবে বর্ষাকালেও। যা–ই হোক, ফল নিয়ে আর বেশি কথা না বলে বরং বলি, ফলের আশা না করেই কাজ করে যাও, তবে ভালো ফল পেলে খেতে ভুলো না।