ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা: এক কৃতী বিজ্ঞানীর কর্মময় জীবন
ইতিহাস বিবেচনায় ভারত বিভক্তির কথা আমাদের জানা আছে। সেই বিভক্তির সূচনা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। আজকের বাংলাদেশের তখনকার নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। তারও আগে আমাদের সেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল ভারতের বাংলার অংশবিশেষ। স্বাভাবিক নিয়মে এই বিভক্তির পর অনেক বাঙালি মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। সেই চলে আসার কাতারে সাধারণ মানুষ যেমন ছিল, তেমনি ছিল শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান-সংস্কৃতির অঙ্গনের কিছু গুণীজন এবং সৃজনশীল সংঘটকও, যাঁরা তদানীন্তন নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষার বিভিন্ন শাখার অগ্রযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন সেই সব অসাধারণ গুণীজনদের একজন। তাঁর সারসংক্ষেপ পরিচয় দিতে গেলে বলতে হয়, তিনি ছিলেন সত্য সন্ধানী ও সৃজনশীল বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, শিক্ষক, প্রশাসক, বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশক, বিজ্ঞান লেখক (বাংলায়) ও সংগঠক। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন কৃতিত্বের অসাধারণ স্বাক্ষর।
মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মাড়গ্রামে ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর এক পীর খান্দান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম সৈয়দা ফাসিয়া খাতুন। আর বাবা খোন্দকার আবদুল মুকিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হয়েও তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের চাকরি করতে রাজি হননি। কুদরাত-এ-খুদা কোরআনে হাফেজ হয়ে মাড়গ্রামের এমই হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং মেধাবী ছাত্র হিসেবে সেই স্কুলে দুবার ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলেন।
কুদরাত-এ-খুদা ১৯০৯-১০ সালে কলকাতায় যান এবং উডবার্ন এমই স্কুলে ভর্তি হন। সেখানকার শিক্ষার মাধ্যম ছিল উদুর্। তিনি কলকাতার মাদ্রাসা স্কুল থেকে ১৯১৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে রসায়নবিদ্যায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর সঙ্গে দ্বিতীয় স্থান পাওয়া ছাত্রের নম্বরের ব্যবধান ছিল ১০০। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এমন ব্যবধানের নজির খুব একটা দেখা যায় না। এ সফলতার জন্য তিনি স্বর্ণপদকও পেয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর রাষ্ট্রীয় বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান।
সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর পিএইচডি/ ডিএসসির সার্বিক পরিকল্পনা ও কাজ একা নিজেকে করতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাস করা একজন ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। একপর্যায়ে তাঁর প্রফেসর স্যার থরপ কুদরাত-এ-খুদার খোঁজ নিতে গিয়ে বিস্মিত হন এবং তিনি আনন্দের সঙ্গে জানান যে তাঁর যে পরিমাণ কাজ হয়েছে, তাতে তিনটি থিসিস হতে পারে। সেই সূত্রে তিনি তা-ই করেন। অর্থাৎ তাঁর কাজের এক-তৃতীয়াংশ জমা দিয়ে ১৯২৯ সালে রসায়নশাস্ত্রে ডিএসসি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
কিছুদিন বেকার থাকার পর কুদরাত-এ-খুদা প্রেসিডেন্সি কলেজে তখনকার সম্মানজনক প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারশিপ নিয়ে আড়াই বছর গবেষণা করেন।
কুদরাত-এ-খুদার মৌলিক গবেষণা প্রবন্ধ
লন্ডন জার্নাল অব কেমিক্যাল সোসাইটিতে ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম লেখা বের হয়। পরবর্তী সময়ে একই জার্নালে তাঁর আরও চারটি বিজ্ঞান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
রসায়নশাস্ত্রে তিনি ১৯৩০-১৯৪৭ (ভারত বিভক্তির আগে) সালের মধ্যে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে ১৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এ ছাড়া এ সময়ে ইংল্যান্ডের নেচার গবেষণা জার্নালেও তাঁর দুটি লেখা বের হয়। এই পত্রিকাটিতে আজও পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের প্রবন্ধ ছাপা হয়ে থাকে।
তাঁর সেই সময়কার ২০টির মতো রচনায় অনেক তথ্য আজও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানভান্ডার সম্পদ বলে বিবেচিত।
কুদরাত-এ-খুদার শিক্ষকতা জীবন
তিনি ১৯৩১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৩৬ সালে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পদোন্নতি পান। পরবর্তী সময়ে ১৯৪২-৪৪ সাল পর্যন্ত কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং সিনেট মেম্বার ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম
তিনি পূর্ব পাকিস্তানে (এখনকার বাংলাদেশ) এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান না করে প্রথমে সরকারের ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (ডিপিআই) পদ গ্রহণ করেন (১৯৪৭-৪৯)। সংগত কারণে তিনি নবগঠিত দেশটির সার্বিক শিক্ষাক্রম উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ও লেখায় শিক্ষা, বিশেষ করে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারের ওপর যে দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে, তা তিনি প্রকাশ করেছেন বিভিন্নভাবে। এ ছাড়া তিনি ১৯৫২-৫৫ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই সময়কার স্কুলপর্যায়ে উদুর্কে বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই আমলে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে সচেতন নাগরিক হিসেবে এর বিরোধিতায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। মাঝখানে ১৯৪৯ সালে কুদরাত-এ-খুদা পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
বিসিএসআইআর (PCSIR)-এর গবেষণা
কুদরাত-এ-খুদা ১৯৫৫ সালে তদানীন্তন পিসিএসআইআরের প্রথম পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁর ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি উন্নত মানের গবেষণাগার তৈরিতে মনোযোগ দেন। জৈব রাসায়নিক বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি প্রথম থেকে দেশের অগ্রগতির লক্ষ্য হিসেবে স্থানীয় অব্যবহৃত কাঁচামালের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেসবের মধ্যে গাছগাছালি, পাট, পাটকাঠি, কয়লা, খনিজ বস্ত্ত উল্লেখযোগ্য। ঔষধি গাছগাছালির মধ্যে তেলাকুচা, তুলসী, বিষকাঁঠালি, গুলন্ধ, কালমেঘ ইত্যাদির ওপর তিনি কাজ শুরু করেন। একমাত্র তেলাকুচা থেকেই তিনি ১২টি রাসায়নিক যৌগ পেয়েছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। এসব কাজের মাধ্যমে তিনি ১৮টি প্যাটেন্ট আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এর মধ্যে পাটকাঠি থেকে ‘পারটেক্স’ উদ্ভাবনকে তাঁর স্বীকৃত শ্রেষ্ঠ অবদান বলে ধরা হয়। আখ ও লালিগুড় থেকে ভিনেগার উৎপাদন, পাট ও পাটকাঠি থেকে ‘র্যাসন’ তৈরি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। বিসিএসআইআর থেকে তিনি ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
কুদরাত-এ-খুদা ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেও পাকিস্তানি প্রশাসকদের চক্রান্তে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কুদরাত-এ-খুদা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি এই নতুন রাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে লক্ষ রেখে যে রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, তা ‘কুদরাত-এ-খুদা কমিশন’ নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা আজও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রারম্ভিক মূল্যবান দলিল হিসেবে বিবেচিত।
মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা
ইংরেজি ভাষায় অনগ্রসর বাঙালি জাতির শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে যে বাংলা ভাষায় হওয়া উচিত তা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। শুধু যে বিশ্বাস করতেন তা-ই নয়, বরং এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের জন্য তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা ১৯৩৬ সালে তদানীন্তন সরকারের শিক্ষা সপ্তাহ উদ্যাপনের দায়িত্বে ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার সাঙ্গীকরণ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলেন। তাতে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন যে ‘মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া’ শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে না।
এই দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কুদরাত-এ-খুদা বাংলায় বেশ কতগুলো বই লিখেছিলেন। এর মধ্যে যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় স্থান পেয়েছিল। এ ছাড়া তিনি যেসব বই লিখেছেন তার মধ্যে ১. বিজ্ঞানের সরস কাহিনী ২. বিজ্ঞানের সূচনা ৩. জৈব রসায়ন (৪ খণ্ড) ৪. পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা ৫. পরমাণু পরিচিতি ৬. বিজ্ঞানের পহেলা কথা উল্লেখযোগ্য।
তিনি নিজের উদ্যোগে বিসিএসআইআর থেকে ১৯৬৩ ও ১৯৭২ সালে পুরোগামী বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রা নামে দুটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করেন।
কুদরাত-এ-খুদার বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অসাধারণ কর্মকাণ্ডের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘তামগা-ই-পাকিস্তান’ ও ‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৬ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৮৪ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করে।
ড. কুদরাত-এ-খুদা ১৯৭৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন অফুরন্ত জ্ঞানভান্ডার, যা আমাদের এক অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।