আমি কাশফিয়া জান্নাত, ডাকনাম প্রিয়ন্তী। আমার মা একজন সরকারি চাকরিজীবী। মায়ের অফিসের বদলির কারণে ছোটবেলা থেকেই নতুন নতুন পরিবেশে যেতে হয় আমাকে। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর আম্মুর বদলি হলো মিরপুরে। এখানকার মনিপুর স্কুলে ভর্তি হলাম আমি। নতুন একটা পরিবেশ, তার ওপর নতুন নতুন মানুষ। শুরুতে খুব একা একা লাগত আমার। হঠাৎ একদিন একটা মেয়ে এসে বন্ধুত্ব করতে চাইল আমার সঙ্গে। মেয়েটার নাম শাহরীন। আমিও ওর বন্ধুত্বের হাত ধরলাম। ধীরে ধীরে আরও অনেক বন্ধু হলো আমার। কিন্তু শাহরীনের মতো এত ঘনিষ্ঠ আমার সারা জীবনেও হয়নি কেউ। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট বলা যায় ওকে। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ও। সবচেয়ে সুন্দরও। মাথাভরতি ঘন কালো চুলে দারুণ লাগত ওকে। শাহরীন আর আমি একসময় এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম যে সবাই আমাদের যমজ বোন বলে ডাকা শুরু করল। প্রতিদিন টিফিনের সময় খাবার ভাগ করে খেতাম আমরা। কোনো কারণে আমার মন খারাপ থাকলে ওর সঙ্গে কথা বললেই মন ভালো হয় যেত। সব সময় খুব হাসত শাহরীন। কোথাও ঘুরতে গেলেও ওর সঙ্গেই যেতাম আমি। এভাবে হেসে-খেলেই কাটছিল দিন। তারপর অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উঠলাম আমরা। আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। আমি পেলাম ৪৫৭। কিন্তু সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে শাহরীন। এ প্লাস না পাওয়ায় কমার্স পড়তে হবে আমাকে। তখন একটা জেদ ধরে বসল শাহরীন— ‘প্রিয়ন্তী কমার্স পড়বে আর আমি পড়ব সায়েন্স, এটা হতেই পারে না।’ কোনোভাবেই বোঝানো গেল না ওকে। অনেক ঝগড়াঝাঁটি করে শেষমেশ কমার্সই নিল শাহরীন। আবার আমরা একসঙ্গে চলতে থাকলাম, ঠিক আগের মতো। একদিন শাহরীন ক্লাসে এল না। এমন করে দুই দিন, পাঁচ দিন হলো, ওর দেখা নেই। শাহরীনের নম্বরে প্রায় হাজার বার কল করলাম আমি। বারবার একই কথা, ‘এ মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ এভাবে ১০ দিন যাওয়ার পর আমি একাই ওর গেলাম ওর বাসায়। গিয়ে দেখি কেমন মরা বাড়ির মতো শান্ত ওর বাসাটা। কাঁদছে সবাই। আন্টির কাছ থেকে জানলাম, মরণব্যাধি লিউকোমিয়া হয়েছে শাহরীনের। বেশি হলে আর ২০ দিন বাঁচবে। হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি! কাঁদলাম অনেক। মেনে নিতে পারলাম না বিষয়টা। প্রতিদিন ওকে দেখতে যেতাম হাসপাতালে। কয়েকদিনের মধ্যেই অনেক রোগা হয়ে গেল শাহরীন। ওর এত সুন্দর চুলগুলো আস্তে আস্তে সব পড়ে যেতে শুরু করল। ডাক্তাররা ওকে ছুঁতেও দিতেন না আমায়। আমি জানি, ভেতরে ভেতরে পুরো ভেঙে পড়েছিল ও। কিন্তু খুব চাচ্ছিল আমি যেন ভেঙে না পড়ি। আমাকে হাসানোর চেষ্টা করত বারবার। আমার মনে আছে, ও সব সময় আমাকে বলত, ‘অ্যাই, তোমার নামটা এত সুন্দর কেন?’ আমার বারবার মনে পড়ে, মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওর মুুখ থেকে একটা কথাই বের হয়েছে—প্রিয়ন্তী! শাহরীন বলেছিল, ‘আচ্ছা, আমি তোমার নাম ধরে ডাকলে কি তুমি সব সময় জবাব দেবে?’
আমি বলেছি, ‘হ্যাঁ দেব।’
ও বলল, ‘প্রিয়ন্তী!’
আমি বললাম ‘হ্যাঁ বলো!’
ওটাই ছিল শাহরীনের সঙ্গে আমার শেষ কথা। ভালো থেকো শাহরীন। আমি তোমাকে কোনোদিন ভুলব না।