বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তৎকালীন যশোর আর বর্তমানের চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহাকুমার বারাকপুর গ্রামে। একবার বনগাঁয় ঘটনাচক্রে পরিচয় হয় ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। সেটা ১৯৪০ সালের দিকের কথা। তত দিনে পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যকসহ বিভূতিভূষণের বেশির ভাগ বিখ্যাত উপন্যাস বেরিয়ে গেছে। দেশজোড়া তাঁর খ্যাতি। সভা-সেমিনার, সাহিত্য আড্ডায় ডাক পড়ছে। সে সময় ষোড়শীকান্তদের বাড়িতে প্রায়ই যান বিভূতি। বেশ কয়েক দিন থাকেন। ষোড়শীবাবু নিজে সাহিত্যরসিক, লেখালেখি করেন, বেশ কটা বইও বেরিয়েছে। তাঁর দুই মেয়ে মায়া আর কল্যাণীও বই পড়েন। বিভূতিভূষণের পাঁড় ভক্ত। পরে কল্যাণীর সঙ্গেই বিভূতির দ্বিতীয় বিয়ে হয়।
বিভূতিভূষণ তখন তাঁর বিখ্যাত বই তারানাথ তান্ত্রিক–এর পাণ্ডুলিপির খসড়া শেষ করেছেন। সে সময় একদিন ষোড়শীকান্তের শ্বশুর সারদাকান্ত চক্রবর্তী এলেন মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে। বাড়িতে তখন একটাই আলোচনা—বিভূতিভূষণ। সারদাকান্ত একসময় বিহারের ভাগলপুরে থাকতেন। ছিলেন খেলাত ঘোষ এস্টেটের সুপারিনটেনডেন্ট পদে। তাঁর অধীনে তখন চাকরি করতেন এক বিভূতিভূষণ। তাঁরও লেখালেখির বাতিক ছিল। পথের পাঁচালীর লেখক তিনিই। আরণ্যক উপন্যাসে তো সারদাকান্ত নামের একটা চরিত্রই জুড়ে দিয়েছেন বিভূতিভূষণ।
বিভূতিভূষণ লোকটাকে পছন্দ করতেন। গল্প শুনতেন তাঁর কাছে। এরই মধ্যে সারদাকান্ত একদিন গল্প করেন নিজের জামাতাকে নিয়ে। তিনি তন্ত্রমন্ত্র জানেন, প্ল্যানচেট করেন ইত্যাদি। সে গল্প শুনেই বিভূতিভূষণ পেয়ে যান তারানাথ তান্ত্রিকের দেখা। এত দিন পর সেটাই গুছিয়ে এনেছেন। শুধু প্রকাশের অপেক্ষা। কিন্তু বিভূতিভূষণ শুধু লিখেই ক্ষান্ত হননি। তারানাথ তান্ত্রিক, অর্থাৎ ষোড়শীকান্তকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপও করেছেন বইয়ে।
সারদাকান্তে, ষোড়শীকান্ত আর তাঁর মেয়েরা নিশ্চিত হলেন, ভাগলপুরের সেই বিভূতিভূষণ এখন তাঁদের পারিবারিক বন্ধু। তাঁরা বরং খুশিই হলেন। কিন্তু মুখভার বিভূতিভূষণের। তারানাথ তান্ত্রিক প্রেসে চলে গেছে ছাপা হতে। এ বই প্রকাশিত হলে তো কেলেঙ্কারির একশেষ। ষোড়শীকান্ত আর তাঁর মেয়েদের বুঝতে বাকি থাকবে না, তারানাথ তান্ত্রিক লোকটা কে? যদি তারা চটে যায়, সম্পর্ক শেষ! বিভূতিভূষণ ভয়ে ভয়ে গিয়ে সব খুলে বললেন হবু শ্বশুরকে। তিনি হাসিমুখেই মেনে নিলেন ব্যাপারটা।